বিগত কয়েক দশকের সবচেয়ে ঐতিহাসিক জয় তিন তালাক বিরোধী বিল পাশ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মধ্যযুগীয় বর্বরতার হাত থেকে মুক্তি পেতে চলেছেন। মুসলমান মা-বোনেরা। এই জয় শুধু তাদের নয়, এই জয় হলো আধুনিক সভ্যতার। আমরা এখন সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যখন ইসরোর পাঠানো চন্দ্রযান-২ চাঁদে পাড়ি দিচ্ছে, তাই এই জয় শুধু যে সময়ের অপেক্ষা ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও যদি ধর্মের বেড়াজালের অজুহাত দিয়ে মেয়েদের যদি প্রতি পদক্ষেপে সমঝোতায় চলতে হয় তাহলে বলা যায় আমরা নামেই কেবল স্বাধীন—ভেতরটা চরম কট্টর শুধু তাই নয়, অন্ধকারে ভরা যেখানে। আলোর লেশ মাত্র নেই। এই চরম আধুনিকতার আলোর ঝলকানিতে শায়রা বানো, ইসরত জাহানের কথা যাদের ভেতরের সুপ্ত মানবসত্তাকে জাগরিত করে এই জয় তাদের।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আইনের তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি ব্যাখ্যা করার জন্য আলোকপাত করতেই হয় ভারতীয় সংবিধানের প্রতি। সেখানে উল্লেখিত Article-14-এ সুস্পষ্টভাবে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু মুশকিল হলো ইসলামিক বৈবাহিক ব্যবস্থায় নারীর স্বাভিমান ও অধিকার কোনোটারই স্থান। নেই। সেখানে পুরুষরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন এবং নারীকে সেখানে বিচার করা হয় ভোগ্যপণ্যের মতো। এখানেই শুধু এই অন্ধ ধর্মীয় গোঁড়ামি থেমে থাকেনি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী পুরুষেরা যেমন অগণিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হতে পারে, ঠিক তেমনই অগণিত বিবাহ বিচ্ছেদও করতে পারেন। এটিই নাকি তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখিত ধর্মীয় উপদেশ! তবে সান্ত্বনা পুরস্কারবশত তারা বিবাহের সময় নারীর অনুমতি নেয় বা বলা যায় সামান্য করুণা করে কিন্তু বিচ্ছেদের সময় সেই চিরাচরিত অভ্যাসে বলীয়ান হয়ে পুরুষ তার পেশি প্রদর্শন করেন। এই Whatsapp, facebook, E-mail-972654 শুধুমাত্র একটা mail করে বা খুব বেশি একটা ফোন করে তার সমস্ত দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে অব্যহতি চেয়ে তালাক দিয়ে দেয় সেই নারীকে যে একদিন তার ঘরণি ছিল। তারপর সেই পুরুষ আবার মেতে ওঠেন পরবর্তী বৈবাহিক লীলায়। কারণ ধর্মীয় গ্রন্থের নির্দেশ তো সে মানতে বাধ্য! আর সেই সদ্য তালাক পাওয়া অসহায় নারীটি চার-পাঁচটি সন্তান-সহ নিক্ষিপ্ত হয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। স্থান, সময়, প্রেক্ষাপট হয়তো পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এই বৈবাহিক চক্রে কোনও ছেদ পড়েনি। নারীকে তারা ‘উর্বর কর্ণযোগ্য চাষের জমি ছাড়া আর কিছু ভাবে না। তাই ধর্মের অছিলায় এই নারীকে তারা বারবার ব্যবহার করবে এবং স্বার্থ মিটলে ছুঁড়ে ফেলবে।
বিশ্বের প্রায় ২২টি দেশ, যার মধ্যে ইসলামিক দেশ বলে পরিচিত কয়েকটি দেশ কুয়েত ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব আইন পাশ করে তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে ভারতেরই এই পদক্ষেপ নিতে বেগ পেতে হলো। যেখানে কোটি কোটি মুসলমান মহিলা এই আইনের দ্বারা উপকৃত হবে সেখানে এই চিন্তাভাবনা আরও আগে থেকে করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন যারা বিরোধীর আসন আলোকিত করে বসে আছেন, তাদের ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির সৌজন্যেই ভারতীয় সমাজ আজ আরও বিশ বছর পিছিয়ে গেছে। কংগ্রেস দলটি প্রায় নিজেরাই দায়িত্ব নিয়েছিল এই বিল খারিজ করে দেওয়ার। ওসব এখন অতীত, তারা এখন গ্যালারির দর্শক। বর্তমান ভারত সরকারের এই সদর্থক ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। লোকসভার পর রাজ্যসভাতেও ভোটে এই বিল পাশ হলো। অসহায়, সম্বলহীন, রিক্ত, তালাকপ্রাপ্ত মহিলাটির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকটি সেইসব মোল্লা মৌলবিদের চোখে পড়েনি, যারা শুধুমাত্র ধর্মের ধ্বজা হাতে নিয়ে পুরোদস্তুর আইন বিরোধী কাজটি করে যাচ্ছেন। ইসরত জাহান, শায়রা বানো তো শুধু এক-দুটি উদাহরণ। ঘরে-ঘরে এরকম লক্ষ লক্ষ ইসরত খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সমাজ ও লৌকিকতার ভয়ে তাদের জনসমক্ষে আসা হয়ে ওঠে না।
আধুনিক, শিক্ষিত, উন্নত চিন্তার অধিকারী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমান সমাজ সাদরে এই তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আইনকে গ্রহণ করেছেন। গ্রহণ করেছেন এই কারণে তাদের চোখে ধর্মের কালো টুলি পরানো নেই, তাঁরা স্বীকার করেন সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা। নারী জগৎশক্তির আধার, তাই যোগ্য সম্মান। তাদের দিতেই হবে, এই ধারনায় তাঁরা বিশ্বাসী। সতীদাহ প্রথা রদ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ এবং বর্তমানে মুসলমান মহিলাদের এই বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য তিন তালাক বিরোধী আইন– ভারত ভূখণ্ডে যতবার নারীদের উপর কদর্য আঘাত আঘাত নেমে আসবে তার সমাধানও অবশ্যম্ভাবী।
পুরুষ যতই তার পেশির আস্ফালন দেখান তার স্থানও কিন্তু একদিন সেই মাতৃগর্ভই ছিল— এই নিগুঢ় বাস্তব সত্যটি, মোল্লা-মৌলবিরা উপেক্ষা করলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না। ঐতিহাসিক এই জয়ের খবর মুসলমান মহিলাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা, আত্মনির্ভরতা তৈরি হয়েছে। এই জয়ের কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কৃতজ্ঞতা জানাতে তারা ভোলেননি। কোটি কোটি মুসলমান মা-বোনের কথা যে তিনি ভোলেননি, শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করাই যে তাঁর উদ্দেশ্য নয় মোদী আবার তা আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণ করলেন।
রণিতা সরকার
2019-08-30