মা যে আসছেন সেকথা কাউকে মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন হয় না। গ্রামে-শহরে সব জায়গাতে বৃষ্টির বারিধারায় পৃথিবীকে সিক্ত করে, গাছ-পালা, লতা-পাতাকে স্নান করিয়ে, নদ-নদী ভর-ভরন্ত করে আগমনবার্তার ঘোষণা মানিজেই করে থাকেন। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানো, হাওয়ায় শিউলি ফুলের এক ঝলক গন্ধ ভেসে। আসা—সব মিলিয়ে আমরা অনায়াসেই বুঝে যাই যে মা’র আসার সময় হয়েছে–এবার আমাদেরও মাকে স্বাগত জানাবার জন্য তৈরি হবার পালা। ঘর-দোর পরিষ্কার করা, সাজানো-গোছানো, পূজাতে মা এবং বাকি সবার জন্য নতুন জামা-কাপড় কেনার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।
বাজার ভরা রকমারি জিনিস—জামাকাপড়, জুতো, গয়না, প্রসাধনী, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল থেকে শুরু করে কী নেই? দোকানিরা আশা করে আছে বিক্রির জন্য। ক্রেতারা উদগ্রীব কেনার জন্য। আজকাল পূজাতে অনেকেই শুধুমাত্র জামাকাপড় ও জুতোতেই সন্তুষ্ট নন। তাদের চাই দামি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী। চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। নতুন কাপড় পরে মাকে অঞ্জলি দেবার থেকে তারা ওইসব যন্ত্রপাতিতেই আনন্দ খুঁজে নিতে চান। পান কিনা তা অবশ্য জানা নেই। নতুন প্রজন্মের অনেককেই ঠিক বুঝে উঠতে পারি না—এসব প্রাণহীন জিনিস থেকে কোন প্রাণের আনন্দ তারা খুঁজে পায় জানি না। ভেবে কষ্ট হয় যে তারা বছরের এই একবারের আনন্দকে বুক ভরে নিতে পারে না। মনটা তখন হতাশায় ভরে যায়—ভাবি, মার আসা আগামীদিনে কি কেবলমাত্র পঞ্জিকার পৃষ্ঠাতেই থাকবে? আশার কথা, এখন নতুন প্রজন্মকেও দেখেছি যারা গাছে শিউলিফুল ফোটা দেখে নিজের মাকে প্রশ্ন করে, “মা, দুর্গাপূজা কি এসে গেছে?” রেললাইনের ধারে কাশফুল দেখে বলে, “দুর্গাপূজার ফুল ফুটেছে।” ছোটবেলা থেকে ওরা জানে যে প্রকৃতি এইভাবেই জানিয়ে দেয় মা’র আগমন-বার্তা। এইরকম নতুন প্রজন্মকে দেখে আবার বুক বাঁধি —মা আসবেন আমাদের মাঝে প্রতিবছর —কেউ তাকে উ পলক্ষ্য করে বিলাস-ব্যসনে গা ভাসাবেন, আবার কেউ বা সাগ্রহে মা’র জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন—ভোরবেলা সিডি-তে চণ্ডীপাঠ শুনে তৈরি হবেন মাকে স্বাগত জানাবার জন্য। তারপর যখন মা আসেন তখন এইসব‘পিছিয়ে পড়া’ নতুন প্রজন্ম নতুন গাড়ি, ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলি দেয় মাকে। ধুনুচি নাচের সময় ঢাকের তালে খালি পায়ে ধুনচি নিয়ে আরতি করে মাকে প্রণাম জানায় তারা। শাঁখ বাজানোর প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় নতুন প্রজন্মেরই কিছু মেয়ে। সুতরাং, আমাদের হতাশ হবার কোনো কারণ নেই—মা’র আসা, মা’র পূজা এসবই মা’র ইচ্ছা; মা নিজেই তার কাজ করেন ও করিয়ে নেন।
