সিংহগুলি একটিই বেলেপাথরের ব্লক কেটে তৈরী, বেশ চকচকে করে পালিশ করা।
পশুরাজদের গলা অবধি কেশর নেমে এসেছে, নিচে অশোকচক্র, ঘোড়া, মোষ ও ওল্টানো পদ্মফুল।
শক্তিশালী মৃগেন্দ্রচতুষ্টয়ের কি দর্পিত ভঙ্গি, কি অনির্বচনীয় দন্তকৌমুদী, প্রস্তরে উৎকীর্ণ পেশল বাহু ও সুতীক্ষ্ণ নখররাশিতে কি অপরিমিত শক্তির আভাস !
কেউ কেউ বলেন, ভাস্কর্যটি বৌদ্ধধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত। বৌদ্ধধর্মে বর্নিত অজস্র মেটাফরিকাল পশুদের মধ্যে অন্যতম হল সিংহ – যা পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতিতেও শৌর্য, বীর্য্য, গর্ব এবং সুরক্ষার প্রতীক।
ভগবান বুদ্ধ নিজেই তো শাক্যসিংহ !
আবার কেউ কেউ আবিষ্কার করেছেন, এই অশোকস্তম্ভ অনেকটাই ইরানের আকিমেনিড সাম্রাজ্যের সিংহস্তম্ভের অনুকরণ।
পারসিক স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল স্তম্ভ নির্মাণ। পারসিক স্তম্ভগুলিতে বিভিন্ন পশুর ভাস্কর্য যেমন দুটি মাথাযুক্ত সিংহ, ঘোড়া, ঈগল ইত্যাদি দেখা যায়।
প্রাচীন ভারতের সাথে সাবেক গ্ৰীকদের বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল। বাসুদেবের উপাসক হেলিওডোরাস ও তাঁর বিখ্যাত গরুড়স্তম্ভের কথা কে না শুনেছে ?
আফগানিস্তানের বিস্তীর্ন অঞ্চলে একসময় আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের অধীনস্থ গ্ৰীকরা বসতি স্থাপন করেছিলেন।
এই স্তম্ভশীর্ষের নির্মাণে গান্ধার মূর্তিনির্মাণ কৌশলের প্রয়োগ দেখতে পেয়েছেন কোন কোন বিশেষজ্ঞ।
অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষ প্রতীকটি বর্তমানে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমার্থক।
এই সিংহের পায়ের তলায় মুন্ডক উপনিষদের মন্ত্র “সত্যমেব জয়তে” কথাটি সরকারের তরফে লেখা হয়েছে। কিন্তু বেদমন্ত্রের অবস্থান পশুর প্রতিমূর্তির তলায় থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
১৯৫০ সাল থেকেই এই ভাস্কর্য্যের রৈখিক প্রতিরূপ ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়।
ঐতিহাসিকরা বলেন, আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য সম্রাট অশোকের শাসনকালে সারনাথ নামক স্থানে একটি অশোকস্তম্ভের শীর্ষে এই সিংহসমন্বিত ভাস্কর্য্যটি স্থাপন করা হয়।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ প্রকৌশলী ফ্রেডরিখ অস্কার ইমানুয়েল ওয়ের্টেল সারনাথ অঞ্চলের প্রত্নসামগ্ৰী খননের দায়িত্ব পান।
সেখানে একটি বৌদ্ধ স্তুপের ধ্বংসাবশেষ ছিল। তিনি প্রথমে মূল স্তূপের পশ্চিমে অশোকের আমলের এক স্থাপত্যের ওপর নির্মিত একটি গুপ্ত যুগের মন্দিরের অবশেষ খুঁজে পান। এর পশ্চিম দিকে অশোকস্তম্ভের নীচের একটি ভাঙ্গা অংশ আবিষ্কার করেন। অশোকস্তম্ভটির বাকি অংশ তিনটি ভাগে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর অশোকস্তম্ভটির শীর্ষ অংশটিকে উদ্ধার করা হয়।
এর আগে সাঁচীতে এই স্তম্ভশীর্ষের এক ভিন্ন প্রতিরূপ পাওয়া গিয়েছিল।
সাঁচী থেকে প্রাপ্ত সিংহউপবিষ্ট স্তম্ভশীর্ষের চেয়ে সারনাথে আবিষ্কৃত ভাস্কর্য্যটি তুলনামূলক ভাবে যথেষ্ট ভাল অবস্থায় ছিল।
অন্যত্র প্রাপ্ত কিছু স্তম্ভশীর্ষে চারটির বদলে একটি সিংহের মূর্তি রয়েছে।
মহামান্য ইংরেজ সরকারবাহাদুর উৎখননের স্থানে সারনাথ সংগ্রহালয় স্থাপন করে আবিষ্কৃত প্রত্নসামগ্রীর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য ভাঙ্গা স্তম্ভশীর্ষটিকে বর্তমানে সারনাথ সংগ্রহালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাট অশোক মোট ১৯ টি অশোকস্তম্ভ নির্মান করেছিলেন।
কলা সমালোচকরা প্রায়ই বলেন, নির্মাণশৈলী ও সৌন্দর্যের দিক থেকে ২.১৫ মিটার উচ্চ এই সারনাথের স্তম্ভশীর্ষটিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
অশোকস্তম্ভের চারটি সিংহ কি বলতে চায় ?
