[রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের পক্ষে অখণ্ড বঙ্গের প্রথম প্রান্ত প্রচারক তথা পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘকার্যের মূল কাণ্ডারী শ্রী কেশবরাও দত্তাত্রেয় দীক্ষিত। রাষ্টীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এই বরিষ্ঠ প্রচারক বাংলায় একাদিক্রমে ৭২ বছর ধরে প্রচার করে গেছেন দেশপ্রেমের সৌগন্ধ, রাষ্ট্র নির্মাণের কাহিনী। রচনা করেছেন বহু রাষ্ট্রবাদী মনন। সঙ্ঘের যে বয়স, ওঁর-ও সেই বয়স; ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠা হয়, সেই বছরই কেশবজীর জন্ম। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ড. কেশব বলিরাম হেডগিয়ার (ডাক্তারজী) নিজে হাতে তাঁকে নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রবীণ মহীরুহের ছায়া আর রইলো না। ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০ টা ৩৪ মিনিটে সন্ন্যাসীসম এই দেশসেবকের প্রয়াণ ঘটে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাষ্ট্রবাদীদের কাছে এ এক গভীর শোকের দিন। আদ্যন্ত এই বাঙালির মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৮]
কেশবজীর ছোটো ভাই শ্রী অনন্ত দীক্ষিত আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি গ্রামে বাস করতেন। বয়স তখন ৭৬ বা ৭৭, একটি মোবাইল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন তিনি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। ছেলে-মেয়ে নিয়ে তিনি ছিলেন মার্কিন নাগরিক। ২০০৫ সালে তিনি ছোটো ভাইয়ের আমন্ত্রণে তিন মাসের জন্য আমেরিকায় যান। এটি কোনো লেকচার ট্যুর ছিল না। কেশবজী ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে একটি সাক্ষাতকারে আমায় জানালেন, “নিতান্তই ভাই-এর ডাকে এসেছি। সরকারি সফর নয়। ভাগ্য ভালো সঙ্ঘের কাজে পড়ে গেলাম। দেখা হল অনেক স্বয়ংসেবকের সঙ্গে।” প্রায় প্রতি সপ্তাহেই শাখায় যেতেন তিনি। আমেরিকায় রবিবার ছুটির দিনে সাপ্তাহিক শাখা হত। প্রবাসী ভারতীয়রা কতটা দেশকে ভালোবাসলে নিয়মিত ভারতচর্চা করতে পারেন! শাখায় বিভিন্ন দিনে কেশবজীকে অনুরোধ করা হল, কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য। যেমন ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারির সময় সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা কী করলেন; শিবাজীর রাজ্যাভিষেক ও হিন্দু সাম্রাজ্য গঠন কীভাবে হল, সেই রকম রাজ্য বা দেশ ভারতবর্ষেও করা যায় কিনা — এই সব নিয়ে। কেউ একজন প্রশ্ন করলেন, ডাক্তারজীকে আপনি দেখেছেন? কেশবজী বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর সেই ভদ্রলোক সবিশেষ জানতে চাইলেন, সবাই জানতে আগ্রহী। কেশবজী জানালেন সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা। একদিন কার্যক্রম শেষ হবার পর এক ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন; যেন কেশবজীকে কিছু বলতে চান।
কেশবজী: আপনি কিছু বলবেন?
ভদ্রলোক: Yes, I want to touch you.
কেশবজী: But why?
ভদ্রলোক: Because you have talked with Doctorji. I like to touch you.
কেশবজী সম্মতি দিলে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কাঁদতে আরম্ভ করলেন। বললেন, তিনি যেন ডাক্তারজীর সময়ে চলে এসেছেন। সেই একই ধারায় সঙ্ঘ চলছে, সেই একই ট্র্যাডিশন। কেশবজী জানালেন, তিনি তো আর কোনো কাজ করেননি, শুধু সঙ্ঘ করেছেন, সঙ্ঘের ভাবাদর্শে চলেছেন, কোনোদিন তার ব্যত্যয় ঘটে নি। ভদ্রলোক বলছেন, একদম তাই, এটাই চলার কথা। কিন্তু আপনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে একটা আদর্শকে সামনে নিয়ে এতদিন চলছেন, আজও চলছেন, আর আমাদের পথ দেখাচ্ছেন, যে পথ আপনাকে ডাক্তারজী দেখিয়েছেন। তিনি ভাবদৃশ্যে সে ঘটনা অবলোকন করছেন বলেই আনন্দাশ্রু ফেলেছেন। এই ঘটনা কেশবজীকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। উনি বললেন, হ্যাঁ, গঙ্গার ধারার মত সঙ্ঘের কার্যধারা বয়ে চলেছে, একাদিক্রমে প্রায় ৯৮ বছর। আমরা তার কুশীলব। আমরাই তার ধারক ও বাহক। অনেক স্বয়ংসেবক এসেছেন, কাজ করেছেন, পৃথিবী থেকে বিদায়ও নিয়েছেন। এখনও সঙ্ঘের অনন্ত কার্যধারা, এটা চলতেই থাকবে। আগামীদিনে আরও কত প্রাণোচ্ছল যুবক যুবতী আসবেন, কাজ করবেন এই ভারত ভূমির জন্য, ভারতীয় সংস্কৃতির জন্য, সনাতনী সভ্যতা রক্ষার জন্য। কেশবজী জানালেন, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যুগে যুগে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য, শুভঙ্করী শক্তিকে বিজয়ী করার জন্য ভগবানের আবির্ভাব ঘটে। এ যুগেও ভগবান আসবেন, কিন্তু তার আগে ভগবানের আগমন সহায়ক-শক্তি দরকার হয়। সঙ্ঘশক্তি যেন সেই রকমই একটি শক্তি। তিনি মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন। ভগবান আসছেন।
কল্যাণ চক্রবর্তী।