ভারতবর্ষে আমরা প্রতি বছর ‘শিক্ষক দিবস’ পালনের
জন্য ভারতরত্ন ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ (Dr Sarvepalli Radhakrishnan) এর জন্মদিন টিকে বেছে নিয়েছি। ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ শিক্ষা জগতে এক উজ্জ্বল নাম। একাধারে দর্শনের অধ্যাপক , বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক এবং ভারতবর্ষের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। এইরকম একজন মনীষীর জন্মদিন এমনিতেই পালন করা যায় কিন্তু শিক্ষা জগতে ভারতবর্ষে অনেক বড় বড় শিক্ষাবিদ , বৈজ্ঞানিক জন্ম নিয়েছেন তাহলে শুধুমাত্র সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ এর জন্মদিনটিকেই শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের কি গুরুত্ব ? যে ব্যক্তি সারাজীবন ধরে সারা বিশ্বের দর্শনের ইতিহাস, সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শনের তূলনামূলক আলোচনা করে অজস্র প্রবন্ধ , গবেষণাপত্র , বই সমগ্ৰ বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন তিনি নিজের আত্মজীবনী লিখলেন না কিন্তু তাঁর ছাত্ররা ওনার জন্মদিন পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে নিজের জন্মদিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব রাখলেন।রাধাকৃষ্ণাণ এর এহেন ইচ্ছার কি কারণ থাকতে পারে? যিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের বেতনের বেশিরভাগই প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দিতেন, যিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে সুপরিচিত দার্শনিক ও অধ্যাপক , তাঁর আর নিজেকে নতুন করে ভারতীয় মননে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন ছিল, তাঁর দর্শনকে বা বলা ভালো ভারতীয় দর্শনকে শিক্ষাজগতে প্রতিবছর স্মরণ করানোর। কারণ ; রাধাকৃষ্ণাণের কর্মজীবন , ভারতীয় দর্শনকে বিশ্বের শিক্ষাজগতে ও দার্শনিকদের মাঝে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতেই ব্যয়িত হয়েছিল।একসময় স্বামী বিবেকানন্দের দৃপ্ত ভাষণে, বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে ভারতবর্ষের যে দর্শন বিশ্বমঞ্চে ধ্বনিত হয়েছিল তার প্রতিধ্বনি শিক্ষাজগতে শোনা গেলো রাধাকৃষ্ণাণ এর লেখনীর মাধ্যমে। পাশ্চাত্যের দার্শনিকগণ ভারতীয় ধর্ম , দর্শন , ভারতীয় জীবনপদ্ধতি নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলেন তাঁর প্রত্যুত্তর দিলেন ডঃ রাধাকৃষ্ণাণ।
ভারতীয় দর্শনকে পশ্চিমের শিক্ষাজগতে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে প্রয়োজন ছিল ভারতীয় শাস্ত্রের ভাষা সংস্কৃতের জ্ঞান আর ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা আর সেই সঙ্গে ভারতীয় জীবনপদ্ধতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা–এই সবই তাঁর ছিল। তাঁর পরিবারে ভারতীয় শাস্ত্র অধ্যয়নের পরম্পরা ছিল।
দর্শনের ক্ষেত্রে ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের কাজ ছিল প্রধানতঃ মানবজীবনের লক্ষ্য, সমস্যা , আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে ‘ভারতীয় দর্শন’কে তুলে ধরা। ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে নিজের জন্মদিন পালনের মধ্যে দিয়ে মানুষ গড়ার কারিগররা প্রতিবছর তাঁর উপলব্ধিগুলো তুলে ধরবেন — এই ছিল তাঁর ইচ্ছা।রাধাকৃষ্ণাণ চেয়েছিলেন ‘Teachers should be the best minds in the country’ আর ‘best mind’ কিভাবে হওয়া যাবে তার বার্তাটি তাঁর দর্শনের মধ্যেই পাওয়া যায়।আজ আমরা বিভিন্ন দেশে উপাসনা পদ্ধতির (Religion) নামে বর্বরতা প্রত্যক্ষ করছি। স্বামী বিবেকানন্দের মতো রাধাকৃষ্ণাণ বারবার একই দিকে নির্দেশ দিয়েছেন যে বেদান্তের ঐক্যবোধের ভাবনা থেকেই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।