পূর্ণগ্রাস

রাজ্যের উচ্চশিক্ষার আঁধার আকাশে সুসংবাদের বিজুরি। জাতীয় তালিকায় প্রথম দশে জায়গা করে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র‌্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক, সংক্ষেপে এনআইআরএফ ২০২২-এর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে ভারতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে দেখা গিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে। অষ্টম স্থান পেয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। একই সঙ্গে সেরা কলেজগুলির তালিকায় অষ্টম স্থানে রয়েছে বাংলার সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজও। আবার অন্য দিকে, দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সার্বিক তালিকায় প্রথম দশে জায়গা করে নিয়েছে বাংলার আরও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান— খড়্গপুর আইআইটি। এ-হেন কৃতিত্ব সত্যিই গর্বের। স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। তালিকা প্রকাশের পর তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

প্রতি বছরই এনআইআরএফ দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রস্তুত করে। গত বছরও সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের নাম ছিল। তবে, প্রশ্ন হল, বিজুরি কি আঁধারকে সরাতে পারে? এই সাফল্যে কি বাংলার উচ্চশিক্ষা জগতের দুরবস্থাটি ঢাকা পড়ে? বিগত কয়েক বছরে এই রাজ্যে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ যে ভাবে নষ্ট হয়েছে, তাতে এটুকু বলা যায়, উচ্চশিক্ষা থেকে ‘শিক্ষা’ শব্দটিই অন্তর্হিত হওয়ার মুখে। এই রাজ্য বাম জমানায় শিক্ষায় ‘অনিলায়ন’-এর সাক্ষী। পরিবর্তিত জমানাতেও সেই ঐতিহ্য এতটুকু টাল খায়নি, উপরন্তু যোগ হয়েছে সরকার মাইনে দিচ্ছে, অতএব কলেজগুলো কথা শুনতে বাধ্য— এমত হুঙ্কার। এক দিকে যেমন নিয়মনীতির ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি তাদের স্বকীয়তা হারিয়েছে, অন্য দিকে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে রাজনীতি ক্রমশ দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সব শুধুমাত্র অতিমারির দান নয়। অতিমারি-পূর্ব সময় থেকেই শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির হার কমছিল, প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আসন ফাঁকা পড়ে থেকেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া, মফস্সলের কলেজগুলিতে পরিকাঠামোর অভাব এবং পঠনপাঠনে শৃঙ্খলাটি হারিয়ে যাওয়া। সামান্য কারণে ঘেরাও, অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের গালিগালাজ, নিগ্রহ— এই হল পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নবলব্ধ ঐতিহ্য।

এবং অতিমারি। উচ্চশিক্ষায় পূর্ণগ্রাসটিকে পূর্ণতর করেছে অতিমারি পর্ব। দীর্ঘ দু’বছর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা কার্যত বন্ধ, অফলাইন ক্লাস করার উৎসাহও হারিয়েছে পড়ুয়ারা। অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে ছাত্ররা অন্যায্য ভাবে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, কেননা তারা এই দু’বছরে সফল হওয়ার ‘শর্টকাট’টির সন্ধান জেনে গিয়েছে। শিক্ষকরাও পড়ানোর ‘শর্টকাট’ ব্যবস্থায় অতীব প্রসন্ন আছেন। সুতরাং, যে উচ্চশিক্ষার জগৎ থেকে উৎকর্ষ বাদ হয়ে গিয়েছিল আগেই, এখন তা প্রায় প্রহসনে পরিণত। সাধারণ মেধার ছাত্রছাত্রীরাও এখন যে যত তাড়াতাড়ি পারে রাজ্য ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচে— শতমুখে রাজ্যের গুণগান গাওয়া সরকারি মুখপাত্রদের সন্তানরাও। পশ্চিমবঙ্গের গুটিকতক প্রাতিষ্ঠানিক পালকের সাধ্য কী সেই নিদারুণ দৈন্যদশা ঢেকে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.