চারটি সিংহ একত্রে রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীক। রাষ্ট্র চতুর্দিকে নজর রাখছে, প্রয়োজনে লাফ দিয়ে আক্রমণ করে ঘাড় মটকতে দ্বিধা করবে না।
উল্টানো পদ্মফুলের নীচে যে আরো চারটি পশুর অবয়ব উৎকীর্ণ রয়েছে, তার তাৎপর্য কি ?
সিংহ, যা উত্তরদিকে খোদাই করা আছে, মৌর্য সম্রাট অশোকের প্রভাব প্রতিপত্তি ও শক্তিকে নির্দেশ করে। হাতি ( দক্ষিন দিকে অবস্থিত ) বুদ্ধদেবের আধ্যাত্মিক ধারনা, বোধ ও প্রজ্ঞাকে নির্দেশ করে। বুদ্ধের জন্মের সময় মায়াদেবী একটা সাদা হাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে হাতি একটি পবিত্র অনুষঙ্গ।
ঘোড়ায় (পশ্চিম দিকে দৃষ্ট ) চেপে বুদ্ধদেব সংসারের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। ষাঁড় (পূর্বদিকে যার অবস্থান) বুদ্ধের জন্মরাশি ( বৃষ) নির্দেশ করে।
এই স্তম্ভে উৎকীর্ণ রয়েছে ধর্মচক্র।
সচল চক্র যেমন সদা ঘূর্ণায়মান, ঠিক সেরকম বদ্ধজীবকূলের সংসার পরিভ্রমণও অন্তহীন। ধর্মচক্রে এই বিষয়টিই দর্শিত হয়েছে।
কেবলমাত্র বোধিলাভ ও নির্বাণ দ্বারা এ সংসারচক্র খন্ডিত করা যায়, মুক্ত হওয়া যায় জন্মমৃত্যুর আবর্তন থেকে, রোধ করা যায় পুণর্জন্মের অবশ্যম্ভাবীতা।
চাকার আটটি অংশের দ্বারা ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা “আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ”কে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। অতীতে বুদ্ধ প্রতিবিম্ব বা অন্য ধরণের মূর্তি তৈরির পূর্বে এই ধর্মচক্রকে উদ্দেশ্য করেই প্রার্থনা করা হত। বর্তমানে এই ধর্মচক্রকে যেমন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা মাণ্যতা দিয়ে থাকেন, তেমনই বুদ্ধ বা মহাবীরের মতে বিশ্বাসীদের সাধনপ্রণালীতেও তা অপরিহার্য।
সম্রাট অশোক ভারতকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন।
আসমুদ্রহিমাচলের অধিপতি অশোকের শাসকীয় মানচিত্রে অখন্ড ভারতবর্ষের ধারণা প্রতিভাত হয়। বর্তমান আফগানিস্তান থেকে শুরু করে দক্ষিন ভারতের বিস্তীর্ন অংশে ব্যাপ্ত ছিল অশোকের নিয়ন্ত্রণ। তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য পাঁচটি প্রদেশে (উত্তরাপথ, দক্ষিনাপথ, অবন্তী, প্রাচ্য ও কলিঙ্গ) বিভক্ত ছিল। তাঁর সাম্রাজ্যে তিনটি (পাটলিপুত্র, উজ্জয়িনী ও তক্ষশিলা) রাজধানী ছিল। কলহনের “রাজতরঙ্গিনী” গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে কাশ্মীর অশোকের সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থ “দিব্যবদান”এ উল্লেখ আছে অশোক “স্বশ” প্রদেশ জয় করেন।
অশোক হীনযান বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যারা অষ্টাঙ্গিকমার্গ মেনে নিজ মুক্তির পথ স্থির করে তাদের হীনযানপন্থী বলে। হীনযানপন্থীরা বুদ্ধদেবকে একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে দেখেন, ভগবান হিসেবে মান্য করেন না। হীনযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মতভেদ দূর করার জন্য বৌদ্ধ পণ্ডিত উপগুপ্ত ও কুক্কুটরামা মহাবিহারের অধ্যক্ষ মোগগলি্পুত্র তিস্যের পরামর্শে সুরম্য নগরী পাটলিপুত্রে ২৫১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মোগগলিপুত্র তিস্য। এই মহান অধিবেশনের সহসভাপতি ছিলেন উপগুপ্ত। এই সঙ্গীতিতে অভিধর্মপিটকের নির্দেশ গুলি মেনে চলতে বলা হয়েছিল।
অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করলেও দেশ শাসনের ক্ষেত্রে বেশ কড়া মনোভাব নিয়ে চলতেন। তিনি ‘ব্যবহার সমতা’ ও ‘দণ্ড সমতা’ নীতি প্রবর্তন করেন। বিচারের ক্ষেত্রে মন্ত্রীসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত নেওয়া হত। মৌর্য্যদের আমলে দণ্ডবিধি ছিল সুকঠিন। অশোকের আমলে রাষ্ট্রীয় ঘাতক চন্দ্রগিরিক “নারক” গ্রামের বধ্যভূমিতে সম্রাটের নির্দেশে প্রচুর নরহত্যা করত।
