কাশ্মীর এই নামটা শুনলেই বাঙালির মানসপটে বিভিন্ন বিচিত্র দৃশ্যের উদ্ভব হয়। একটা অবশই অপরূপ নৈসর্গিক শোভা সংক্রান্ত একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থল হিসাবে। কিন্তু অন্যটি আতঙ্কের যেখানে কাশ্মীর মানেই জেহাদী সন্ত্রাসবাদীদের আঁতুড়ঘর, সেনাবাহিনীর ভারী বুট ও বোমা-গুলির শব্দ আর ভারত-পাক যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল। কিন্তু চিরকালই কি তা ছিল? না, মোটেই নয়। ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাস কাশ্মীর ছাড়া অসম্পূর্ণ। কয়েক হাজার বছর ধরে কাশ্মীর ছিল হিন্দু-বৌদ্ধ ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির পীঠস্থান। পরবর্ত-বৈদিক যুগে উত্তর কুরু গোষ্ঠীর মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করে। আজ থেকে প্রায় ২,২৫৩ বছর আগে মৌর্য সম্রাট অশোক শ্রীনগর শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এই কাশ্মীর। কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক-র পৃষ্ঠপোষকতায় চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতির আয়োজন হয় এই কাশ্মীরে। বসুগুপ্ত শিব সূত্র রচনা করে কাশ্মীরি শৈব ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেন। বিখ্যাত দার্শনিক, অসংখ্য গ্রন্থের রচয়িতা, শিবের উপাসক অভিনবগুপ্ত ছিলেন এই কাশ্মীরেরই মানুষ। তাঁর লেখালিখি দিয়ে কাশ্মীরি শৈব ধর্ম আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে ও দক্ষিণ ভারতের শৈব ধর্মকেও তা প্রভাবিত করে। অভিনবগুপ্তের ছাত্র কাশ্মীরের পণ্ডিত ক্ষেমেন্দ্ৰ বৃহৎকথামঞ্জরীসহ আরও বহু বইয়ের লেখক। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার কলহন এই কাশ্মীরের মাটিতে বসেই দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ রচনা করেন ‘রাজতরঙ্গিনী’। কয়েকশো সুন্দর স্থাপত্য-ভাস্কর্য শোভিত হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ বিহার মাত্র ৭০০ বছর আগেও বিরাজ করত কাশ্মীরে।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে কার্কোট বংশীয় রাজারা কাশ্মীরে রাজত্ব শুরু করে। এই বংশের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় যাকে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ভারতের ‘আলেকজান্ডার’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি তিব্বতের রাজাকে পরাজিত করেন ও কান্যকুব্জ, মগধ, কামরূপ, গৌড় ও কলিঙ্গ জয় করেন। মালব ও গুজরাতও তাঁর প্রভাবাধীন হয় ও তিনি সিন্ধুর আরবদেরও পরাজিত করেন। এরপর যথাক্রমে উৎপল ও লোহার বংশীয় রাজারা কাশ্মীরে রাজত্ব করেন। একাদশ শতকে গজনীর সুলতান মামুদ দুবার কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
১৩৩৯-এ শাহ মীরের হাত ধরে কাশ্মীরে মুসলমান শাসনের সূত্রপাত হয়। চতুর্দশ শতকে কাশ্মীর উপত্যকায় ইসলামের ধীরে ধীরে প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার বছরের সংস্কৃত চর্চা, সংস্কৃত সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির পতনের সূত্রপাত হয় কাশ্মীরে। সুলতান সিকান্দার অমুসলিমদের ওপর বেশি করে করভার চাপান ও বহু মানুষকে জোর করে ইসলাম ধর্ম নিতে বাধ্য করেন। তিনি বহু অপূর্ব হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ‘বুত-শিকান’ বা ‘মূর্তি-ধ্বংসকারী’ উপাধি অর্জন করেন। এরপর মুঘলদের হস্তগত হয় কাশ্মীর। ঔরঙ্গজেবের সময়ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও অমুসলিমদের ওপর বৈষম্যমূলক করভার দেখা দেয় কাশ্মীরে। প্রায় ৫০০ বছরের মুসলমান শাসনের পর রঞ্জিত সিং ১৮২০ সালে কাশ্মীর দখল করেন। ১৮৪৬ সালে কাশ্মীরে শিখ শাসনের অবসান ঘটে ও ব্রিটিশরা ডোগরা রাজা গুলাব সিং কে কাশ্মীর শাসনের দায়িত্ব দেন। এইভাবে কাশ্মীর ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত একটি দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ঠিক হয় যে দেশীয় রাজ্যগুলি চাইলে ভারত বা পাক-ই-স্তান যেকোনো একটি দেশে যোগ দিতে পারে বা স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে পারে। তখনকার কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ঠিক করেন যে, তিনি পাক-ই-স্তান বা ভারত কোনোপক্ষেই যোগ না দিয়ে কাশ্মীরে রাজতান্ত্রিক শাসনই বজায় রাখবেন। এমন অবস্থায় ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাক-ই-স্তানি সে বিভিন্ন বর্ব্বর উপজাতি গোষ্ঠীকে নিয়ে কাশ্মীর আক্রমণ করে। তারা কাশ্মীরে ব্যাপক হত্যালীলা ও গণধর্ষণ চালাতে চালাতে এগোতে থাকে। ফলে হরি সিং বাধ্য হন ভারতের সাহায্য চাইতে। ভারত সরকার জানায় ‘Instrument of Accession’এ স্বাক্ষর করে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি মানলে তবেই ভারতীয় বাহিনী পাঠান সম্ভব। হরি সিং তাই করেন। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে ঢোকে ও অসম্ভব বীরত্বের সাক্ষী রেখে কাশ্মীরের বড় অংশকে পাক-দখলদার মুক্ত করতে করতে এগোতে থাকে। এরকম সময় হঠাৎ নেহরু একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে রাষ্ট্রপুঞ্জে চলে যান কাশ্মীরকে নিয়ে, ফলে ভারত-পাক-ই-স্তানের মধ্যের একটি ব্যাপার আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে কাশ্মীরের একটি বড় অংশ পাক-ই-স্তান দখল করে বসে থাকে ও ভারতীয় বাহিনীর সৈনিকদের এই আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়ে যায় ও দীর্ঘস্থায়ী কাশ্মীর সমস্যার সৃষ্টি হয় নেহরুর অকালপরিণামদর্শী এই সিদ্ধান্তের জন্য।
কাশ্মীর উপত্যকার সুন্নী মুসলিমদের একটি অংশের নেতা শেখ আবদুল্লার সঙ্গে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই শেখ আবদুল্লার আব্দারে নেহরু সংবিধানে ৩৭০ ধারাটি ঢোকাতে উঠে পরে লাগেন। এই ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরে থাকবে আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা। ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের মানুষ এখানে জমি কিনে থাকতে পর্যন্ত পারবেন না। তখনও বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে সংবিধান সভা সংবিধান রচনার কাজ করছে। আম্বেদকর দেশের অখণ্ডতা বিরোধী, জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই কালাকানুন সংবিধানে ঢোকাতে পরিষ্কার অস্বীকার করেন। তখন নেহরু ঘুরপথে সংসদ হয়ে এই আইনকে পাশ করিয়ে সংবিধানে ঢোকাতে বাধ্য করেন। নেহরুর প্রশ্রয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর শেখ আবদুল্লা প্রায় বাদশাহ-র মতো কাশ্মীর শাসন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ নেহরুর আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে তিনি নিজেকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করলেন, মুখ্যমন্ত্রী নয়। ইতিমধ্যে মহারাজা হরি সিংয়ের ২১ বছর বয়সী পুত্র যুবরাজ করণ সিংকে আবদুল্লা জম্মু-কাশ্মীরের ‘সদর-ই-রিয়াসৎ’ (রাষ্ট্রপ্রধান) নিযুক্ত করেন। অর্থাৎ ১৯৫২ সাল নাগাদ অবস্থাটা এরকম দাঁড়াল যে, ভারত রাষ্ট্র, জম্মু-কাশ্মীরকে যার অবিচ্ছিন্ন