হঠাৎ জ্বর। গা-হাত-পা ব্যথা। দুর্বল ভাব এবং সর্দি-কাশি— গত এক-দু’মাসে এই উপসর্গে আক্রান্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়! থার্মোমিটারে শরীরের উত্তাপ বাড়লেই মনের কোনায় প্রথম যে সন্দেহ দানা বাঁধে তার নাম করোনাভাইরাস। জুন মাসের শুরু থেকে আবারও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই ভাইরাসের দাপাদাপি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু জুলাই পেরোতে না পেরোতে সেই দাপট অনেকটাই থিতিয়ে গিয়েছে। অন্তত সারা দেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক পরিসংখ্যান তেমনই বলছে।
javascript:false
সাম্প্রতিক তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, আবার কমছে সংক্রমণ। তা হলে কি করোনার সাম্প্রতিক স্ফীতি শক্তি হারাল? ক’দিন শরীরে জাঁকিয়ে বসলেও জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের ধারণা, এর মধ্যে গত দেড়-দু’মাসে যাঁরা জ্বরে ভুগেছেন, তাঁদের অনেকেই করোনার মৃদু উপসর্গে আক্রান্ত ছিলেন। ওই আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই করোনা পরীক্ষা করাননি। ফলে তাঁরা আদৌ করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সামান্য জ্বর-সর্দি কাশি ছাড়া করোনার সাম্প্রতিকতম তরঙ্গে জনজীবন সে ভাবে আলোড়িত হয়নি। আর সেটাই আমজনতাকে অনেকটা স্বস্তি জুগিয়েছে।
করোনা পরিস্থিতি আর ভয়াবহ হবে না বলেই মনে করছেন রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী। তাঁর কথায়, ‘‘এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে সংক্রমণ এক সময় শিখরে পৌঁছয়। আবার ধীরে ধীরে নামতে থাকে। তবে আমরা প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি।’’ চিকিৎসকদের মতে, করোনা ধীরে ধীরে সাধারণ রোগের চেহারা ধারণ করছে। তাই প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো ভয়াবহতা আর নেই। সোমবার চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী বলেছেন, ‘‘কোভিড এখন মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। করোনা আমাদের গ্রাস করতে আসছে— এই সর্বব্যাপী অনুভূতির থেকে আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বার করতে পেরেছি। তবে সাবধান হতে হবে।’’
চিকিৎসকদের একাংশের মতে, করোনার দাপট কমে যাওয়ায় ভাইরাস নিয়ে সাধারণ মানুষ আর অতটা ভাবিত নন। জনসমক্ষে সাধারণ মানুষের মাস্ক-হীন মুখ দেখলেই তা অবশ্য টের পাওয়া যায়।
জুন মাসের গোড়া থেকে দেশে আবার করোনার বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতো পশ্চিমবঙ্গেও করোনার আগ্রাসী রূপ দেখা গিয়েছিল। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে, কী ভাবে এ রাজ্যে সংক্রমণের লেখচিত্র উঁচুতে উঠেছে।
চলতি বছরে মার্চ মাসের পর গত ১০ জুন বাংলায় দৈনিক সংক্রমণ ১০০ পার করেছিল। ওই দিন সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১০৭। গত ১১ মার্চ এ রাজ্যে ১০৬ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার পর ৯ জুন পর্যন্ত বাংলায় দৈনিক সংক্রমণ তিন অঙ্ক পার করেনি। কিন্তু গত ১৫ জুলাই রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ তিন হাজার পার করে। ওই দিন সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৩,০৬৭। এর পর থেকে সংক্রমণের লেখচিত্র ওঠানামা করেছে। সম্প্রতি সংক্রমণের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে।
দেশের করোনার চিত্রটাও খানিকটা বাংলার মতনই। ৯ মে’র পর গত ২ জুন দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়েছিল। ওই দিন সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৩,৭১২। ১৬ জুন দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১২,২১৩। ১৪ জুলাই তা বেড়ে হয়েছিল ২০,১৩৯। তার পর সংক্রমণ কখনও বেড়েছে আবার কখনও কমেছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যুর হার তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম।
এই পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, ‘‘এখন এন্ডেমিক হয়েছে। নতুন উপপ্রজাতি এলে সংক্রমণ বাড়ছে। এখনই প্রায় সবারই এক-দুমাসের মধ্যে সর্দি-কাশি হয়েছে। এই রকম মৃদু উপসর্গ দেখা যাবে। আশা করছি আর ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে না। ধীরে ধীরে থিতিয়ে যাবে।’’
জানুয়ারি মাসে করোনার আগ্রাসনে অনেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখছিলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে থিতু হয়েছিল সংক্রমণ। তার পর জুন মাসের শুরুতে কোভিড আবার চোখ রাঙালেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। করোনার প্রজাতি ওমিক্রনের উপপ্রজাতির জন্যই বার বার এ ভাবে সংক্রমণের রেখচিত্র ওঠানামা করছে বলে চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত। চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, ‘‘প্রতি ছ’মাসে করোনা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তবে ধীরে ধীরে এটি সাধারণ রোগে পরিণত হবে।’’
তবে চিকিৎসকেরা কিন্তু এখনও মাস্ক পরা-সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপরেই জোর দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, আরও বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি দেখে নেওয়া উচিত। সম্প্রতি সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু তার মানেই করোনা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, তা নয়। তাঁদের বক্তব্য, এখনও বিষয়টা দেখতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমেছে ঠিকই। পরিসংখ্যান তেমনই বলছে। কিন্তু অনেকে অসুস্থতাকে হাল্কা ভাবে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না বা করাননি। ফলে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তা একেবারে সঠিক, তা-ও চূড়ান্ত ভাবে বলে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে করোনার সংক্রমণ যে কমেছে, সেটা তাঁরা মেনে নিচ্ছেন।