বিশ্বকে যে তিনি যে তাঁর বিশ্বশান্তির উপায় দিয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন তার প্রমাণ বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টার জন্য তাঁর নাম ১১ বার ‘নোবেল’ পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শনের তূলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে ভারতবর্ষের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন “Those who are acquainted with the religious history of Europe do not understand the striking phenomenon of China and India, that sectarian differences do not have the same significance there as they have in the West.If one is a devotee of Vishnu, it would not occur to him to look upon his neighbour who worships Siva as a heretic , doomed to everlasting predition.These divinities represent different aspects of the Supreme.Chinese travellers of the early centuries of the Christian era give us accounts of crowds of Indian devotees of different sects meeting together and discussing ultimate problems or of universities run by teachers of different religious persuasions.”(East & west-A reflection)
ইউরোপ ও আরবের মতো ভারতীয় দর্শন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী এই দুইভাগে মানবজাতিকে ভাগ করে না , উপাস্যের নামে নৃশংসতার উদাহরণ তাই ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করেনি যতদিন না পশ্চিম বিশ্ব নিজের উপাসনা পদ্ধতি নিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষের ‘তত্ত্বমসি’ ও ‘সর্বং খল্বিদং ব্রক্ষ্ম’ এর দর্শনকে ব্যাখা করে রাধাকৃষ্ণাণ পশ্চিমের উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে ভারতবর্ষের পার্থক্য বুঝিয়েছেন তাঁর ‘Hindu view of life’ বই তে।
রাধাকৃষ্ণাণ ছিলেন একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি মানুষ অনন্ত শক্তির আধার, বিশ্ব চৈতন্যের অঙ্গ। মানুষের মধ্যে যত বিভিন্নতাই থাকুক না কেনো আসলে তাদের লক্ষ্য এক এবং তা হলো সেই পরম সত্ত্বার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করা।
শুধুমাত্র আর্থিক সমৃদ্ধি , পার্থিব সুখ মানুষের উদ্দ্যেশ্য হতে পারে না।রাধাকৃষ্ণাণ বলেন “Man can not be satisfied with earthly possessions not even with knowledge which instructs , informs and even entertains.He has another destiny, the realisation of the spirit in him.”
রাধাকৃষ্ণাণ নিজের একটি ভাষণে বলেন “Unless we develop spiritual sensitivity we can not be regarded as property educated.” রাধাকৃষ্ণাণ চেয়েছিলেন উপনিষদের আলোকে যে ‘spiritual sensitivity ‘ যে আধ্যাত্মিকতার জন্ম হবে তাই নিয়ে আসবে কর্তব্যবোধ , নৈতিকতা।The ethics of Vedanta ‘ প্রবন্ধে ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ বেদান্তের দর্শন প্রসঙ্গে পশ্চিম বিশ্বের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং ভারতবর্ষের পুনরুত্থানে বেদান্তের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা কি সেই নৈতিকতার পাঠ দিতে পেরেছি না দেওয়ার চেষ্টাটুকুও করেছি তা একটি বড় প্রশ্ন।’
রাধাকৃষ্ণাণ নিজের কর্মজীবনে যখন সক্রিয় , তখন তিনি দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন।তাই তাঁর আলোচনায় যুদ্ধের পেছনের কারণগুলো বারবার এসেছে।’Religion & Society ‘ বইতে হিটলারের প্রসঙ্গ টেনে বুঝিয়েছেন সমাজে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা। মানুষ যখন এক অসীম সত্ত্বাকে অস্বীকার করে নিজেকে সবকিছুর নিয়ন্তা ভেবে বসে তখনই সমাজে যথেচ্ছাচার জন্ম নেয়, স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের সৃষ্টি হয়, এক রাষ্ট্রনায়ক সমস্ত পৃথিবীকে নিজের পদতলে নিয়ে আসতে চায়।রাধাকৃষ্ণাণ এর কথায় “In his attempt to grasp and control life , build up a culture without God , he rebels against God.Self-sufficiency is carried to extreames .Wars are a result of this apostasy, this exaltation of nature unmodified by grace. The dictators have put themselves in the place of God.They wish to abolish belief in God , for they can brook no rivals.” (Religion & Society)
বিশ্বে যখন কমিউনিজমের বাড়বাড়ন্ত , সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে একের পর এক দেশ নিজেকে কমিউনিজমের আদর্শে গড়ে তুলতে চাইছে; বামপন্থার সূর্য যখন মধ্যগগনে রাধাকৃষ্ণাণ সেইসময় কমিউনিজমের দর্শনকে সমালোচনায় বিদ্ধ করতে ছাড়েননি।মানব সভ্যতার বিকাশকে রাধাকৃষ্ণাণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন নি। মার্ক্স এর তত্ত্বের মূলে আঘাত করে বলেছেন — ” A culture is not a superstructure of the material means of production as the Marxist believe.”
