আমরা জানি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কামারপুকুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন কলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। কিন্তু যিনি ঈশ্বর তাঁর কী জন্ম আছে, না কি মৃত্যু? ঈশ্বর যিনি, তিনি জন্মরহিত, তিনি অবিনশ্বর, তিনি অব্যক্ত, নির্বিশেষ, নির্বিকার। ঈশ্বর যখন সাকাররূপ ধারণ করে আসেন এবং ব্যক্তস্বরূপে লীলাবেশ ধারণ করেন, তখন তিনি অবতারূপে গণ্য হন। রামরূপে তিনি ‘বারোয়ানা’ এবং কৃষ্ণরূপে তিনি ‘ষোলোয়ানা অবতার’। অবতাররূপে যখন তিনি ‘সর্ব অবতারী’, তখনই তিনি ‘অবতার-বরিষ্ঠ’। শ্রীরামকৃষ্ণ কী এমনই একজন নরদেহী? তাহলে প্রশ্ন আসবে অবতার কাকে বলে?
গীতার জ্ঞানযোগের ষষ্ঠশ্লোকে আছে “অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপিসন্।/প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।” আমি জন্মরহিত, আমার চিন্ময় দেহ যদিও অব্যয়; যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর; তবুও আদি চিন্ময়রূপে আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করি এবং যুগে যুগে আবির্ভূত হই। ঈশ্বরের এই আবির্ভূত সত্তাই হলেন অবতার। তিনি ‘কর্মহীন’, অর্থাৎ কর্মফলের জন্য তাঁকে ধরাধামে আসতে হয়েছে, তা নয়। তিনি কৃপা করেই আসেন, মানব কল্যাণের জন্যই আসেন এবং মানুষের দেহ ও মন নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। কোনো মায়াডোর তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে না বলেই তিনি ‘মায়াধিপতি’। পুণ্যাত্মা সাধক আর অবতার অভিন্ন পদবাচ্য নয়।
এখন শ্রীরামকৃষ্ণ কেন অবতার? কারণ তাঁর মধ্যে ত্যাগের অপরিসীম শক্তি তীব্র প্রখরতায় বিচ্ছুরিত হয়েছিল। তাঁর মধ্যে মৃত্যুতুল্য সমাধিস্থ থাকার অসামান্য ক্ষমতা ছিল। ছিল স্পর্শ দ্বারা অন্যকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে জারিত ও সঞ্জীবিত করার অলৌকিক ক্ষমতা। সতত দেবত্বের উপলব্ধি ছিল। ছিল সাধন-শিখরের চূড়ার পৌঁছানোর নজির। যুগের বিশেষ প্রয়োজনে তাঁর মত্যে আসা। একজন কেতাবী-বিদ্যাবুদ্ধি-রহিত গ্রাম্যযুবক কী করে লাভ করেছিলেন শাস্ত্রবিচারের অনন্য জ্ঞানভাণ্ডার? কী করে অনন্ত-অমৃতলোকের চাবিকাঠি তাঁর দুই কাঁধে রাখা বিবেক-বৈরাগ্যের ঝোলায় নিত্যই ঝুলিয়ে রাখতেন?
ভৈরবী ব্রাহ্মণী দক্ষিণেশ্বরের ভরা নাটমঞ্চে প্রথিতযশা পণ্ডিতদের মাঝখানে যেদিন নানান প্রমাণসহ তাঁর অবতারত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেদিনও কী সমকাল বুঝেছিল তাঁর সংজ্ঞা স্বরূপ বৈশিষ্ট্য? দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝলেন তখনই যেদিন তিনি নিজে আত্মপ্রকাশ করে অভয়দান করলেন। যেদিন অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু হয়ে, পতিতপাবন রূপে নিজেকে শীতের এক বিকেলে অনাবৃত করলেন। ভক্তরা আরও আরও দেখতে চান অবতারের রূপমাধুরী। “মনে হয় অঙ্গবাস সব দিয়া খুলি।/নয়ন ভরিয়া দেখি রূপের পুতুলি।” সেটা ১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি। কলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। যেদিন তিনি অন্তরঙ্গ-পার্ষদ ও ভক্তমণ্ডলীর কাছে নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন।
কল্পতরু-লীলা বর্ণনা নানান গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন স্বামী সারদানন্দ রচিত ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এ, কবি অক্ষয়কুমার সেন বিরচিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’-তে, শ্রীম কথিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ। প্রস্তুত নিবন্ধে স্বামী অভেদানন্দ রচিত ‘আমার জীবনকথা’ গ্রন্থের বিবরণ কিয়দংশ উদ্ধৃত করা হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন গলায় দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত। সেদিন অফিস ছুটির দিন। বিকেলে বাগানবাটিতে এসেছেন গিরিশ ঘোষ সহ গৃহস্থ ভক্তরা। সেবক-পার্ষদরাও রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এদিন কিছুটা সুস্থ অনুভব করে দোতালা থেকে নীচে নেমে বাগানে হাঁটছেন। এরই মধ্যে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে কথা হল। ঐশী সংলাপে ঠাকুর বাহ্যজ্ঞানশূণ্য হলেন। ভাবাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। সংজ্ঞালাভ করে সবাইকে আশীর্বাণী দিলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক্’। সকলকে স্পর্শ করলেন, তাদের অধ্যাত্ম-আঁখি খুলে দিলেন, সকলের সকল প্রার্থনা পূরণ করলেন। “ভাই ভূপতি সমাধি প্রার্থনা করিয়াছিল। তাহাকে শ্রীশ্রীঠাকুর কৃপা করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তোর সমাধি হবে’। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত গরীব অবস্থায় অর্থাভাবে কষ্ট পাইতেছিলেন বলিয়া অর্থ প্রার্থনা করিয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাহাকে কৃপা করিয়া বলিলেন, ‘তোর অর্থ হবে।’ রামলালদাদা, বৈকুন্ঠ সান্যাল প্রভৃতি গৃহস্থ-ভক্তদিগকে তাহাদের যাহা যাহা প্রার্থনা ছিল, তাহা তিনি আশ্বাস দিয়া ‘পূর্ণ হবে’ বলিয়া কৃপা করিলেন।”
এখন হিন্দুসমাজের কাছে কল্পতরু উৎসব কেন তাৎপর্যপূর্ণ? কারণ এটি খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম দিবস, বড়দিন থেকে শুরু হওয়া উইন্টার ফেস্টিভ্যাল এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। বর্ষবরণের দিন। আর প্রথম দিনেই কলোনিয়াল ফেস্টিভ্যাল বোল্ড আউট হয়ে গেল হিন্দুয়ানীর পবিত্র ছোঁয়ায়। রক্তপাতহীন নীরব এক আধ্যাত্মিক যুদ্ধ। এরই নাম স্পিরিচুয়াল রেভোলিউশন। এটা যে কত বড় জয়, তা যতই সময় পেরোবে, ততই অনুভূত হবে।
কল্যাণ চক্রবর্তী ।