চীন পাকিস্তানের ভারত বিরোধী দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া

স্কুলের বদমায়েশ ছেলের মতো চীনেরও আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ বন্ধুবান্ধব নেই। পূর্বতন প্রজারাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার (চীনের) ওপর আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে sanction চাপানোর পর কেবলমাত্র একটি ক্রমশ ধসে পড়া, দেনায় জর্জরিত পাকিস্তানই তার মিত্র হিসেবে টিকে আছে। যদিও দু’জনেরই অন্য দেশের ভূমি অধিকার করে নেওয়ার আগ্রাসী বাসনা ছাড়া কোনো মিল আদৌ নেই। চীন নিজের দেশে উইঘুর মুসলমানদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালালেও পাকিস্তান মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিবাদের বদলে। চীনের পাশে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বৈরতান্ত্রিক দেশ চীন ও জিহাদি সন্ত্রাসবাদীদের লালন পালন করার জন্য সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত দেশ পাকিস্তানের এই সুবিধাবাদী বোঝাপড়ার মূলে রয়েছে ভারতকে যে কোনো ভাবে দাবিয়ে রাখার প্রয়াস।
অতি সম্প্রতি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চীন নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর নিয়ে একটা ঘরোয়া আলোচনা চালানোর পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে কোনো যৌথ বিবৃতির বদলে নিজেরাই মনমতো কিছু ঘোষণা করে দেয়। কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে আনার পাকিস্তানের মরিয়া চেষ্টাকে সাহায্য করতেই চীনের এই অপপ্রয়াস তা কিন্তু কারোরই বুঝতে বাকি নেই। খেয়াল রাখা দরকার পূর্বর্তন কাশ্মীর রাজ্যের অধীনস্থ ভূমির এক পঞ্চমাংশ। এখন চীনের কবজায়। এছাড়া ১৯৬২-র আগ্রাসনের পর ভারতের সিয়াচীন অঞ্চলের ভূখণ্ডও তারা নিজেদের অধিকারে রেখেছে। পাকিস্তানও তাদের কারাকোরাম অঞ্চল ঘিরে বিস্তৃর্ণ অঞ্চল ভয়ে চীনকে দিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের এই আচরণ প্রমাণ করেছে জম্মু-কাশ্মীরকে ঘিরে যেখানে ভারত, পাকিস্তান, চীন, তিব্বত, আফগানিস্তানের সীমানাগুলি বিভিন্নভাবে মিলিত হয়েছে সেগুলির ওপর অধিকার কায়েম রাখতেই চীন-পাকিস্তানের সখ্য আরও মজবুত করা হলো। ১৯৭৮ সালে খুলে দেওয়া পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে চীনের তৈরি কারাকোরাম হাইওয়ে এই মিলনের আরও একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই রাস্তা পাক অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের গিলগিট-বাল্টিস্থান হয়ে চীনে গেছে। এটিই চীন-পাক অর্থনৈতিক করিডর। পাক অধিকৃত জম্মু কাশ্মীর অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন রাখার পরও ওই অঞ্চলে চালানো নিজেদের প্রকল্পগুলিকে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে তারা আরও সামরিক প্রস্তুতি বাড়াচ্ছে। বস্তুত চীনের এই অর্থনৈতিক করিডোর পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছবার একটি ল্যান্ড করিডর ছাড়া কিছু। নয়। ইরানে ভারতের যৌথ উদ্যোগে চলা ‘ছবর বন্দরের’ খুবই কাছে একটি সামরিক বন্দর তৈরির কৌশল করছে চীন যার প্রমাণ। হিসেবে করাচীতে তারা ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই কাজকর্ম সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ। করে ধীরে কিন্তু নিশ্চতভাবেই চীন পাকিস্তানকে নিজের উপনিবেশিক অঞ্চলে। পরিণত করছে যাতে ভারতকে দাবিয়ে রাখা যায়। খেয়াল রাখবেন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পুলওয়ামায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর কিছু জওয়ানের হত্যার পর আন্তর্জাতিক স্তরে এই হত্যার পেছনে প্রকাশ্য মদতকে ধিক্কার দিয়ে যখন সন্ত্রাসবাদীদের দমন করতে কড়া ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ আসছিল তখনও চীন তাদের পাশেই দাঁড়ায়। দশ বছর ধরে চীন লাগাতার পাকিস্তানে বসবাসকারী সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজাহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। যখন আর কিছুতেই এই জঘন্য সন্ত্রাসীর পক্ষ অবলম্বন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে তখনই থামতে বাধ্য হয়। আজও চীন আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার সদস্য হিসেবে ভারতের যোগদানে তীব্র আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। তাদের আবদার হলো সন্ত্রাসীদের আঁতুড়ঘর পাকিস্তানকেও এই সদস্যপদ দিতে হবে।
