স্বাধীনতা সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ

স্বাধীন ভারতে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের দৌলতে জনমানসে গেঁথে গেছে যে স্বাধীনতা আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কোন ভূমিকা নেই। এই মিথ্যা প্রচার করার পেছেনে একটা মানসিক অসুখ আছে। এই শ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যে বাস্তুতন্ত্র তৈরী করেছেন তাতে ভারত কেন্দ্রীক চিন্তা, ভারতীয় গৌরব বা ভারতীয়ত্বের উপর নীতিনিষ্ঠ সংগঠনের বিশেষ স্থান নেই। নিজের মতকে প্রকাশ করার জন্য যে অপরকে ছোট করার প্রয়োজন হয়না এটা ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছরের সাধনা। আর এই ঔদার্য থেকে দূরে যাওয়ার ফলেই এই বিচ্যুতি।  স্ট্যালিনের জামানার রাশিয়ার বৌদ্ধিক জগতের প্রভাব বাংলা তথা ভারতের সারস্বত জগতকে গ্রাস করেছিল বহুদিন। ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের সময় টৎস্কি ছিলেন লেনিনের ঘনিষ্ঠতম সঙ্গী। জন রীডের “দুনিয়া কাঁপানো দশদিন” বইয়ের প্রতি ছত্রে তার বর্ণনা। সেই টৎস্কিকে স্ট্যালিন হত্যা করালেন। লেনিনের পাশে টৎস্কির ছবি সরিয়ে ডাস্টবিন রাখা হল। সমগ্র রাশিয়া জুড়ে নিষিদ্ধ হয়ে গেল জন রীডের বই।  এই অসহিষ্ণুতা এদেশের পত্র পত্রিকা, ইতিহাস চর্চা, ঘটনা বর্ননা,  আখ্যান  তৈরীতে ছেয়ে গেল। প্রগতিশীলতার সংজ্ঞা নির্মাণ হল। মহাত্মা গান্ধী,  সুভাষ চন্দ্র বসুর মতের ভিন্নতা থাকলেও, তিনজন মনীষীর অবদানই  সমান সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা যায়, সেই ভাবনাটাই চলে গেল। এই কূপমন্ডুকতা অনেক ক্ষেত্রে শিষ্যপরম্পরায় প্রবাহিত হতে লাগল।

নেহেরু জামানায় সংবাদপত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান,  ইতিহাসের বিভিন্ন  বিভাগে ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদীদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার একটি অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন যে পন্ডিত নেহেরু নিজের দলের অন্য কারোকেই যথার্থ পন্ডিত মনে করতেন না! যাইহোক এই পর্যায়ে দুটি কাজ সুনিপুণভাবে হয়েছে। প্রথমতঃ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে ভুলিয়ে দেওয়া আর দ্বিতীয় কাজটা হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মত একটি নিপাট দেশভক্ত সংগঠনের চেহারাটাই জনমানসে বদলে দেওয়া।

এই ভাবনার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা একটি কথা মনের গভীর থেকে বিশ্বাস করেন। যদি কোন মিথ্যা জোরের সঙ্গে, বারবার বলা যায় তবে ধীরে ধীরে জনমানসে সেটি একটা জায়গা করে নেয়। তাই প্রাথমিক ভাবে বেশ কিছুটা সাফল্য তাঁরা পেয়েওছেন। তাই আর এস এস নাম শুনলেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা অস্পৃশ্যতার মানসিকতা কাজ করে। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ একেবারে উলটো কথা বলেছিলেন, চালাকি করে কিছু মানুষকে চিরকালের জন্য বোকা বানানো যায় বা সকলকে সামান্য কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো সম্ভব, কিন্তু সকলকে চিরকালের জন্য বোকা বানানো যায় না। 

ঠিক সেটাই হয়েছে। আজকের পৃথিবী কেবল কোন একটা মতাদর্শে দীক্ষিতদের মৌরসীপাট্টা নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শুরু থেকে আজ অবধি কাজকর্ম আজ সকলে দেখতে পারেন। 

সংঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসেছিলেন।  কিন্তু ডাক্তারি পড়াটা ছিল তাঁর ছুঁতো। কলকাতা তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের জ্বলন্ত হোমকুণ্ড।  সেই আগুনে নিজেকে গড়েপিটে তিনি নিজেকে ইস্পাত বানাতে চেয়েছিলেন।  তিনি বিপ্লবী পুলিন বিহারি দাসের অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদশ্য ছিলেন ডাক্তার হেডগেওয়ার। যুগান্তর সমিতিতেও ছিল তার অনায়াস যাতায়াত।  শ্রীঅববিন্দের সানিধ্য, বারীন ঘোষের বন্ধুত্ব আর বিপ্লবী ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তীর আমৃত্যু সহযোগিতা পেয়েছিলেন।  সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বাংলা থেকে মধ্যভারতে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন ডাক্তার হেডগেওয়ার।  ১৯১৫ সালের ব্রিটিশ সেনা ছাউনিগুলিতে আন্দোলন সংগঠিত করার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিতে তাঁর বিপ্লবী জগতে নাম ছিল ‘কোকেন’।

আচার্য শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর “স্বামী বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ ” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, দামোদরে বন্যায় ডাঃ হেডগেওয়ার দিনরাত এক করে রামকৃষ্ণ মিশনের সেবা কাজে যোগদান করেছিলেন। ১৯২৫ সালে ডাক্তার হেডগেওয়ার যখন নাগপুরে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা হয় তার প্রতি ছত্রে অনুশীলন সমিতি আর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাপ ছিলো।  এটি রাজনৈতিক নয় সামাজিক সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো।  কেন? কারণটাও স্পষ্ট। 

স্বামীজী বলেছিলেন,  “হে ভারত,এই পরানুবাদ,পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা,এই দাস সুলভ দুর্বলতা এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?……।এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে”। তাই মানুষ তৈরির কাজকেই সঙ্ঘ ব্রতরূপে গ্রহণ করেছিল। ডাক্তার হেডগেওয়ার স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পরেও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে তিনি সত্যাগ্রহ করেছেন, কারাবরনও করেছেন। কিন্তু সেইসময়ে সঙ্ঘের দায়িত্ব অন্য কোন যোগ্য ব্যক্তিকে দিয়ে এসেছিলেন। ১৯৩০ সালে লবন সত্যাগ্রহের সময় মধ্যভারতে জঙ্গল আইন ভেঙে জঙ্গল সত্যাগ্রহ করা হয়েছিল। হেডগেওয়ার তাঁর সরসঙ্ঘচালকের দায়িত্ব ডা. পরাঞ্জপকে দিয়ে বহু স্বয়ংসেবককে সঙ্গে নিয়ে সতাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন। সেইবার আপ্পাজী যোশী, দাদারাও পরমার্থের মত ১২জন শীর্ষ সঙ্ঘনেতৃত্বের সঙ্গে ডাক্তারজীরও ৯ মাসের জেল হয়েছিল। 

১৯৩১ সাল, বিজয়া দশমী, সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা দিবস। ডাক্তার হেডগেওয়ার তখন জেলে। শাখায় শাখায় পাঠ করা হল, “দেশের পরাধীনতার সমাপ্তি মারফৎ যত দিন না সমাজ আত্মশক্তিতে বলিয়ান না হয়ে উঠছে, ততদিন হে বৎস তোমার নিজের সুখের অধিকার নাই”। 

সঙ্ঘ সামাজিক সংগঠন হিসাবে কাজ করলেও, স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহসীকতার কাজে স্বয়ংসেবকদের সর্বদা যোগদান ছিল। ১৯২৮ সালে লাহোরে লালা লাজপত রাওয়ের হত্যার খলনায়ক  সান্ডার্সকে হত্যা করেন রাজগুরু। লাহোর থেকে ফিরিয়ে এনে উমরডে ভাইয়াজী দানীর বাগানবাড়িতে তাঁকে রাখার ব্যবস্থা করেন হেডগেওয়ার। এই ভাইয়াজী দানী  পরে সঙ্ঘের সরকার্যবাহ, মানে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। 

১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে প্রথমবার পূর্ণস্বরাজের কথা ঘোষনা করা হয়। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারী বিকেল ৬টায় সঙ্ঘের সব শাখায় জাতীয় পতাকা তোলা হয়।

১৯৩২ সালে বুড়িবালামের যুদ্ধে বাঘাযতীনদের পরাজয় ও আত্মবলিদানের পরে সারা ভারতে ব্যাপক ধরপাকড় হয়। গ্রেপ্তার হন বালাজী হুদ্দা। হুদ্দা তখন সঙ্ঘের সরকার্যবাহ।

