দিনাজপুর সদর উপজেলায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে উপহার পাওয়া সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আশ্রয়ণের ঘর দখল হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের চিলমন খান দিঘির পারে স্থানীয় কয়েকটি পরিবারের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন সাঁওতালরা।
ঘরগুলোতে উঠতে না পেরে অন্যের ঘরের বারান্দা ও আগের জায়গায় কষ্টে দিন কাটছে সাঁওতালদের। এমন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঘর দখল হওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন সাঁওতালরা। লিখিত অভিযোগে তাঁরা জানান, সরকারের কাছ থেকে ঘরের দলিল বুঝে পাওয়ার পর ঘরে উঠতে গেলে মুসলমানেরা সাঁওতালদের হুমকি দেন, প্রাণনাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘরগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যদিও ঘরের দলিল তাঁদের কাছে, কিন্তু ঘর দখলে রেখেছেন অন্যরা।
গত বুধবার দুপুরে চিলমন খান দিঘির পারে সাঁওতালদের আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা ঘুরে জানা যায়, ৯ একর জায়গাজুড়ে চিলমন খান দিঘি। দিঘির তিন ধারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৫২টি সাঁওতাল পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দিঘির পূর্ব পাশে অর্ধেক অংশে মুসলমানদের কবরস্থান। বাকি অংশে সাঁওতালদের কবরস্থান ও মন্দির। পাশেই প্রায় এক একর জায়গায় কোদাইলধোয়া দিঘি। ইতিমধ্যে ৪০টি ঘরে ৪০টি সাঁওতাল পরিবার বসবাস শুরু করেছে। তবে তৃতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ করা ১২টি পরিবার বাধার মুখে ঘরে উঠতে পারছে না।
ফাজিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অভিজিৎ বসাক বলেন, উপজেলা থেকে চিলমন খান দিঘির পারে বসবাসরত সাঁওতালদের জন্য ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ গায়ের জোরে তাঁদের কয়েকটি ঘর দখল করে রেখেছেন। যেহেতু তিনি সনাতনধর্মী, তাই বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চিলমন খান দিঘির পারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩০টি, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১০টি ও তৃতীয় পর্যায়ে ১২টি সাঁওতাল পরিবারের জন্য উপহারের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জমির কবুলিয়তসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাঁওতাল রবেন মুরমু (৫১) বলেন, তিন পুরুষ ধরে চিলমন খান দিঘির পারসহ পাড়গাঁও গ্রামে শতাধিক সাঁওতাল পরিবার বসবাস করছে। এর মধ্যে দিঘির পারে ৩০টি পরিবারে ১৬৭ জনের বসবাস। সবার মাটির ঘর ছিল। বেশ কষ্টে ছিলেন তাঁরা। সরকার ঘর করে দেওয়ার পর কষ্ট কিছুটা দূর হয়েছে। ৪০টি পরিবার ঘরে উঠতে পারলেও বাকি ১২টি পরিবার উঠতে পারছে না। কবরস্থানের দোহাই দিয়ে মুসলমানদের কয়েকটি পরিবার ঘরগুলো দখল করে রেখেছে।
সুনীল কিস্কু (৪৫) বলেন, ‘দিঘির পারে আমার একটা মাটির ঘর ছিল। ঘরটা ভেঙে নতুন করে সরকারি ঘর হলো। কিন্তু সে ঘরে আর উঠতে পারছি না। বোনের বাড়ির বারান্দায় রাত কাটাতে হচ্ছে। ঘরে উঠতে গিয়ে দেখি, তালা মেরে রাখা হয়েছে।’
নতুন ১২টি ঘরের ৬টির দরজায় তালা ঝুলছে। বাকি ছয়টিতে বসবাস শুরু করেছেন পাশের পরশুরামপুর গ্রামের মোস্তফা কামাল, দফিলউদ্দিন, আজিজুল ইসলাম, ইয়াসিন আলী, বকুল আলী ও অমিলা বেগম। তবে ঘর দখলে রাখতে ঘরের মেঝেতে শুধু চাটাই-বালিশ রেখেছেন তাঁরা। সাঁওতালদের নামে বরাদ্দ করা ঘরে ওঠার কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, তাঁরাও ভূমিহীন। প্রথম দিকে তাঁদের ঘর দেওয়ার কথা ছিল। দিঘির পারে তাঁদের একটা কবরস্থান আছে। কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হলেও সেখানে বসবাস করা তাঁদেরই অধিকার।
ঘরের সঙ্গে কোদাইলদহ দিঘি। মৎস্যজীবী সমিতির নামে দিঘিটি বরাদ্দ। সেই সমিতির কাছে এক লাখ টাকা জামানত দিয়ে দিঘিতে মাছ চাষ করছেন রহিম উদ্দিন। তিনি এবং তাঁর বোনও সেখানে ঘর দখলে নিয়েছেন। দিনমজুরির কাজ করেন দফিলউদ্দিন। তাঁর দুই ছেলে রোজগার করেন। ৯ শতক জমিতে পরশুরামপুরে তাঁর ভিটেমাটি আছে। দফিলউদ্দিন বলেন, ছেলে খাবার দেয় না, দেখাশোনা করে না বলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে এসে উঠেছেন।
সাঁওতাল পরিবারের ছেলে শাওন হাসদা। তিনি উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। শাওন বলেন, পাড়ায় ৪৬ জন শিশু-কিশোর আছে। এমনিতেই খেলার মাঠ নেই। পূজা-পার্বণে অনুষ্ঠান করার জায়গা নেই। মন্দিরের যে জায়গায় অনুষ্ঠান করা হতো, কবরস্থানের কারণে সেটি বন্ধ। তাঁর মতে, যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে সাঁওতালরা এখানে বসবাস করে আসছেন, তাই শুধু তাঁদের জন্যই ঘরগুলো বরাদ্দ রাখা উচিত।
দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মর্তুজা (ইউএনও) আল মুঈদ বলেন, সরকারিভাবে যাঁদের জন্য ঘর বরাদ্দ হয়েছে, তাঁরাই প্রাপ্য হবেন। অন্য কারও দখলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দু–এক দিনের মধ্যে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হবে।