স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বীর বিপ্লবী
বটুকেশ্বর দত্ত (জন্মঃ- ১৮ নভেম্বর, ১৯১০ – মৃত্যুঃ- ২০ জুলাই, ১৯৬৫)(সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)
বর্ধমানের খন্ডঘোষের ওয়াড়ি গ্রামে জন্ম বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের। রেলে চাকরি সূত্রে, বাবা গোষ্ঠবিহারী দত্ত কানপুরে বাস করায় তাঁর বাল্যশিক্ষা সেখানেই। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুর থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কানপুরে কলেজে পড়ার সময় গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর জাতীয়তাবাদী পত্রিকা ‘প্রতাপ’-এর সঙ্গে যুক্ত হন ভগত সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত। তখন থেকেই ধীরে ধীরে দুজনে সহযোদ্ধা হয়ে ওঠেন। বিপ্লবী সদস্যদের নিকট বি.কে নামে পরিচিত ছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত। যোগ দেন Hindustan Socialist Republican Association বা HSRA সংগঠনে। শুরু হয় অস্ত্র বানানোর হাতেখড়ি ও প্রশিক্ষণ। গ্র্যাজুয়েশনের পরে পুরোমাত্রায় ডুবে গেলেন সশস্ত্র বিপ্লবে।
কেন্দ্রীয় সংসদ ভবনে হামলাঃ- দেশ জুড়ে সশস্ত্র বিপ্লব রুখতে ব্রিটিশ সরকার Defence of India Act 1915 চালু করার কথা ভাবছে। এর বিরোধিতায় কী করা যায় ? প্রস্তাব দিলেন বটুকেশ্বর। বললেন‚ দিল্লিতে Central Legislative Assembly-তে বোমা ছোড়া হোক। তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হল HSRA-এ। ঠিক হল‚ বোমা নিক্ষেপ করবেন বটুকেশ্বর এবং শুকদেব। ভগৎ সিং চলে যাবেন সোভিয়েত রাশিয়া। পরে পাল্টে যায় পরিকল্পনা। বোমা নিক্ষেপের দায়িত্ব পান ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত। ১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল Central Legislative Assembly-র দর্শকাসন থেকে দুটি বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন তাঁরা। সঙ্গে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ ‘ ধ্বনি। ফরাসী নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবী বৈলেয়ন্টের মতোই ভগৎ সিংহের বক্তব্য ছিল ‘বধিরকে শোনাতে উচ্চকণ্ঠ প্রয়োজন’। উড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী লিফলেট। কয়েকজন আহত হলেও এই ঘটনায় কারও মৃত্যু হয়নি। শান্তভাবে গ্রেপ্তারবরণ করেন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত।
জেল জীবনঃ- এরপর বিস্ফোরক আইন ভঙ্গ ও হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে গ্রেফতার করা হয় তিনজনকেই। ভগৎ সিং‚ শুকদেব এবং বটুকেশ্বর দত্তকে। বিচারে বটুকেশ্বরকে আন্দামানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। জেলবন্দিদের সাথে নোংরা আচরণের বিরুদ্ধে ও রাজবন্দীর অধিকারের দাবীতে এক ঐতিহাসিক অনশনের শুরু করেন এবং কিছু অধিকার আদায়ে সক্ষম হন তাদের জন্য । তবে এই অনশনে শহীদ হন বিপ্লবী যতীন দাস। আন্দামান থেকে যখন ফিরে আসেন‚ তখন বটুকেশ্বর দত্ত যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত। দেশ জুড়ে প্রতিহত সশস্ত্র আন্দোলন। তাঁর কমরেডরা কেউ আর নেই। তিনি যোগ দিলেন গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। আবার চার বছরের কারাদণ্ড হল। এবার গেলেন বিহারের মোতিহারী কারাগারে। ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে বটুকেশ্বর মুক্তি পেলেও বাংলা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ তার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। ১৯৪২ সালে আবার গ্রেপ্তার করে তাকে অন্তরীন রাখা হয় ৩ বছর।
উপসংহারঃ- এই সর্বস্বত্যাগী বিপ্লবীর শেষ জীবন বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। টিবি রোগাক্রান্ত হওয়ায় জেল থেকে মুক্তি পেলেও স্বাধীন ভারতে দারিদ্রের সাথে লড়াই করে তাঁর জীবন কেটেছে। স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী ছিলেন অঞ্জলি। একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছিলেন ভারতী। বাকি জীবন কেটেছিল দুঃসহ দারিদ্র্যে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পরিবহণ ব্যবসা করতেন। শেষ দিনগুলো ছিলেন বিহারের পাটনায়। সরকারি সাহায্য বা সম্মান বিশেষ কিছু পাননি। দীর্ঘ রোগভোগের দিল্লীর একটি হাসপাতালে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে তার মৃত্যু হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুসারে অন্ত্যেষ্টি হয়েছিল পঞ্জাবের ফিরোজপুরের হুসেইনিওয়ালায়। যেখানে তার ৩৪ বছর আগে রাতের অন্ধকারে শতদ্রুর জলে গোপনে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সহযোগী ভগৎ সিং-শিবরাম রাজগুরু-শুকদেব থাপারের অস্থি। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে।
দিল্লিতে সফদরজং বিমানবন্দরের উল্টোদিকেই আছে তাঁর নামে নামাঙ্কিত বি.কে দত্ত কলোনি। জন্মশতবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছিল অনিল ভার্মা রচিত ‘Batukeshwar Dutt: Bhagat Singh ke Sahyogi’। এটাই এখনও অবধি তাঁর উপর প্রকাশিত একমাত্র বই। বটুকেশ্বরের জন্মভিটেকে সংরক্ষণ করে রেখেছেন বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি রাখা কমিটির সদস্যরা। দোতলা মাটির বাড়ি এখনও রয়েছে। তৈরি হয়েছে মিউজিয়ামও। সেখানেই রয়েছে যাত্রীনিবাস। জন্মভিটের পাশের মাঠে বিপ্লবীর স্মরণে বসে মেলাও। বিপ্লবীর আত্মগোপন করা সুরঙ্গটি রয়েছে পড়শী বাড়িতে।
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা