সেরিনা উইলিয়ামস মানে কি শুধুই মহিলাদের টেনিসে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়? সেরিনা উইলিয়ামস মানে কি শুধুই ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম? সেরিনা উইলিয়ামস মানে কি শুধুই এক জন মা, যিনি সংসার করবেন বলে নিজেকে খেলা থেকেই সরিয়ে নিচ্ছেন? নাকি সেরিনা উইলিয়ামস এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদের নাম, যিনি আপাতদৃষ্টিতে শ্বেতাঙ্গদের খেলায় থাবা বসিয়ে যাবতীয় নজর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন?
উপরের যে ক’টি বিশেষণ তাঁর নামের পাশে ব্যবহার করা হল, সবক’টিই সত্যি। সাম্প্রতিক কালে মহিলাদের টেনিসে যে ধরন দেখা যাচ্ছে, তাতে সেরিনার ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যাম কে ভাঙবেন বা আদৌ কেউ ভাঙতে পারবেন কি না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। তাঁকে তো তর্কাতীত ভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা মহিলা টেনিস খেলোয়াড় বলাই যায়।
তবে সেরিনার অন্য একটি দিকও রয়েছে, যে দিকে সরাসরি তাঁর কোনও অবদান না থাকলেও পরোক্ষ ভাবে রয়েছেই। ইউএস ওপেনের – রাউন্ডে হেরে পূর্বঘোষণামতো টেনিসজীবনকে বিদায় জানালেও, সেরিনা সবার অলক্ষে এমন একটি কাজ করে গেলেন, যার সুফল পাওয়া যাবে আগামী দিনে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের এক দরিদ্র পরিবার থেকে সেরিনা এবং তাঁর দিদি ভিনাসের উঠে আসা, গলিতে টেনিস খেলা এবং সেখান থেকে পকেটে একের পর এক গ্র্যান্ড স্ল্যাম থাকা, কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও শ্বেতাঙ্গদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা— এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়। দুই বোনকে কাছ থেকে দেখেছেন আমেরিকা টেনিস সংস্থার কর্তা এবং প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় মার্টিন ব্ল্যাকম্যান। কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনযাপনে কতটা প্রভাব ফেলেছেন সেরিনা, সেটা উঠে এসেছে তাঁর কথায়।
বলেছেন, “কম্পটনের একটা দরিদ্র পরিবারে বড় হয়ে উঠেছিল ও আর ভিনাস। টেনিস খেলার মতো টাকাও ছিল না। অনেক বিনিয়োগ লাগত। তার উপর বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকান সমাজে খেলাটা ছিল মূলত শ্বেতাঙ্গদের। সেই কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে আসা ওদের উত্থানের প্রথম ধাপ।” ব্ল্যাকম্যানের সংযোজন, “নিজে অ্যাফ্রো-আমেরিকান হয়ে ওদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতাম। ওদের আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হয়ে যেতাম। বাকিরা অবাক চোখে দেখত।”
ব্ল্যাকম্যানের মতে, সেরিনার সবচেয়ে বড় গুণ আত্মবিশ্বাস। নিজের সঙ্গে আপস না করে, সামনে যা বাধা রয়েছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়ার আরেক নাম সেরিনা। শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে নয়, আমেরিকার স্পেনীয় ভাষাভাষি, বিভিন্ন দেশের অভিবাসী এমনকি সমকামীদের মধ্যেও এই আত্মবিশ্বাসের বীজ পুঁতে দিতে পেরেছেন সেরিনা। তাঁর উত্থান বিশেষ ভাবে প্রভাব ফেলেছে সে দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের উপরে। সেরিনাকে দেখে টেনিস খেলতে এগিয়ে এসেছেন বহু কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েরা। দিন দিন তা বেড়ে চলেছে।
একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। দু’বছর আগের ইউএস ওপেনে অ্যাফ্রো-আমেরিকান খেলোয়াড়দের সংখ্যা ছিল ১২। সেরিনার আগে অ্যাফ্রো-আমেরিকান হিসাবে গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে উঠেছিলেন জিনা গারিসন। গত পাঁচ বছরে কোকো গফ, স্লোয়েন স্টিফেন্স এবং ম্যাডিসন কিসের মতো অ্যাফ্রো-আমেরিকানরা ফাইনালে খেলেছেন। জাপানের নেয়োমি ওসাকার কথাও ভুললে চলবে না। তাঁর শিকড় যদিও আফ্রিকায় নয়, জাপানে। কিন্তু আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে ধরা হয় ওসাকাকেও।
অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের উপর কী ভাবে সেরিনা প্রভাব ফেলেছেন, সেটা গফের কথাতে বোঝা যায়। এ বারের ফরাসি ওপেনে সাড়া জাগিয়ে ফাইনালে উঠে হেরে যান। তার পরে বলেন, “সেরিনার আগে টেনিসে এমন কোনও খেলোয়াড় ছিল না যাঁর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেতাম। টেনিস খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠার সময় কোনও দিন সমস্যা হয়নি। কারণ জানতাম, বিশ্বের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড়কে অনেকটা আমার মতোই দেখতে। এই বিশ্বে কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে জন্মালে, একটু কমেই খুশি থাকতে হয়। সেরিনা শিখিয়েছে, ও কম পেয়ে থেমে যেতে রাজি নয়।”
কানাডার কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় লেইলা ফের্নান্দেস বলেছেন, “মহিলা টেনিস খেলোয়াড়দের সামনে একটা পথ দেখিয়েছে সেরিনা। কী ভাবে লক্ষ্য পূরণ করা যায়, কী ভাবে নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করা যায়, সেটা সেরিনার থেকেই শিখেছি।”
ইউএস ওপেন শুরুর আগেই রাফায়েল নাদাল বললেন, “সেরেনা শুধু টেনিস খেলোয়াড়ই নয়, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ক্রীড়াবিদ।” ড্যানিল মেদভেদেভ বললেন, “আগামী ১০০ বছরেও সেরিনাকে নিয়ে কথা হবে।” অর্থাৎ, শুধু মহিলা টেনিস দুনিয়ায় নয়, সেরিনা নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, যেখানে পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়দের থেকেও সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন। মেয়েরাই শুধু নয়, ছেলেরাও তাঁকে দেখে শিখতে চাইছে, অনুপ্রাণিত হতে চাইছে।
মাথা নীচু করে নয়, সেরিনা বিদায় নিচ্ছেন মাথা উঁচু করেই। সেরিনারা বিদায় নেন মাথা উঁচু করেই।