শেষ জীবনে রাজ্যপাট ত্যাগ করে অশোক বৌদ্ধবিহারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর পৌত্র সম্পাতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব একটা অনুরক্ত ছিলেন না। তাঁর আমলে ধর্মপ্রচার ও প্রজা কল্যাণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হতো, সম্পাতি সেই বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছিলেন।
২৩২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বেদনাহত চিত্তে ৭২ বছর বয়সে অশোক পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। অশোকের উত্তরসূরীরা ছিলেন দুর্বল। শেষ মৌর্য নৃপতি বৃহদ্রথকে হত্যা করে তাঁর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ক্ষমতা দখল করেন।
একদিন যে “দেবতাদের প্রিয়” অশোক ছিলেন সমগ্র অখন্ড ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট, কালের প্রবাহে ভারতবর্ষ থেকে বহু শতাব্দীর জন্য তাঁর নাম মুছে গিয়েছিল। ইংরেজ আমলে জেমস প্রিন্সেপ সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই আবার দেশবাসীর কাছে তিনি ফিরে এসেছেন।
সম্রাট অশোক ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অনন্য চরিত্র। কখনও তিনি ক্রুরতার বশবর্তী হয়ে হত্যালীলা সংঘটিত করে লাশের সারি বিছিয়ে দিয়েছেন, আবার কখনও সৌভ্রাতৃত্ববোধ ও মহানুভবতার বন্ধনে ভারত তথা বিশ্ববাসীকে আবদ্ধ করেছেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের বিজয়ী সম্রাট অশোক যুদ্ধ শেষে যখন কলিঙ্গের ময়দানে বীরদর্পে পদচারণা করেন, তখন চারিদিকে মানুষের আহাজারি, কান্না আর আর্তনাদ, কলিঙ্গের ঘরে ঘরে বিধবা আর পিতৃহীনদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। সম্রাট অশোক তো এই বিজয় চাননি। তিনি কলিঙ্গ চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিণামে পেলেন এক মৃত্যুপুরী, যার কারিগর তিনি নিজে।
ময়দানের যুদ্ধ ঠিকই শেষ হয়ে গেল, কিন্তু অশোকের মনে এক দীর্ঘ যুদ্ধের সূচনা হল। এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হল সম্প্রসারণকামী রাজধর্ম ও মানুষের আভ্যন্তরীণ শ্রেয়বোধ।
অবশেষে নানাভাবে আত্মসমীক্ষার পরে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যবাদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। উপগুপ্তের দ্বারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিনি আর যুদ্ধে অংশ নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট অশোক কি অহিংস নীতির অনুসারী হয়েছিলেন ? সম্রাটের শিলালিপিতে বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোর সাবধানবাণী কিন্তু উচ্চারিত হয়েছিল।
তবে “দিগ্বিজয়”এর পরিবর্তে ‘ধর্মবিজয়’ অর্থাৎ ধর্মের দ্বারা শত্রুভাবাপন্ন রাজ্যসমূহকে বশীভূত করার নীতিকে অশোক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
দয়ালু রাজা অশোক রাজপথের দুইপাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, ক্লান্ত পথিকদের জন্য পান্থনিবাস ও মুমূর্ষু পশুদের জন্য পশুহাসপাতাল তৈরী করে দিয়েছিলেন, দূরদূরান্তের দেশে দেশে ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছিলেন।
এই সময়েই অশোক রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচুরসংখ্যক স্তম্ভ নির্মাণ করেন ও স্তম্ভের প্রস্তরগাত্রে শান্তির বাণী খোদাই করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
বর্তমান ভারতের জাতীয় প্রতীক বিখ্যাত ‘অশোকস্তম্ভ’ এখনও সেইসব পুরাতন ঘটনার স্মৃতি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।
শান্তিকামী স্বাধীন ভারতের “পঞ্চশীল” নীতিতে ধর্মাশোকের আদর্শের প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল।
…………………………………………………………..