১৯৪২ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সবচেয়ে বেশী স্বয়ংসেবকের প্রান যায়। বিদর্ভের অষ্টী চিমূর অঞ্চলে ১২ জন স্বয়ংসেবক আত্মবলিদান করেন। 

মিরাট জেলায় মওয়ানা মহকুমায় পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ গুলি চালায়। 

সঙ্ঘ সেযুগে বিপ্লবীদের বুকে আগলে রক্ষা করেছিলো।  দিল্লির  সঙ্ঘচালক বা সভাপতি ছিলেন লালা হংসরাজ গুপ্ত। তাঁর বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন অরুণা আসফ আলি আর জয়প্রকাশ নারায়ণ। পূণার সঙ্ঘচালক ভাউসাহেব দেশমূখের বাড়িতে ছিলেন অচ্যুত পট্টবর্ধন আর সানে গুরুজী। “পতরী সরকার” তৈরী করেছিলেন যে নানাপাটিল, সেই নানা পাটিল সাতারা জেলার সঙ্ঘচালক ড. সাতওলেকরের আশ্রয়ে ছিলেন।

সঙ্ঘ সরাসরি রাজনৈতিক কাজে অংশ নিত না। কিন্তু কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী,  হিন্দু মহাসভার বীর সাভারকার বা নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের মত দেশনেতার সঙ্গে একান্ত শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। নেতাজী ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তীকে ডাক্তার হেডগেওয়ারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তারজীর কাছে রামভাও রুইকরকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতেও গিয়েছিলেন। 

ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টের বহুবার লেখা হয়েছে, মুখে সামাজিক সংগঠন বললেও সঙ্ঘ আসলে স্বদেশী আন্দোলনের কাজ করছে। ১৯৪৩ সালের একটি রিপোর্টে সঙ্ঘের শিক্ষাবর্গের বর্ণনাতে সরসঙ্ঘচালক গুরুজী গোলওয়ালকারের ভাষন উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, “স্বয়ংসেবকরা শিক্ষাশিবিরে সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এসেছেন, শীঘ্রই বিদেশীদের সঙ্গে শক্তির পরীক্ষা হবে”। 

১২ অক্টোবর ১৯৪৩ জব্বলপুরে গুরুদক্ষিণা উৎসবে দেওয়া  বাবাসাহেব আপ্তের বক্তব্য উঠে এসেছে গোয়েন্দা রিপোর্টে,  ” ইংরেজদের অত্যাচার অসহনীয়,  দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিৎ। “

মহাত্মা গান্ধীর ভারতকেন্দ্রীক সর্বোদয়ের ভাবনাকে সঙ্ঘ সর্বদা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছে। ১৯২২ সালে গান্ধীজির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ড. হেডগেওয়ার তাঁকে “পূজনীয় পুরুষ ” বলে সম্বোধন করেছিলেন। 

১৯৩৪ সালে সঙ্ঘের একটি বড় শিবির চলছিল নাগপুরের পাশেই ওয়ার্ধায়। গান্ধীজি গিয়েছিলেন সেই শিবির দেখতে। ঠিক সেইসময় ড. হেডগেওয়ার ছিলেন না শিবিরে। ফিরে এসে যখন শুনলেন তখন তিনি গিয়ে দেখা করে এলেন বাপুর সঙ্গে। 

স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লির ভাঙ্গিকলোনির মাঠে আর এস এস এর প্রায় ৫০০ জন স্বয়ংসেবকের এক সমাবেশে গান্ধীজি বক্তব্য রাখলেন, ” আমি ওয়ার্ধাতে বহুদিন আগে আর এস এস এর একটি ক্যাম্পে গিয়েছিলাম।  তখন প্রতিষ্ঠাতা শ্রী হেডগেওয়ার জীবিত ছিলেন। শ্রী যমুনালাল বাজাজ আমাকে শিবির দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তাদের কঠোর অনুশাসন, অস্পৃশ্যতা মুক্ত ব্যবস্থা আর সরলতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।” ( কালেকটেড ওয়ার্কস অফ মহাত্মা গান্ধী, ভল্যুম ৮৯, পৃঃ ১৯৩-১৯৪)।

ড. জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.