কাশ্মীরি ক্লেদ মুক্ত করে স্বচ্ছ ভারতের পথে মোদী

১৮৯৮ সালের আগষ্ট মাসের এমনই একটি সময়, স্বামীজি কাশ্মীরের জাগ্রত দেবীস্থান ক্ষীরভবানীর মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে দেখলেন মন্দিরের নিদারুণ ভগ্নদশা। স্বামীজির মনে তীব্র ক্রোধ আর হতাশা জন্ম নিল, মনে মনে প্রবল বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন মন্দির ধ্বংসকারী মুসলমানদের উপর। “যবনেরা এসে তাঁর মন্দির ধ্বংস করে গেল, তবু এখানকার লোকগুলি কিছুই করল না। আমি যদি তখন থাকতাম, তবে কখনো চুপ করে সে-দৃশ্য দেখতে পারতাম না।” পরধর্মীদের আগ্রাসনে অন্য ধর্মীয় নেতার মনে যেমন ক্রোধের উদয় হয় তেমনই হল স্বামীজির মনেও। তারপরই শুনলেন সেই দৈববাণী, “আমার ইচ্ছা আমি ভাঙা মন্দিরে বাস করব। ইচ্ছা করলে আমি কি এখনই এখানে সাততলা সোনার মন্দির তুলতে পারি না? তুই কি করতে পারিস?” এরপরই তিনি মহাকালের উপরই ছেড়ে দিলেন সমস্ত দায়ভার, তুরীয় অবস্থায় তাঁর উপর মহাশক্তি যেন ভর করল। লিখলেন উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘Kali the Mother’, যার পরতে পরতে মহাকালীর তান্ডব, প্রগাঢ় মানসিক অভিভবে ধ্বংসলীলা।

এই কবিতাটি ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এক অন্যতম আবশ্যিক পাঠ্য হয়ে দাঁড়ানোর ফলে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের আর একটি নাম। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, যে নবজাগরণের ফলে বাঙ্গালি তথা ভারতবাসী সুপ্তিদশা থেকে জেগে উঠেছিলেন, তা আদতে ছিল হিন্দু নবজাগরণ, তার মধ্যে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিপিনচন্দ্র, অরবিন্দের মত মহান মনীষার কেউই বাকি ছিলেন না। এবং এটা ঐতিহাসিক কারণেই সম্ভব হয়েছিল; পাশ্চাত্য শিক্ষা পাবার উদগ্র বাসনায় ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রাণঢালা মিতালী করেছিল হিন্দুরা আর বিরোধিতার রাস্তায় হেঁটে তাদের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ভারতীয় মুসলমানরা। আর জাতীয় আন্দোলনে সামনে খৃষ্টান-ব্রিটিশ বিরোধিতা থাকলেও অন্তরে স্থান পেয়েছিল যাবতীয় বহির্দেশীয় অহিন্দুর বিরোধিতাই। তাই অনবধানেই ‘যবন’ শব্দের ব্যাপ্তি ঘটে গেল। স্বামীজির ‘Kali the Mother’ কবিতাটির মধ্যে ভাষা পেয়েছে তাঁর ভাব শিষ্যদের প্রতি এক শক্তি-সাধনার আহ্বান, যার ধারাপাত ক্ষীরভবানীর মন্দির প্রান্তরকেও লাঞ্ছনা মুক্ত করতে পারে, পারে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়ানো ছিটানো অনেকানেক দেবালয়ের লাঞ্ছনা মুক্তি। সে কাজ স্বামীজির একলার পক্ষে সম্ভব নয়; স্বামীজি তখন ক্লান্ত, অসুস্থ; সনাতনী ধর্মের প্রচার ও প্রসারে জীবনী-শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছেন তিনি। তাই কাব্যের মোড়কে স্পষ্টই বার্তা দিলেন আগামী প্রজন্মগুলির প্রতি। দীপ হাতে হাজির হলেন শ্রীঅরবিন্দ; লিখলেন ‘ভবানী-ভারতী’। ‘শ্যামা জননীর মহাপ্রসাদ’ শ্যামাপ্রসাদের বলিদান হল কাশ্মীরে। তারই ধারাবাহিকতায় স্বামীজির ১২০ বছর বাদে আর এক নরেন্দ্র-র হাতে সেই দীপাধার পৌঁছলো। অমিতবিক্রমে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিতর্কিত অস্থায়ী ধারা বিলোপ করে সেই কর্তব্যেরই অখন্ড ধারাবাহিকতা সারলেন।