কোন কোন ঐতিহাসিকের লেখায় অশোককে একজন অহিংস গোঁড়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসী রাজা হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের গবেষণায় সম্রাট অশোক একজন নিপুণ কূটনীতিক হিসেবে পুনরাবিষ্কৃত হলেন। তিনি অশোকের লিপিগুলির বিশ্লেষণ করে দেখালেন অশোকের “ধম্ম” বৌদ্ধধর্মের অন্ধ অনুকরণ নয়, সব ধর্মের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এক নৈতিক অনুশাসন। অশোকের সুবিশাল সাম্রাজ্য শুধু সেনাবাহিনী আর গুপ্তচরবাহিনী দিয়ে শাসন করা যেত না। তার জন্য সর্বজনগ্রাহ্য কোন নৈতিক আদর্শের প্রয়োজন ছিল যা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে সামাজিক-রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে একটি ঐক্যসূত্রে বাঁধবে। এই আদর্শেই নির্মিত হয় অশোকের “ধম্ম” যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর প্রধান ১৪টি শিলালিপি, ৭টি স্তম্ভলিপি ও ২ কলিঙ্গ লিপিতে। এগুলো রাজা হিসেবে অশোকের সরকারী দলিল হিসাবে গণ্য করতে হবে। আর অপ্রধান লিপিগুলিতে আমরা পেয়েছি ব্যক্তি অশোকের বিশ্বাসের কথা — সেখানে বৌদ্ধধর্মে অশোকের অনুরাগ প্রাধান্য পেয়েছে। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চার পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া এই আলোচনা পাওয়া যায় রোমিলাজীর “Asoka and the Decline of the Mauryas” গ্রন্থে।
ইতিহাস আর তার সোর্সের সম্পর্ক কি ? যে কোন সোর্সে যা পাব সবই কী ইতিহাস ? নাকি প্রতিটি সোর্সের প্রকৃতিও বিচার করে দেখতে হবে ?
গজনীর সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণ ও সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের কথা সুবিদিত। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে কোন সোর্স থেকে আমরা তার খবর পাচ্ছি ?
মামুদ এবং তাঁর পরবর্তীকালের তুর্কী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত লেখকদের রচনায় এই ঘটনা বহুচর্চিত, কারণ তাঁদের কাছে এটা বিধর্মীদের উপর তাঁদের বিশ্বাসের জয়যাত্রার একটা নিদর্শন। কিন্তু গুজরাট অঞ্চলের শৈবদের চোখে এই ঘটনার অভিঘাত কেমন ? অথবা একই এলাকার তৃতীয় গুরুত্বপুর্ণ ধর্মীয় সম্প্রদায় জৈনরাই বা এ ব্যাপারে কী বলেন? একই ইতিহাসের অভিঘাত এক এক রকমের সোর্সে কীভাবে বদলে যায় ?
এই রোমাঞ্চকর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ইতিহাসকে দেখার নিদর্শন “Somanatha: Many Voices of a History.”
রোমিলাজীর এসব বই পড়ে দেখাই ভালো।
…………………………………………………………
একটি প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রাচীন ভারতে সিংহকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হত ?
বাঘ তো ভারতের নিজস্ব শ্বাপদ। বাঘের শক্তি, আভিজাত্য ও সৌন্দর্য্য নিয়ে কারো মনে কোন সংশয় নেই।
ভারতভূমির বিস্তীর্ণ এলাকায় কোথাও সিংহ দেখা যায় না। তাহলে তৎকালীন রাষ্ট্রীয় চিহ্নে সিংহ এল কিভাবে ?
একটি সাম্প্রতিক সরকারি সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে বনাঞ্চলে বাঘের মোট সংখ্যা ২২০০-র বেশি, গির অরণ্যে এশিয়াটিক সিংহ আছে আনুমানিক ৪১১টি।
ভারতে ১৭টি রাজ্যে বাঘ আছে, সিংহ মাত্র একটিতে, গুজরাতের গির অরণ্যে।
তাহলে বাঘ কেন অনুপস্থিত ? রাষ্ট্রীয় প্রতীকে বাঘের উপস্থিতির জন্য সেই মহীশূরের টিপু সুলতানের রাজত্ব অবধি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ?
আসলে অশোকের সময়ে মধ্যভারতে প্রচুর সিংহ দেখা যেত। বস্তুতঃ এশিয়া মাইনর ( তুর্কীস্তানের অংশ ) , ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অংশে এশিয়াটিক সিংহ বিচরণ করত। ভারতের বনজঙ্গল ছিল বাঘসিংহে ভরা।
পরবর্তীকালে গির অরণ্য ছাড়া বাকি সব জায়গায় তারা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বেঙ্গল টাইগারকে ভারতের জাতীয় পশু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাঘের আগে সিংহ ছিল ভারতের জাতীয় পশু !
পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু