Mahua-Deboshree: মহুয়াদির গায়ে আগুন লাগল? পুড়ে গিয়েছিলেন? সব উত্তর নিয়ে অসময়ে চলে গেলেন: দেবশ্রী

মহুয়া রায়চৌধুরীকে আমি ছোট্ট থেকে চিনি। আমি আর আমার দিদি কৃষ্ণা রুমকি-চুমকি নামে নাচ অনুষ্ঠান করতাম। মহুয়াদিও তখন তেমনই শিশু নৃত্যশিল্পী। বাড়ির নাম শিপ্রা। পোশাকি নাম সোনালি রায়চৌধুরী। ওঁর বাবা আমার মাকে বৌদি বলে ডাকতেন। সেই সময়ে একটি অ্যামেচার ক্লাব প্রতি রবিবার ছোটদের নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। আমরা তো যেতামই। মাঝেমধ্যে মহুয়াদিও অংশ নিতেন। সেই মহুয়াদি অভিনয়ে এলেন আমারই মতো। তরুণ মজুমদারের হাত ধরে। তনুদা ওঁরও নাম বদলে রাখলেন মহুয়া। প্রথম ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’।

এর পরেই আমরা একসঙ্গে ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে। তত দিনে মহুয়াদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক ছেলে গোলা-ও এসেছে কোলে। সে সব মায়ের মুখে শুনেছিলাম। আমাদের বয়সের অনেক ফারাক। তাই দিদি মায়ের সঙ্গে বেশি কথা বলতেন। আমার মা ছিল ওঁর ‘মাসিমা’। আমরা মহুয়াদির বর তিলক চক্রবর্তীকেও চিনতাম। তিলকদা মঞ্চে কিশোরকুমারের গান গাইতেন। সেই থেকেই প্রেম। মাকে বলেছিলেন, ‘‘মাসিমা, আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছি।’’

সেটে কম কথা হলেও একটা জিনিস খেয়াল করতাম। দিদি বেশ মেজাজি। এই হাসিখুশি, কিছু ক্ষণ পরেই বেজায় রেগে গিয়েছেন। খুব রগচটা ছিলেন। আর রেগে গেলে অনেক সময়েই যা মুখে আসত, তা-ই বলতেন। শুনেছি, তখন নাকি গালিগালাজও করে বসতেন অনেককে। মাথা ঠান্ডা হলেই আবার সব ঠিক। এ সব দেখে এক এক সময়ে মনে হত, সংসার জীবনে কি সুখী ছিলেন না মহুয়াদি? প্রায়ই ওঁকে দেখতাম কেমন যেন অশান্ত। কিন্তু রূপটান নেওয়ার পর সে সব ভুলে যেতেন। অভিনয়ে কোনও দিন কোনও খামতি রাখতেন না।

আর ছেলে অন্তপ্রাণ ছিলেন। একমাত্র ছেলেকে চোখে হারাতেন। টালিগঞ্জের খুব কাছেই ভাড়াবাড়িতে থাকতেন ওঁরা। তখন ‘দাদার কীর্তি’র শ্যুট চলছে। এক বার শ্যুটের পরে নাকি তিলকদার বাইকে চেপে মহুয়াদিকে রাস্তায় ঘুরতে দেখেছিলেন সন্ধ্যা রায়। পর দিন মহুয়াদি স্টুডিয়োয় আসতেই তোড়ে বকুনি। সন্ধ্যাদির বক্তব্য, নায়িকাদের পথেঘাটে ঘুরতে দেখা গেলে আকর্ষণ থাকবে? বকুনি খেয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে ফের আমার মায়ের কাছেই মহুয়াদি। বিষণ্ণ গলায় বলেছিলেন, ‘‘সন্ধ্যাদি কী বকলেন!’’ মা সে দিন বুঝিয়েছিলেন, সন্ধ্যাদি সবার মায়ের মতো। মায়েরা তো সন্তানদের ভাল-মন্দ বলবেনই, আগলাবেনও।

‘দাদার কীর্তি’র পর আরও একাধিক ছবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। ‘সুবর্ণ গোলক’ ছবিতে আবার আমরা দুই বোন। ‘পারাবত প্রিয়া’য় মহুয়াদি নার্স হয়েছিলেন। যত ভাল অভিনেত্রী, সম্ভবত ততটাও সংসারী ছিলেন না। এক দিন স্টুডিয়োয় এসে সটান আমার ঘরে। আমি তখন ‘ভালবাসা ভালবাসা’-র শ্যুট করছি। বললেন, ‘‘বললেন, কল শো-তে গিয়ে আমার মেকআপ বক্স হারিয়ে ফেলেছি। তোরটা একটু দিবি? নইলে শ্যুট করতে পারব না!’’ শুনে একটু অবাকই হয়েছিলাম। সে দিন আমার সঙ্গে, তনুদার সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন। অদ্ভুত ভাবে খুব শান্ত! তার পরে মেকআপ বক্স নিয়ে শ্যুট করতে গেলেন।

পর্দায় আমরা দুই বোন। কিন্তু বাস্তবে একদম বিপরীত। ভাল অভিনয়ের খিদে দু’জনেরই। পর্দা ভাগ করতে গিয়ে দু’জনেই সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। ফলে, সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা তলায় তলায় রাজনীতি করা— মাথাতেই আসত না। আরও একটি বিষয়ে মিল। আমার মতো মহুয়াদিও পশুপ্রেমী ছিলেন। স্টুডিয়োয় এসেই প্রথমে সমস্ত কুকুরদের খাওয়াতেন। তার পর কাজ শুরু করতেন। আমার প্রথম হিন্দি ছবি ‘জাস্টিস চৌধুরী’ মুক্তি পেল। তখন ছবির ভিডিয়ো ক্যাসেট পাওয়া যেত। রূপসজ্জাশিল্পী বুড়োকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘তুই আমার বাড়িতে আয়। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে আমরা চুমকির ছবিটা দেখব। ও তো আমাদের ঘরের মেয়ে।’’ এই সব গুণের জন্যই আমার মতো মহুয়াদিকেও ইন্ডাস্ট্রি ভীষণ ভালবাসত। ওঁর ‘আদমি ঔর অওরত’ আমার প্রিয় ছবি।

এ সবের মধ্যেই ১৯৮৫ সালে সর্বনাশা ২২ জুলাই। কী করে গায়ে আগুন লাগল? পুড়ে গিয়েছিলেন, না কি অন্য কিছু? সব উত্তর অজানা রেখেই বড্ড অসময়ে চলে গেলেন মহুয়াদি। অনেক কাজ বাকি ছিল। অনেক সম্মানও পাওনা ছিল। সেটে এসেও ছেলের কথা কিছুতেই ভুলতে পারতেন না। সব শিশুর মধ্যেই নিজের ছেলেকে খুঁজতেন। তাই বাচ্চাদের দেখলেই কাজ ফেলে খেলায় মেতে উঠতেন দিব্যি। নিজের ছেলে গোলাকে নিজের হাতে আর মানুষ করাই হল না মহুয়াদির!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.