জম্মু-কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও আইনি অধিকার খর্ব করে রাজ্যসভায় ও লোকসভায় প্রস্তাব পেশ করা হলে তা গৃহীত হয় । প্রস্তাবের পক্ষে বিজেপি ছাড়াও শিবসেনা, নবীন পট্টানায়কের বিজেডি, কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি, মায়াবতীর বিএসপি, এআইডিএমকে-র মত দল তা সমর্থন করে। আর ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধাচারণ করে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম, স্ট্যালিনের ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, নীতিশকুমারের জনতা দল ইউনাইটেড, তেলেগু দেশম পার্টি, শরদ পাওয়ারের এনসিপি, লালু প্রসাদের আরজেডি, মেহবুবা মুফতির পিডিপি, ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স সহ কিছু ছোটোখাটো দল। ৩৭০ এবং তার লেজুড় ৩৫ এ ধারা বিলোপের ফলে বিশেষ মর্যাদা হারায় জম্মু-কাশ্মীর। সেখানে বলবৎ হয় ভারতীয় দন্ডবিধি, পৃথক পতাকার বদলে ভারতের পতাকাই কেবল উড়বে সেখানে, দ্বৈত নাগরিকত্ব হারিয়ে কাশ্মীরীরা যথার্থ ভারতীয় নাগরিক হয়ে উঠবেন। বিধানসভার মেয়াদ ছয় বছরের বদলে অন্য সব রাজ্যের মতই পাঁচ বছর মেয়াদি হল। আগে অন্য রাজ্যের নাগরিক সেখানে জমি-বাড়ি কিনতে পারতেন না, এখন ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছে সে সুযোগ চলে এলো। চাকরি-শিক্ষায় অমুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ থাকবে, যা আগে ছিল না। কার্যকর ছিল না তথ্যের অধিকার আইন, এবার তা বলবৎ হবে। ৩৬০ (সাধারণ জরুরি অবস্থা), ৩৫৬ (অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা)- র মত ধারাগুলি আগে কাশ্মীরে কার্যকর হত না, এখন সারা দেশের সঙ্গে সে রাজ্যেও তা চালু হবে। অন্য রাজ্যের পুরুষকে বিবাহ করেও কাশ্মীরী রমণীরা নিজের রাজ্যের সব সাংবিধানিক অধিকারই লাভ করবেন। পাকিস্তানি পুরুষেরা কাশ্মীরের মহিলাকে বিবাহ করে আর কাশ্মীরের নাগরিক হতে পারবেন না।

সেই সঙ্গে অনুমোদিত হয় জম্মু-কাশ্মীর পুর্নগঠন বিল। ফলে রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে তা এক কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিগণিত হয়। রাজ্য ভেঙ্গে দু-ভাগ হল, হল দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল; তাদের প্রশাসনিক প্রধান হবেন পৃথক লেফটেন্যান্ট গভর্নর। তবে দুটি অঞ্চলের মধ্যে ফারাক তৈরি হয়। ‘জম্মু-কাশ্মীর’-এ আছে বিধানসভা, যেমন রয়েছে দিল্লি কিংবা পুদুচেরিতে। নতুন সৃষ্টি হওয়া অঞ্চল ‘লাদাখ’-এ নেই বিধানসভা, যেমন রয়েছে চণ্ডীগড় সহ অন্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে।

তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা নতুন ব্যবস্থায় সবচেয়ে লাভবান সাধারণ ও গরীব কাশ্মীরীরা। কারণ এতদিন দু একটি পারিবারিক দলের নেতাদের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল চলে আসছিল। মাত্রাতিরিক্ত কেন্দ্রীয় অনুদানের সকল কিছুই বিলিবন্টন হচ্ছিল তাদেরই ‘হাতযশ’-এ। এই টাকা কম নয়, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আসতো কেন্দ্রীয় অনুদান বাবদ। সাধারণ ভারতবাসী গড়ে বছরে যে পরিমাণ সরকারী আনুকূল্য পান, তার অন্তত চারগুণ যায় কাশ্মীরে। তবুও কাশ্মীর রাজ্য এত গরীব। কেন? কেন ছিল এত বেকারি, বে-রোজগারি? কেন তারা ‘সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থা-শিল্পে’ নিজেকে নিয়োজিত করে ভারতীয় সেনাকে পাথর ছুঁড়ে আর গুলি করে মারতো? কারণ ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে পর্যটন ব্যতিরেকে শিল্প তেমন ছিল না। শিল্প বিকাশ হবেই বা কেমন করে? শিল্প-উদ্যোগীরা এরাজ্যে জমি-জমা সহ ভূ-সম্পদ কিনতে পারতেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের নানান অংশের শিল্পপতি এখানে স্থায়ীভাবে থেকে শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সমর্থ্য হচ্ছেন। শিল্পের নব নব উদ্যোগে মিলছে রকমারি কর্মসংস্থান। তার বেশিরভাগটাই পাচ্ছেন স্থানীয় কাশ্মীরী যুব-সমাজ।
এতদিন শাসকদলের মৌরসীপাট্টায় যে শিল্প গড়ে উঠেছে, পণ্য উৎপাদন ও বিপণনও করেছেন, তারাই দাম নির্ধারণ করেছেন, যা ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি, গরীব কাশ্মীরীরা তা কিনতে বাধ্য হয়েছেন। আগে আর্থিক দুর্নীতি দমনে সিএজি-র মত সরকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করতে পারতো না। এখন তা সম্ভব, এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে উঠছে। সচেতন এবং তথ্যভিজ্ঞ মহল আরও মনে করেন, পাত্থরবাজ কাশ্মীরী যুবকদের টাকার যোগান প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ সে নিজেই একটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া-প্রাপ্ত দেশে পর্যবসিত হয়েছে। তার পক্ষে দশকের পর দশক পাকপন্থী কাশ্মীরী মুসলমান যুবকদের দৈনিক রাহা-খরচ মেটানো সম্ভব নয়। তবে সেই টাকার যোগান কোথা থেকে হচ্ছে? টাকা যোগানের বৃহদাংশ সম্ভব হচ্ছে কেবল ভারতীয় অনুদানের টাকায়, ঘুরপথে। আমার-আপনার করের টাকাই পরোক্ষভাবে পৌঁছে যাচ্ছিল অসাধু নেতা-কর্মী, সরকারী কর্মী ও রাজনৈতিক ধান্দাবাজ সহ উগ্রপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। এই রাজনৈতিক দলগুলি সারা ভারতকে ব্ল্যাকমেল করতো, ৩৭০ ধারার রক্ষাকবচের ধুয়ো তুলে। তারা ভারতবিরোধী শক্তির প্রতি নরম নীতি অনুসরণ করে তাদের পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিত। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে পরিচয় দিত বে-রোজগারির আন্দোলন হিসাবে, তাদের কাজকে লঘু করে দেখাত। কাশ্মীরবাসীর উপর অকারণ সেনা অভিযান ও নির্যাতন হচ্ছে, এই প্রচার সতত চালাত। পরোক্ষে জিগির দিত — এর চেয়ে বাড়াবাড়ি করলে কাশ্মীর স্বতন্ত্র দেশরূপে আত্মপ্রকাশ করবে, সারা বিশ্বের কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে তুলে ধরবে, সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর নির্যাতনকে দেখানো হবে। আর এতে যারপরনাই ভয় পেয়ে পূর্ববর্তী ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর নিয়ে টু শব্দটি করার সাহস পান নি।

অবশেষে সাহস দেখালেন নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইনিংসের এনডিএ সরকার। তিনি কেবল কাশ্মীরের ইতিহাস বদলই করলেন তা নয়, বদল করলেন তার ভূগোলও। এ এক অমিত-অভ্যুত্থান, অমিত-বিক্রম। অতীতের পর্বত-সম ভুলের পাহাড়কে সরিয়ে দিলেন মোদী, সঙ্গে পেলেন সাহসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গত। দীর্ঘদিন ধরে যে ঐতিহাসিক ভুল-যাপন করে আসছিল ভারত সরকার, তা থেকে দেশকে বের করে আনলেন মোদীর সরকার। দেশবাসীর এক অতি বৃহৎ অংশ বিশ্বাস করছেন, এই সিদ্ধান্ত দেশের একতা ও অখন্ডতা রক্ষার এক সাহসী পদক্ষেপ। সারা দেশ এই সিদ্ধান্তের শরিক হয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ার বাজার, ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে জোট রাজনীতিতে। এটা যে বিজেপি সরকারের একটা মাস্টার স্ট্রোক তা বুঝেই সুর চড়িয়েছে কংগ্রেস সহ নানান বিরোধী দলগুলি। এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে জম্মু-কাশ্মীরের আঞ্চলিক দল, জনগণের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলে পরিণত বামসহ অন্য আঞ্চলিক দলগুলি। নাশকতার ঘটনা সঠিকভাবে উৎখাত করার চেষ্টায় খামতি দেখালে জনগণ তার সমুচিত জবার দেবার জন্য তৈরি। এটি বিবেচনা করে এবং আঞ্চলিক দলের প্রাসঙ্গিকতা খোয়ানোর ভয়ে আগে থেকেই আপ, বিজেডি, বিএসপি, এআইডিএমকের মত দলগুলি সরকারের পক্ষে চলে গেছে। হিন্দুত্বকে পাশকাটিয়ে চলা যে ভারতীয় দলগুলির শিরদাঁড়া ভেঙে দিতে পারে তা বিলক্ষণ বুঝে গেছেন রাজনীতিবেত্তারা। বামদলগুলির অবস্থা সবচাইতে শোচনীয়। ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে বামেদের ডাকা প্রতিবাদ মিছিলকে এখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে সোশ্যাল মিডিয়া ছয়লাপ। জনগণ নজর রাখতে শুরু করেছেন কোন নেতা-নেত্রী কী ধরনের বিবৃতি দেন।

বামেদের বিরোধিতার অবস্থানে সবচাইতে আমোদিত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। মজা দেখার জন্য প্রস্তুত তার অসংখ্য পাঠক ও সমর্থক। মন্তব্য, প্রতি-মন্তব্যে কোনো বাধা মানেনি। কমিউনিস্টদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে অকাট্য নীতিহীনতা। কারণ শ্রীনগর হাইকোর্টের বিচারপতি নীলকান্ত গাঙ্গু যখন প্রকাশ্য রাস্তায় দিবালোকে খুন হয়ে যান, সিপিএম পথে নামেনি। প্রথিতযশা আইনজীবি টিকালাল তাপ্পুকে দিনের বেলায় হত্যা করা হলেও তারা পথে নামেনি। ১৯৯০ সালের শুরুতে কাশ্মীর উপত্যকা হিন্দুদের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। মসজিদ থেকে হিন্দুবিদ্বেষী অবিরাম প্রচার চললেও তারা পথে নামেনি। অসংখ্য হিন্দু পন্ডিতকে প্রকাশ্যে খুন করার পরেও তারা পথে নামেনি। হাজার হাজার হিন্দু পরিবার কাশ্মীর থেকে উৎখাত হল, নিজভূমে পরবাসী হল, তবুও কমিউনিস্টরা পথে নামেনি। একসঙ্গে চারটি হিন্দু পরিবারের দু ডজন হিন্দুকে খুন করা হল, তারা পথে নামেনি। পথে নেমেছে কেবল কাশ্মীরে অস্থায়ী সাংবিধানিক সুযোগকে দীর্ঘায়িত করতে, চিরস্থায়ী করতে। তাতে কোন সম্প্রদায়ের সুবিধা হয় এবং ভোটের রাজনীতিতে কতটা লাভবান হওয়া যায়, তার হিসেবনিকেশই বড় হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে কমিউনিস্টদের গোপন অফিসিয়াল ধর্মটি কী?

কেন্দ্র সরকার এখন যথেষ্ট সজাগ। সেনা, আধা-সেনাদের টহল। কাশ্মীর উপত্যকা যাতে আশান্ত না হয়, কোনো রকম উত্তেজনার মশলা না মেশাতে সমর্থ্য হন সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদেরা, তাই নজরে রাখা হয়েছে প্রাক্তন নেতানেত্রীদের।

‘অতীত’ নামে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা এই প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ছে’, “কথা কও, কথা কও/অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে/কেন বসে চেয়ে রও/কথা কও, কথা কও।” আজ থেকে ৬৯ বছর আগে জম্মু-কাশ্মীরে শ্যামপ্রসাদ মুখার্জীকে গৃহবন্দী করে কার্যত মেরে ফেলেছিলেন এই নেতাদেরই পূর্ব পুরুষ। ইতিহাসের এক অমোঘ সত্যে তারই নাতিকে গ্রেফতার করেছে ভারত সরকার, যে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে শ্যামপ্রসাদ প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’-র উত্তরসূরি ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’।

প্রশ্ন উঠবে এমন সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তে নেবার কারণ কী ছিল? এক বিধান এক নিশান এক প্রধান — এটি বিজেপির একটি ঘোষিত নীতি। যার জন্য নিজেকে বলিদান দিয়েছেন বিজেপির পূর্বসূরী, জনসঙ্ঘের অবিসংবাদী নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারেও তার উজ্জ্বল উদ্ধার, যে কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে একাসনে বসানো হবে। সে দাবী তাকে পালন করতেই হত। কিন্তু তা এখনই কেন? কবে থেকেই বা মনস্থির করা হয়েছিল এই ভীষণ শক্তিশালী সিদ্ধান্তের? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর সলতে পাকানোর শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০১৮ সালের জুন মাসে, মেহবুবা সরকারের উপর থেকে বিজেপির সমর্থন তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে। মনে করা যায়, সেটাই ছিল এই সংবিধান সংশোধনের আদিপর্ব। যেহেতু জম্মু-কাশ্মীরে তারপর রাষ্ট্রপতির শাসন এবং বিধানসভার যাবতীয় কাজের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে; ফলে আলাদা করে বিধানসভার সম্মতি নেওয়ারও প্রয়োজন ছিল না, বিল রদে প্রয়োজন ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির সম্মতি।
কাজেই সময়-ব্যবস্থাপনাটাও দেখার মত। আগে পাশ করানোর দরকার ছিল তিন তালাক বিল, সেটা সামাজিক ও রাজনৈতিক তৎপরতায় পাশ হয়ে যায়। সেই বিল মুসলিম মহিলাদের অন্তঃকরণ ছুঁয়ে গেলে ওস্তাদের পরের চালটি দিতে সময় লাগলো মাত্র এক সপ্তাহ। দ্বিতীয় যে কারণ তা হল, সম্ভবত ইসলামিক স্টেট কাশ্মীর দখল করার দ্রুত প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কাশ্মীর যদি কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল না হয়, তবে কাশ্মীর-পুলিশদের আইসিসের হয়ে কাজ করার সম্ভাবনা থাকত এবং তা সফলও হয়ে যেত, এমনটা শাসক দল ভেবে থাকতে পারে। উপরন্তু বিশ্ব রাজনীতির যা গতিপ্রকৃতি তাতে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য থাকার সম্ভাবনা কম ছিল। সেই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তালিবান, আল কায়দা নতুন উদ্যমে কাশ্মীর দখল করতে পারে, এই বিশ্বাস থেকেও সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তত আপন সামর্থ্যে কাশ্মীরে ভারতীয় ফৌজ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে। আর কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হলেই তা সম্ভব। আর একটি কারণ হল, দুর্গম, বৃষ্টি-বিরল লাদাখ অঞ্চলের উন্নয়ন। কাশ্মীর উপত্যকার উত্তরে লাদাখ, অবস্থান তিব্বতের উচ্চভূমির এক প্রান্তে। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে লাদাখ; জলবাহী মেঘ পাহাড়ের রাশি ঠেলে সেখানে প্রায় পৌঁছায় না। তাই বৃষ্টিপাতও বিরল, যেমন রাজস্থানের মরুতে বৃষ্টি নেই, তেমনই লাদাখেও নেই। কিছু নিচু অঞ্চলে সামান্য ঘাস গজায়, তাতে চলে পশুপালন। আরও নিচু অঞ্চলে গ্রীষ্মে সামান্য বৃষ্টি, সেখানে সামান্য চাষাবাদ। তুষার গলা জলে সেচের সুবিধা আছে, তাকে কাজে লাগিয়ে জৈবকৃষির মাধ্যমে পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজিয়ে অ্যগ্রো-টুরিজম করার মাধ্যমে লাদাখের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা ছিল কাশ্মীর উপত্যকার রাজনীতি। অথচ একটা জনদরদী সরকারকে ভাবতে হবে প্রত্যন্ত এলাকার উন্নয়নের কথাও। জম্মু-কাশ্মীরের অশান্তি লাদাখের উন্নতি ব্যহত করেছে।

প্রশ্ন উঠবে এর পর কাশ্মীরে কি হতে পারে? শান্তি ফিরবে? সুবোধ বালকের মত বিচ্ছিন্নতা-কামী কাশ্মীরী মুসলমানেরা উজ্জীবিত হয়ে পাথর আর অস্ত্র ত্যাগ করে কাশ্মীর পুর্ণগঠনে সামিল হবে? যতদিন পেট্রো-ডলারের মজুত-ভান্ডার বিশ্বে বহাল তবিয়তে থাকবে, ততদিন উগ্রপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আক্রমণ অব্যাহত থাকবে সারা উপমহাদেশ জুড়ে। পাকিস্তানের সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে আগামীদিনে শান্তিপূর্ণ ভাবে জনবিনিময় করে ভারতবর্ষ একটি শক্তিশালী হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। ১৯৪৭-এ ভারত ভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ এত ভুগলো তার জন-বিনিময় হয়নি বলে। কেবল পূর্ব পাকিস্তান থেকেই হিন্দুরা এলো, এখান থেকে পূর্বে যাবার চেষ্টা হল না।

