বেনিফিট ইকোনমি। শুনতে খুবই ভাল, মিষ্টি, দুরন্ত, মহান আইডিয়া।
এর মূল কথা হল, সরকার কম ট্যাক্স নেবে, পারলে নেবেই না, স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা এসব বিনাপয়সায় দেবে জনগণকে। আরো এটা সেটা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ এসব খাতেও ভর্তুকি, ভাতা এসব দিতে হবে। তবেই না দেশের উপকার হবে?
যে কেউ শুনে বলবে যে খুবই ভালো কথা। বেজায় উপকারী সিস্টেম। কিন্তু এর জন্য যে গুচ্ছের টাকা দরকার সেটা সরকার কোথা থেকে পাবে? ট্যাক্স থেকে ইনকাম তো কমবে, তাহলে? উত্তর খুব সোজা। আরো নোট ছাপাও, আর সেই নোট জনগণের মধ্যে দেদার বিলাও।
এখানে যেটা বলা নেই, যে এভাবে নোট ছাপিয়ে বিলোলে সেই দেশে টাকার মূল্য কমে যায়। আমদানি করা জিনিসের, যে কোন প্রোডাকশনের জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি হয় ও যাঁরা গরীব তাঁদের কষ্ট আরো বাড়তে থাকে। আর এভাবে বেশিদিন চললে দেশের অর্থনীতিটাও দেউলিয়া হয়ে যায়।
১৯৯১র শেষদিকে যখন বিপ্লব আর এলোই না, সারা দুনিয়া এক লাল পতাকার তলায় আসা তো দূরস্থান, উল্টে মহান সোভিয়েত ভেঙে আহ্লাদের আট টুকরো হল। যখন পোল্যান্ড, চেকোস্লোাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, ইস্ট জার্মানি সবখানেতে কমিউনিস্ট সরকারের একনায়কদের টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে জনগণ ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করালো, তখন আমাদের বিপ্লবীরা ঢোঁক টোক গিলে, এই কড়কড়ে নতুন থিওরী নিয়ে বাজারে নেমে পড়লেন। আফটার অল, কমিউনিজমে পুরোটাই তো হাঁসজারু মার্কা থিওরী। যেখানে সযত্নে সাজানো থাকে সোনার পাথরবাটিতে থরে থরে কাঁঠালের আমসত্ত্ব। তাও আবার বিনাপয়সায়! তাই বিপ্লবের সাবস্টিটিউট হিসেবে এই নতুন থিওরী আমদানি হল!
যাই হোক, “বেনিফিটোনোমিক্স” কে তো বাজারে নামালেই হল না, এর তো নাম ডাক কিছু করাতে হবে? তাই ধরে টরে আনা হল বেশ কিছু জং-পড়া ইকোনমির পণ্ডিতদের। ক্যাপিটালিস্ট ধরে এদিক সেদিক করে একটাকে নোবেল পাইয়েও দেওয়া হল। অনেকেই ভাবতে পারেন এখানে ক্যাপিটালিস্ট এলো কোথা থেকে? তাদের লাভই বা কি যদি বেনিফিটোনোমিক্স রমরমিয়ে চলে? এটা নিয়ে আরেকদিন লিখব নাহয়। তবে একটা জিনিস জেনে রাখুন যে, সুস্থ অর্থনীতিতে ক্যাপিটালিস্টদের সেরকম কোন লাভ নেই, ওদের লাভ হল যখন সব এলোমেলো হয়ে যায়, মড়ক লাগে, যুদ্ধ লাগে, সরকার দেউলিয়া হয়, তখন। আর তাই দুনিয়ার ক্যাপিটালিস্টদের গোপনের এক গেলাসের ইয়ার হল কমিউনিস্টরা, যারা সফ্ট নোজড বুলেটের মতন ছোট একটা গর্ত করে ঢুকলেও বেরোনোর সময় এক্সিট হোলে হাড়, মাংস লন্ডভন্ড করে বেরিয়ে যায়। আর ক্যাপিটালিস্ট বলতে কিন্তু টাটা, বিড়লা, আম্বানি, এলন মাস্ক এঁদের সাথে গুলোবেন না। এরা হল ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, ক্যাপিটালিস্ট নয়। ক্যাপিটালিস্টরা অনেক গভীর জলের মাছ। তাঁরা প্রয়োজন মতন সরকার উল্টে দেন, বিজ্ঞানীদের জেলে পচান, ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কারের আগেই আবিস্কারককে গুম করিয়ে দেন, একচেটিয়া ভ্যাকসিন বিক্রির স্বত্ব আদায় করেন। এঁদের পরিবারের জামাইরা মাঝে মাঝে নোবেল, বুকার-টুকার পেয়ে থাকেন। ওহ্, আরেকটা কথা বলতেই ভুলে গেছিলাম। এঁদের প্রত্যেকে অনেকগুলো জনদরদী, লোকহিতৈষী ফাউন্ডেশন চালান। যেই সংস্থাগুলো খুব নিষ্ঠার সাথে নানা অ্যাওয়ার্ড, স্কলারশিপ ইত্যাদি দিয়ে কমিউনিস্ট ইন্টেলেকচুয়ালদের পোষে।
হাতের সামনে শ্রীলঙ্কা কে দেখুন। বেনিফিটোনোমিক্স চালু করান হল ওখানকার প্রেসিডেন্টকে দিয়ে। অনেকেই আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু নোবেল পাওয়া ইকোনমিস্টের কথা না শুনলে লোকে ছি ছি করবে না! শ্রীলঙ্কার কমিউনিষ্টরা জোর দিয়ে বললে তাঁরা প্রেসিডেন্টের সাথে আছেন, বেনিফিটোনোমিক্স চালাতেই হবে। তবেই না অর্থনীতির বিপ্লব আসবে! তারপর সুস্থ সবল একটা অর্থনীতির কি ভিখারীর দশা হল, সবাই সেটা জানেন। সেটা নিয়ে আর নতুন কিছুই বলার নেই।
কিন্তু এর পরের ব্যাপারটা হল সবচাইতে মজার।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ধ্বসের পরে পিলপিল করে সবার আগে প্রেসিডেন্টের বাংলোতে ঢুকল কমিউনিস্টরাই। বাংলোর হাতায় পিকনিক লেগে গেল। দেড়শ বছরের পুরানো পিয়ানো ভেঙে সেই কাঠ জ্বালিয়ে রান্না হল, বইপত্র পুড়িয়ে চাউমিন তৈরি হল। কমিউনিস্ট বলে কি আর খিদে টিদে পায় না?
আর তারপর…আর তারপর..কমিউনিস্টরা আকাশ বাতাস মুখরিত করে স্লোগান তুলল…
- দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে হবে!
- মূল্যবৃদ্ধি রুখতে হবে!
- পেট্রল পাম্পে পেট্রল চাই!
- সবার জন্যে খাদ্য, শিক্ষা, ওষুধ চাই!
- অপদার্থ সরকার, দূর হটো!
আর সবাই সেটা শুনে বলল – “আহা ঠিকই তো বলছে।”
কি ভাল, কি মিষ্টি হয় না, কমিউনিস্টরা?
©শান্তনু সোম