ছোটবেলায় যে নরম আঙুলগুলো শাড়িতে জরি বসাতো, দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই আর স্বপ্নকে তাড়া করতে করতে সেই আঙুলগুলোই আজ ইস্পাতে বদলে গিয়েছে। শক্ত হয়েছে শরীরের পেশি। তাই তো অনায়াসে বিশাল বিশাল ওজন এক ঝটকায় মাথার উপরে তুলে ফেলতে পারেন তিনি।
রবিবার রাতে বার্মিংহামে অচিন্ত্য শিউলি যখন ভারোত্তোলনে নামবেন, তখন ভারত আর বাংলার সমবেত চাহিদার ওজনটাও যোগ হয়ে যাবে ওই বারবেলে লাগানো লোহার চাকতিগুলোর সঙ্গে।
কতটা প্রস্তুত আপনি? বাড়তি কি কোনও চাপ অনুভব করছেন? বার্মিংহাম থেকে ফোনে ভারোত্তোলনে বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি বলছিলেন, ‘‘প্রস্তুতি খুবই ভাল হচ্ছে। দিনে ন’ঘণ্টা মতো অনুশীলন করছি। এখানে কোনও সমস্যা নেই। কোচ স্যর যে ভাবে রাস্তা দেখাচ্ছেন, সে ভাবেই এগোচ্ছি। চাপের কথা ভাবছি না।’’
গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় ভারোত্তোলন সার্কিটে অচিন্ত্যের নামটা সাড়া ফেলে দিয়েছে। খেলো ইন্ডিয়া ইয়ুথ গেমসে সোনা, জুনিয়র কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। বিশ্ব জুনিয়র ভারোত্তোলনে রুপো। একের পর এক ধাপ পেরিয়ে গত বছর কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। যে সোনা তাঁকে সরাসরি বার্মিংহামে নামার ছাড়পত্র এনে দেয়।
এর মধ্যে জীবনের সেরা পারফরম্যান্স কোনটা? নির্দ্বিধায় বাংলার বছর কুড়ির এই যুবক বলছেন, ‘‘অবশ্যই কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে। ওখানে লড়াইটা বেশ কঠিন ছিল।’’ গত বছর কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জয়ের পরে এ বার নামছেন কমনওয়েলথ গেমসে। দু’টো প্রতিযোগিতার মধ্যে কী রকম পার্থক্য দেখছেন? অচিন্ত্যর মন্তব্য, ‘‘আমার চোখে তো সে রকম কোনও পার্থক্য ধরা পড়েনি।’’
হাওড়ার দেউলপুর গ্রামের ছেলে ছোটবেলা থেকেই লড়াই করেছেন দারিদ্রের সঙ্গে। যে দারিদ্র আরও বেড়ে গিয়েছিল ২০১৩ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে। দাদাকে দেখে ভারোত্তোলনে এসেছিলেন অচিন্ত্য। সেই দাদা বাধ্য হয়ে তখন ভারোত্তোলন ছেড়ে পরিবার পালনের কাজে নেমে পড়েন।
ভারোত্তোলনে তো অনেক পুষ্টিকর খাদ্য দরকার। সে সবের কী হয়েছিল? সেই সমস্যা কী করে দূর করেছিলেন? অচিন্ত্যের জবাব, ‘‘দূর কী আর হয়েছিল। যা পেয়েছি, তা নিয়ে আমাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পরে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়। সেখান থেকে লড়াই করে আমি আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি।’’ অচিন্ত্যের মধ্যে প্রতিভার ঝলক দেখে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘টপস’ (টার্গেট অলিম্পিক পোডিয়াম স্কিম) প্রকল্পেও। যা বঙ্গ ভারোত্তোলকের লড়াইকে কিছুটা হলেও এখন সহজ করেছে।
কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে যে বিভাগে সোনা জিতেছিলেন, কমনওয়েলথ গেমসেও সেই ৭৩ কেজি বিভাগেই নামছেন অচিন্ত্য। এক বছর আগে তাসখন্দের সেই প্রতিযোগিতায় অচিন্ত্য স্ন্যাচিংয়ে ১৪৩ কেজি এবং ক্লিন অ্যান্ড জার্কে তুলেছিলেন ১৭৩ কেজি। অনুশীলনে এখন কত ওজন তুলছেন? অনুশীলন প্রক্রিয়া পুরোটা ভাঙতে চাইলেন না অচিন্ত্য। বলছিলেন, ‘‘যে ওজন তুলে সোনা পেয়েছি, সেটা তুলতে চাই। স্যর যে ভাবে বলছেন, সে ভাবে এগোলে আশা করছি পদক পেতে সমস্যাহবে না।’’
জীবনযুদ্ধে জয়ী অচিন্ত্য এখন তৈরি আর এক লড়াইয়ের জন্য।