বর্তমান প্রেক্ষিতে কাশ্মীরী পন্ডিতদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা সরকারের কাজে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। উদ্বাস্তু জীবনের ধূলি-ধূসরতা ঝেড়ে তারা কোমর বাঁধছেন। সুখের স্বপ্ন দেখছেন। পাক অধিকৃত কাশ্মীর ফেরত পাওয়াটাও এই দেশের একটা দীর্ঘ লালিত-স্বপ্ন। পুরোটাই নির্ভর করছে বিশ্ব-রাজনীতির ভারসাম্যের উপর। চীন দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি সে দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ভারত। নজর রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক নীতি ও কাজের হদিশ। ইসরায়েল, জাপান এমনকী কয়েকটি মুসলিম দেশের শিক্ষিত ও আধুনিকমনস্ক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর কূটনৈতিক সম্পর্কও নিয়মিত ঝালিয়ে নেবার প্রক্রিয়া অব্যাহত। পাকিস্তান আর্থিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া একটি দেশ। তার পক্ষে সুবিধাজনক নীতি হতে পারে ক্ষুধার্থকে দিয়ে জিহাদী কাজ করান। যেহেতু তথাকথিত জম্মু-কাশ্মীর সরকার ইন্ধন দিতে পারবেনা রাজ্যটি তিন ভাগে (পাক অধিকৃত ধরলে) ভাগ হয়ে যাবার জন্য, তাই মনে করা হচ্ছে আপাতত তেমন সমস্যা নেই। বরং ভারত সরকার প্রবলভাবে রাজ্যের উন্নয়নের চেষ্টা চলিয়ে যাচ্ছে এবং শান্তি” বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মত মুসলিম-তোষণকারী দল এখন যোগ্য ফর্মে নেই; তারা নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই আপাতত ভাবছে; বাড়াবাড়ি করলে সেই দলের মৃত্যুশয্যা ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে অসভ্য রাজ্ কায়েম করার এবং তাতে বিপুল ইনভেস্ট করার সম্ভাবনা একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ভারতবাসীকে সতত মনে রাখতে হবে, কিছু পরিবর্তন কষ্টের অথচ অবশ্যম্ভাবী। কংগ্রেসের পাপের প্রায়শ্চিত্ত বর্তমান নাগরিকদের করতেই হতো, আজ অথবা কাল। ভারতবাসীকে আগামী দিনের জন্য সমস্ত দিক থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এটাই শ্রীঅরবিন্দের বাণী, এটাই স্বামীজির কথা। স্বামীজি বলতেন, “স্বাধীন হওয়ার পর আরো পঞ্চাশ বছর লাগবে উঠতে। আর তখন উন্নতির শ্রেষ্ঠ শিখরে আরোহণ করবে ভারত।” স্বাধীন হবার পঞ্চাশ পেরোবার পরই অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এসেছে ভারত, নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, তিনি তারই পথ অনুসরণ করে চলেছেন। অখণ্ড ভারতবর্ষের মানচিত্রকে সামনে রেখে ধ্যান করতেন ঋষি অরবিন্দ। ভারতীয় উপ-মহাদেশের মানুষের মধ্যে যে রক্ত বইছে, সে তো আদতে সনাতনী রক্তই। কয় পুরুষ আগেও তার বাপ-ঠাকুরদার নাম ছিল এক হিন্দুর নামে। আর সেজন্যই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সর-সঙ্ঘচালক শ্রী মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ভারতবর্ষের সকল মানুষই হিন্দু। সঙ্ঘ ও বিজেপি হয়তো এই আধারেই যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। নির্ধারণ করবে তাদের নীতি। যত দিন না পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানেরা নিজেদেরকে ‘মুসলমান’ ভাবার আগে প্রথমে ‘ভারতীয়’ মনে করতে না পারছেন, ততক্ষণ তাদের ও ভারতের শান্তি নেই। প্রকৃত ভারতীয় মুসলমানরা ভারতের সম্পদ হলেও ভারতবিরোধী আগাছা-মুসলমানদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করাটাই হবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ তৈরির ভিত্তি। কাশ্মীর বিল সেই ভারতের লক্ষ্যেই প্রস্তুত।

@কচ

৫ ই আগষ্ট ছিল সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিল ঘোষণার তিন বছর পূর্তি। তার সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ রাজ্য গঠন ঘোষণারও তৃতীয় বর্ষ। তারই প্রেক্ষিতে এই লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.