১৯৫০ সাল থেকে একাদিক্রমে প্রায় ৭২ বছর কাটিয়েছেন এক মারাঠি যুবক, বঙ্গের নগরে প্রান্তরে; জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ভারতীয় সংস্কৃতির অখণ্ড চর্চায় বাঙ্গালি সমাজকে অবগাহনের মন্ত্র শোনাতে গিয়ে নিজে কখন যে অনবধানে ডুব দিয়েছেন বঙ্গ-সংস্কৃতির অতল গভীরে; আর হয়ে উঠেছেন আদ্যন্ত এক বাঙ্গালি — তা নিজেও হয়তো টের পাননি। হ্যাঁ, এমনই এক বরিষ্ঠ দেশ-সেবক আজও আমাদের সঙ্গে একই সংস্কৃতিচর্চার শরিক হয়ে, বাঙ্গলার পুণ্যভূমে দেশভক্তির জপ-মালার পুঁথি বিতরণ করে চলেছেন কলকাতা মহানগরীতে বসে। তিনি সর্বজনমান্য আটানব্বই বছর বয়সী স্বয়ংসেবক শ্রী কেশবরাও দীক্ষিত।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের ‘বরিষ্ঠ প্রচারক’ শ্রী কেশবরাও দীক্ষিতের জন্ম ১ লা আগষ্ট, ১৯২৫ সালে মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার পুলগাঁও গ্রামে। পিতা দত্তাত্রেয় দীক্ষিত, মাতা সগুণা দেবী এবং পিতামহ চিন্তামণি দীক্ষিত। পারিবারিক পেশা পৌরোহিত্য হলেও, তার পিতা ছিলেন পরিবারের প্রথম চাকুরীজীবী। দত্তাত্রেয় একটি কটন মিলে কাজ করতেন। পাঁচ ভাই ও চার বোনের সংসারে কেশবজী ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তার উপনয়ন দেওয়া হল। ১৯৪৯ সালে জলগাঁও-এর এম. জে. কলেজ থেকে তিনি মারাঠি ও সংস্কৃতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হল প্রচারকের জীবন; আজও সেই পথে ভারতের যুবসমাজকে পথ দেখাচ্ছেন। এই ৭২ বছরের প্রচারক-জীবনের পূর্বের গল্পও শুনিয়েছেন তিনি। সে কাহিনী সম্পৃক্ত হয়ে আছে ভারতের এক মহান সন্তান ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের পুণ্য-পরশ। একটি কর্মময় সংস্থার ইতিহাসের সঙ্গেও সাংখ্যিক যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে, কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সূচনা আর কেশবজীর জন্মসাল ঘটনাচক্রে একই বছর। আর এই দুই ‘কেশব’ সান্নিধ্য যেন দীপ জ্বালানোর এক ক্রমান্বয় বার্তা। কেশব বলিরাম হেডগাওয়ার কিশোর কেশবের প্রাণে যে অগ্নি প্রজ্বলন করেছিলেন তা নানান শাখায় বঙ্গভূমিতে শতদীপে বিকশিত হয়েছে।
কিশোরবেলায় কেশবজী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডা. হেডগেওয়ারের সান্নিধ্যে আসেন, তখন তার বয়স বারো বছর। ডাক্তারজী ফুলগাঁও জংশন ষ্টেশন হয়ে ওয়ার্ধা জেলারই আর্ভি শহরে যেতেন, সেখানে সঙ্ঘের একটি ভালো শাখা ছিল, ৪০-৪৫ জন দেশব্রতী মারাঠি যুবক রোজ আসতেন সেখানে। এমনই একটি শাখায় ডাক্তারজীও মাঝেমাঝে আসতেন; নামতেন ফুলগাঁও জংশনে এবং সেই সুযোগে কেশবজীর পিতা ডাক্তারজীকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে ভুলতেন না কারণ কেশবজীর বাবাও একজন স্বয়ংসেবক ছিলেন। দত্তাত্রেয়র আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ডাক্তারজী তাদের বাড়িতে একাধিকবার এসেছেন, চা-জলখাবার খেয়েছেন। এমনই আসা-যাওয়ার সূত্রে বালক কেশব প্রথমবার ডাক্তারজীকে নিজের বাড়িতে দেখলেন ১৯৩৭ সালে। দরজার কোণে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন এক মহাপুরুষকে, তাঁর কথা গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন এক অমোঘ আকর্ষণে। ডাক্তারজী জলখাবার খাচ্ছেন, ডাকলেন বালক কেশবকে। “অ্যাই তোমার নাম কী?” “আমি কেশব।” “বেশ বেশ! এই ছেলেটাকে আমাকে দিয়ে দিন।” দত্তাত্রেয় বললেন, “আপনার-ই তো ছেলে, নিয়ে যান।” খুব হাসিঠাট্টা করছেন ডাক্তারজী।
১৯৩৮ সালের কোনো একদিন ফুলগাঁও থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে নাসেরগাঁও সঙ্ঘ-শাখায় কেশবজীর জন্য অপেক্ষা করছিল এক সুবর্ণ দিন। সেদিন ডাক্তারজী শাখায় এলেন। শাখায় উপস্থিতির সংখ্যাও সেদিন যথেষ্ট। সভায় প্রার্থনায় তন্ময় হয়ে গাইলেন কিশোর কেশব। মারাঠি ও হিন্দীতে শ্লোগানও দিলেন তিনি। সভায় উপস্থিত ছিলেন কেশবের পিতা দত্তাত্রেয়। ডাক্তারজী বালকের কণ্ঠে সঙ্ঘগীত শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, দত্তাত্রেয়কে জিজ্ঞাসা করলেন কে এই বালক! দত্তাত্রেয়র সন্তান জেনে আরও খুশি হলেন, খুব আদর করলেন বালক কেশবকে। ওই সোনালি দিনগুলি স্মরণ করে আজও সপ্রতিভ হয়ে উঠতেন কেশবজী, ফিরে যেতেন সেই বালক-বেলায়।
গভীর দুঃখ ও বেদনার বিষয় আজ ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০ টা ৩৪ মিনিটে ইহলোক ছেড়ে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক যুগের অবসান হল, যার ছত্রে ছত্রে ছিল সনাতনী সন্দেশ, সৌকর্য এবং অভূতপূর্ব স্নেহ ভালোবাসা। পরম শ্রদ্ধেয় কেশবজীকে বঙ্গমাতা তার নিজের সন্তান করে নিয়েছিলেন। আমরা আজ এক গর্বিত ভারতবাসী তথা বিশিষ্ট বাঙালিকে হারালাম। তিনি আদ্যন্ত বাঙালি হয়ে আমাদের সকলের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। সেই ছাতা আজ সরে গেলো। কিন্তু তিনি আমাদের নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করবেন, যেখানেই থাকুন। কেশবজী অমর রহে। ওনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী ।