স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ” তোমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে; নীরবে সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করছে—তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উল্টে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলোক্যে এদের তেজ ধরবে না; এরা রক্তবীজের প্রাণসম্পন্ন।”
স্বামীজী কাদের শূন্যে বিলীন হতে বলেছিলেন? আর এই নতুন ভারতই বা কারা? আজ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভারতবাসী তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশটা শাসিত হয়েছে কিভাবে? কারা তার নীতি নির্ধারণ করেছেন? যাঁরা দেশ চালিয়েছেন তারা কি বুঝেছেন দেশটার কষ্ট? জেনেছেন সাধারণ মানুষকে বা তাদের নিত্য জীবনের দুঃখের সাতকাহন?
সেভাবে দেখলে স্বাধীন ভারত পরিচালনার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যাঁরা নিয়েছিলেন তাঁরা ইংরেজ শাসনেরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। চোস্ত ইংরেজি বলা, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নেওয়া, মন মানসিকতার দিক থেকে কাদা-ঘাম মাখা ভারতীয় জীবন থেকে অনেক দূরে থাকা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক আধিকারিক আর কর্তাব্যক্তিরা।
ইংরেজ যে একেবারে কোনো ভালো কাজ করেনি তা যেমন ঠিক নয়, ঠিক তেমনই এনারাও কিছু ভাল কাজও করেছেন। কিন্তু এনারা সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে থেকে আসেননি। তাই দারিদ্রসীমার সম্পর্কে টানা দুই ঘন্টা বক্তৃতা দিতে পারলেও, ঘরে অভুক্ত পুত্রকন্যার পিতার সন্ধ্যায় খালি হাতে বাড়ি ফেরার ভয়াবহতা তাঁরা অনুভব করেন নি। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডেক্স কত হলে বুনিয়াদি চিকিৎসা সুনিশ্চিত হয় তা নিয়ে ইংরেজিতে পাঁচশ পাতার থিসিস লিখতে পারতেন, কিন্তু বিনা চিকিৎসায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র পড়ে থাকা সন্তানের মায়ের মনের অবস্থা অনুভব করতে তারা কখনোই পারতেন না।
এই ভারতবর্ষ আজ উঠে আসছে। এই উঠে আসার মহাযজ্ঞে বাবাসাহেব আম্বেদকরের বড় অবদান আছে। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাস করা এক কিশোরীর কথায় সাঁওতালি ভাষায় বাবাসাহেবের জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভেবেছিলেন একঝাঁক যুবক। তখন অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাসকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক পাঠচক্র, সেন্টার ফর সিডিউল্ড কাস্ট সিডিউল্ড ট্রাইব রিসার্চ। শুকদেব টুডু, পার্থ বিশ্বাস, শুভদীপ পালের মত ছেলের দল সাগেন মুর্মুর লেখা বইয়ের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন করতে চায়। কলকাতার এক অনুষ্ঠানে অনুরোধ করে আর তারপরে উড়িষ্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক গোপাল প্রসাদ মহাপাত্র মহামহিমের আপ্তসহায়ক আর এডিসি কে বলে ব্যবস্থা করলেন। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ কালচারাল রিসার্চ সংস্থার বিশাল হলে বাবাসাহেবের উপর বললেন দ্রৌপদী মুর্মু। বললেন একেবারে নিজের জীবনের কথা।
আম্বেদকর ওই ভারতবর্ষকে কি দিয়েছেন। এতকাল লোকে ডঃ আম্বেদকরের বিষয়ে কত জ্ঞানগর্ভ কথা শুনেছে, কিন্তু দ্রৌপদী মুর্মুর কথা যেন একদম আলাদা। যেন প্রতিটি কথা হৃদয়েত অন্তস্থল থেকে বের হয়ে আসছে, আর হল উপচে পড়া শ্রোতার হৃদয়ে এসে বিঁধছে।
এমনটাই বোধহয় হয়। এটা অনেকটা কলকাতা শহরের মেয়ের “সাঁওতালী” নাচ শিখে মঞ্চস্থ করা আর গ্রামের কোনও সাঁওতাল ও মেয়ের সেই নাচার মতোই পার্থক্য। তাই আজ সত্যিই নতুন ভারত বের হয়েছে। বের হয়েছে জঙ্গল থেকে, পাহাড় থেকে। এই ভারতবর্ষ এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারে। আজ সেই মহা অভিষেকের দিন।
ড. জিষ্ণু বসু