তাঁর ‘Hindu view of life’ বইতে রাধাকৃষ্ণাণ বিশ্বকে ভারতবর্ষের চার পুরুষার্থ ; ধর্ম , অর্থ , কাম ও মোক্ষ সম্পর্কে বলেন। অর্থ ও কামপূর্তি জীবনে প্রয়োজন কিন্তু তা কখনোই চরম লক্ষ্য নয়।ধর্মের পথে মানুষ অর্থ ও কামের পূর্তি করবে কিন্তু তার চরম লক্ষ্য মোক্ষ প্রাপ্তি— “Under the concept of dharma , the Hindu brings the forms and activities which shape and sustain human life.We have diverse interests , various desires , conflicting needs , which grow and change in growing.To round them off into a whole is the purpose of dharma. The principle of dharma rouses us to a recognition of spiritual realities not by abstention from the world, but by bringing to its life , its business (artha) and its pleasures(kāma), the controlling power of spiritual faith.
তাঁর বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও বইতে রাধাকৃষ্ণাণ ধর্মাশ্রয়ী সমাজের কথাই বলেছেন।’Religion & Society’ বই এর একটি অংশে সেক্যুলারিজম (Secularism) এর কুফল সম্পর্কে বলেছেন ‘Secularism is the chief weakness of our Age’ । প্রসঙ্গতঃ ডঃ রাধাকৃষ্ণাণের মৃত্যুর (১৭ ই এপ্রিল , ১৯৭৫) পর জরুরী অবস্থার সময় ভারতীয় সংবিধানে ‘secularism’ শব্দের সংযোজন হয়।
ভারতরত্ন , ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ নিজের সাহিত্যকীর্তির জন্য মোট ১৬ বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষে শুধুমাত্র দর্শনের শিক্ষার্থী ছাড়া সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা কি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে?এ এক অদ্ভুত দ্বিচারিতা নয় কি ? যাকে আমরা ‘জাতীয় শিক্ষক ‘ বলে গ্ৰহণ করেছি তাঁর সাহিত্য কীর্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোনো উপায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে নেই।
১৯১১ তে রাধাকৃষ্ণাণ তাঁর গবেষণাপত্র ‘The ethics of the Bhagavadgita and Kant’ এ জার্মান দার্শনিক কান্টের দর্শন ও ভাগবদগীতার নিষ্কাম কর্মের দর্শনের মধ্যে পার্থক্য ও মিল সম্পর্কে আলোচনা করে ‘ভাগবদগীতা’র মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এই গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক মহলে রাধাকৃষ্ণাণকে দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
যাকে আজ আমরা ‘আদর্শ শিক্ষক’ হিসেবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তিনি ‘ভাগবতগীতা’কে জীবনদর্শন হিসেবে তুলে ধরেছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত নৈতিকতার বিকাশে ‘গীতা’কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে আমরা পেরেছি কি ?
তাই শুধু ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা নয় , তাঁর দর্শনকে শিক্ষাক্ষেত্রে, সমাজে প্রয়োগ করতে পারলেই ‘শিক্ষক দিবস’ পালন স্বার্থক হবে।
পিন্টু সান্যাল