এখন এক প্রহসন চলে দুর্গাপূজার উদ্বোধন নিয়ে—মার পূজার উদ্বোধন করেন নামি-দামি ব্যক্তিত্বরা। এঁদের নিয়েও পাড়ায় পাড়ায় রেষারেষি। সার্বজনীন পূজার খরচের বেশ খানিকটা এই পর্বেই হয়ে যায়। আচ্ছা, তারা উদ্বোধন না করলে কি মা আসবেন না? এ কীরকম আদিখ্যেতা? আমরা তো মহালয়া, কলাবউ স্নানের মধ্যেই বুঝে যাই যে মা এলেন বলে—এবার অপেক্ষার পালা শেষ। এইসব তথাকথিত বড় বড় লোকের পেছনে অর্থব্যয় করে সেই অর্থে কিছু গরিবের কষ্ট লাঘব কি করা যেত না?মা তো সবার। সবাইমিলে আনন্দ করলে তো আনন্দও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এরপর ষষ্ঠীর দিন মণ্ডপে যখন মা’কে দেখতে যাই, তখন আরেক বিষম ধাক্কা অপেক্ষা করে থাকে। কে ইনি? ব্যয়বহুল মণ্ডপে, ব্যয়বহুল আলোকসজ্জায় সজ্জিতা, স্বল্প বস্ত্রে, অদ্ভুত ভঙ্গিমায় এ কেমন মা? এই মাকে তো দেখতে আসিনি। আশেপাশের শিল্পরসিক। দর্শকেরা ‘আর্টের ঠাকুরের প্রশংসার পঞ্চমুখ। শিল্পে তাদের মতো শরিক সমগ্র বিশ্বে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা মাকে খুঁজতে আসেননি তারা তো শিল্পীর পারদর্শিতার প্রশংসক। শ্রীরমেশ পাল, শ্রী পরেশ পাল, শ্রী গৌরাঙ্গ পালেদের তৈরি প্রতিমা দেখতে অভ্যস্ত চোখ মেনে নিতে পারে না ‘পোল-ডালার’ রূপিনী শিল্পকীর্তিকে। মন ভরে না, খুঁজে বেড়ায়। সন্ধ্যারতির সময় আবার গুটিগুটি পায়ে হাজির ছোট্ট একটি পূজামণ্ডপে — একচালার ঠাকুর—কলাবউ, গণেশ, লক্ষ্মী, মাদূর্গা স্বয়ং মহিষাসুরমর্দিনীরূপে, তারপর সরস্বতী, কার্তিক। মা’র পেছনে ঠিক ওপরে শিব ঠাকুরের একটি ছবি। মার গলায় লম্বা ফুলের মালা, ধূপ-ধুনো জ্বলছে, ঠাকুরমশাই নিষ্ঠাভরে পূজা করছেন, পাড়ার পুরুষ-মহিলারা করজোড়ে দাঁড়িয়ে, ঢাকের বাদ্যি, কাসর ঘণ্টা, মার আরতি চোখ ফেরানো যায় না। এই তো মা-ইনি তোমৃন্ময়ী নন-এখনও ইনি চিন্ময়ী। এই মাকে বুকে নিয়েই তো আবার এক বছরের জন্য বুক বাঁধি—এইভাবেই যেন মা আমাদের প্রতিবছর দর্শন দিয়ে ধন্য করেন।
পরিশেষে নিবেদন জানাই আমাদের সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পপ্রেমিকদের কাছে—আপনারা শিক্ষিত, শিল্পমনস্ক। আমাদের শিক্ষা, শিল্পকীর্তি দেখানোর বা উপভোগ করানোর জন্য অনেক ক্ষেত্র আছে—বুদ্ধিমান আপনারা, বুদ্ধি করে বছরের একটি বারের দুর্গাপূজাকে নাইবা মাটি করলেন। যে মা দুর্গার অপেক্ষায় আমরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি, সেখানে আমাদের কুশিক্ষার দম্ভ আর বিকৃত শিল্পনীতির নিদর্শন নাই বা রাখলেন। ভুলে যাবেন না আমরা মা দুর্গতিনাশিনীর সন্তান।
সুতপা বসাক ভড়
2019-08-30