অংশ বলে মনে করা হচ্ছে, দু’জন প্রধানমন্ত্রী, নেহরু ও আবদুল্লা; দু’জন রাষ্ট্রপ্রধান, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসৎ; দুটি সংবিধান, তার মধ্যে কাশ্মীরেরটি তখনও লিখিত হচ্ছে ও দু’টি পতাকা। দেশের এই অসম্মানের বিরুদ্ধেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, ‘এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান ঔর দো নিশান নেহি চলেঙ্গে’ (এক দেশের মধ্যে দু’রকম সংবিধান, দুই প্রধানমন্ত্রী ও দুই পতাকা চলবে না)।
ইতিমধ্যে গোঁড়া সুন্নী শেখ আবদুল্লা-র সাম্প্রদায়িক ও পক্ষপাতদুষ্ট শাসনের ফলে জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ অঞ্চলের কাশ্মীরি পণ্ডিত, ডোগরা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, শিয়া মুসলিম ও বিভিন্ন উপজাতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী সবাই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল। জম্মুর অবিসংবাদিত নেতা প্রেমনাথ ডোগরা-র নেতৃত্বাধীন জম্মু-কাশ্মীর প্রজা পরিষদের ওপর শেখ আবদুল্লার পুলিশ ভয়াবহ দমনপীড়ন, হত্যা, নারী ধর্ষণ নামিয়ে আনে। এই প্রজ্ঞা পরিষদের দাবি ছিল যে, তারা ভারতীয় সংবিধান ও ভারতীয় পতাকাকেই শুধুমাত্র মানবে। এই ন্যায্য দাবীকে সমর্থন জানাতে ১৯৫৩ সালের ১১ মে পারমিট ছাড়াই (তখন জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে ভারতীয়দের পারমিট করাতে হত) জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে গিয়ে জম্মুর মাধোপুর সীমান্তে আবদুল্লা-র পুলিশ শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেফতার করে। সেখান থেকে তাঁকে ডাল লেকের তীরে একটি ছোট্ট কুটিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিনা বিচারে তাঁকে প্রায় ৪০ দিন আটক করে রাখার পর কাশ্মীরের একটি হাসপাতালে খুবই রহস্যজনকভাবে ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন ভোর ৩টা ৪০ মিনিটে মাত্র ৫১ বছর বয়সে শ্যামাপ্রসাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর সেবার দায়িত্বে থাকা নার্স রাজদুলারী টিক্কু পরে জানান, সেদিন গভীর রাতে ডাক্তারের নির্দেশ মতো তিনি একটি ইঞ্জেকশন শ্যামাপ্রসাদকে দেওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড ছটফট আর চিৎকার করতে লাগলেন, ‘জ্বল যাতা হ্যায়, হামকো জ্বল রাহা হ্যায়’। তারপরেই শ্যামাপ্রসাদ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ও সব শেষ হয়ে যায়। সারা দেশব্যাপী শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু রহস্যের তদন্ত দাবী করা হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নেহরু কোনো রকম তদন্ত করাতে রাজী হলেন না। শ্যামাপ্রসাদের জননী যোগমায়া দেবী একটি চিঠিতে নেহরুকে লেখেন যে, ‘আপনি সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন। আমি মনে করি আমার পুত্রের অকালমৃত্যুর জন্য জম্মু-কাশ্মীর সরকার দায়ী। আমি আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করছি যে এই যোগসাজসে আপনারাও আছেন। আপনার ক্ষমতা বিশাল, আপনি মরিয়া হয়ে প্রচারের ঝড় বইয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সত্য একদিন উদ্‌ঘাটিত হবেই ও এর জন্য আপনাকে দেশের মানুষ ও ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে হবে।’
ইতিহাসের সেই বিচার কিন্তু এখনো বাকি।
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, মৌলানা আজাদ কলেজ, কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.