বাস্তবে চীন দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিরুদ্ধে এই কাশ্মীরকার্ড খেলে চলেছে। ২০১০ সাল থেকে চীন হঠাৎ জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের চীন যাওয়ার ক্ষেত্রে Stapled Visa দেওয়া শুরু করে। অন্যদিকে ভারতের জম্মু-কাশ্মীরকে বিবাদিত অঞ্চল দাবি করে নর্দার্ন কমান্ডের অধিকর্তাকে তারা ভিসা দিতে অস্বীকার করে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করার সূত্রেই তার সফরের আয়োজন করা হয়েছিল। সরকারিভাবেও। চীন ভারতের সঙ্গে চিহ্নিত সীমানা নিজের অধিকারে থাকা জম্মু-কাশ্মীরের অংশ (পাকিস্তান চীনকে দিয়ে দিয়েছে অধিকৃত অঞ্চল থেকে) বাড়িয়ে নিয়েছে। এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পূর্বর্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ একবার বলেছিলেন ভারতের দুর্বল অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীরের ওপর চীনের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে।
বাস্তবে জম্মু-কাশ্মীর তিনটি বিভিন্ন দেশের সীমান্ত লাগোয়া হলেও একমাত্র ভারতই তার অংশে থাকা কাশ্মীরে বিশেষ সুবিধে দেওয়া, আঞ্চলিক সরকারের ওপর বাড়তি ক্ষমতা, সুযোগ নেওয়া বলবৎ রেখেছিল। কিন্তু ভারত যদি জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার সাংবিধানিক ব্যবস্থা খারিজ নাও করত তাতেও চীনের পাকিস্তানের দু’দিক দিয়ে ভারতকে ঘিরে ধরার কৌশলে কোনো খামতি পড়ত না। ভারতকে নজরবন্দি করে রাখার সুবিধের জন্যই চীন ভারতে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ছায়াযুদ্ধ চালানোকে মদত দেয়। নিজের দেশে চীন ১০ লক্ষেরও বেশি মুসলমানকে মগজধোলাই করে তাদের মাথা থেকে জেহাদি সন্ত্রাসের ভাবনা দূরীকরণে ব্যস্ত। রয়েছে। বস্তুত চীনও পাকিস্তানের ছকেই ভারতের সঙ্গে একটি চাপা যুদ্ধের আবহ তৈরি করে রেখেছে। লাদাক ও অন্যান্য অঞ্চলে নীরবে ভূখণ্ড দখল করে রাখা তারই প্রমাণ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে সরকার সেখানে চীনের এই আগ্রাসী পরিকল্পনার, বেআইনি সীমানা লঙ্ঘনের মোকাবিলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পথ সুগম করল। একইভাবে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সংবিধানের উপযুক্ত সংশোধন এনে উপত্যকাকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সীমানা বিরোধের নতুন সমাধানের চেষ্টাও শুর হতে পারে। জম্মু-কাশ্মীরের দু’দিক দিয়েই ভারতকে চীনের সম্মুখীন হতে হয়। একটি লাদাখ অঞ্চলে, অন্যটি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে তাদের সেনার উপস্থিতির কারণে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে একটা বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। তা হলো, সজাগ থাকা আর গুটিয়ে থাকা। বোঝা খুবই সহজ যে প্রথমটি অবলম্বন করলে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা বা তাকে এড়ানো যাবে। আর দ্বিতীয় অবস্থানটি আরও নতুন সমস্যাকে ডেকে আনবে। দেশের ওপর অন্যান্য চাপ সৃষ্টিহবে। চীন কিন্তু নির্লজ্জের মতো জম্মু-কাশ্মীরে ভারতের তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সোচ্চার। সদা ভারতকে একপক্ষীয় অবস্থান নেওয়ায়। অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক স্তরে দুর্নাম করার লাগাতার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে ভারত দীর্ঘযুগ ধরে চলা তিব্বতের বাসিন্দাদের ওপর চীনের অত্যাচার সম্পর্কে নীরব। নীরব জিনজিয়াং প্রদেশে ঘেটো তৈরি করে মুসলমানদের ওপর নৃশংস নির্যাতনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা সম্পর্কে বা সদ্য ঘটে চলা হংকং-এর মানবাধিকার ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়ার চীনের কীর্তির প্রচারে। ভারত যেহেতু আন্তর্জাতিক স্তরে চীন যে আসলে ভারতেরই অন্তর্গত জম্মু-কাশ্মীরের পাক অধিকৃত অঞ্চল বেআইনিভাবে দখল করে আছে এই বিষয় উত্থাপনে নিতান্তই উদাসীন, তারই ফলশ্রুতিতে কাশ্মীর সমস্যার ক্ষেত্রে চীন নিরপেক্ষতার ছলনা করে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারাও কিন্তু এই বিতর্কিত অঞ্চলের অন্যতম খেলোয়াড়। ভারতনিদেন পক্ষে চিনের পরোক্ষ সমালোচনাতেও অনীহা দেখিয়েছে। অন্তত আমাদের তো এটা বলা উচিত যে কঁচের ঘরে বসে অন্যকে ঢিল ছোঁড়া উচিত নয়। এর থেকেও মর্মান্তিক হচ্ছে বিগত ক’বছরে ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন তার অংশীদারী দ্বিগুণ করে ফেলেছে। তাদের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিই ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে ভারতের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা খরচকে ছাড়িয়ে গেছে। এর মাধ্যমে একটা জিনিসই পরিষ্কার গাছেরও খাব তলারও কুড়বো। ভারতকে কিন্তু তার সঠিক রাস্তা খুঁজে নিতেই হবে। অন্যথায় এই আগুন ওগরানো ড্রাগন আরও ভয়ংকর কোনো মতলব করতে জোর পেয়ে যাবে।
ব্রহ্ম চেলানি
(লেখক বিশিষ্ট সংবাদ ভাষ্যকার)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.