কবি, নাট্যকার এবং সংগীতস্রষ্টা
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (জন্মঃ- ১৯ জুলাই(৪ঠা শ্রাবণ), ১৮৬৩ – মৃত্যুঃ- ১৭ মে, ১৯১৩) (সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)
প্রায় ৫০০ গান রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। তাঁর বিখ্যাত গান “ধনধান্য পুষ্প ভরা”, “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। প্রেমের, নাটকের, হাসির ও স্বদেশি গানই মুখ্য। এর মধ্যে সুর পাওয়া যায় মাত্র ১৩২টি গানের। নাটক লিখেছেন ২১টি – ইতিহাসাশ্রিত, প্রহসন, সামাজিক, পুরাণাশ্রিত। গান-কবিতা মিলিয়ে কিছু গ্রন্থ। ১৯০৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্যসভা ‘পূর্ণিমা মিলন’ বা ‘সাহিত্যিকী পৌর্ণমাসী সম্মিলন’। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা আসে তাঁরই মাথায়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।
এ সবের পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক স্বাধীনচেতা ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে আসা দ্বিজেন্দ্রলাল হয়ে উঠলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মেদিনীপুরের সুজমুঠা পরগনার সেটলমেন্টের দায়িত্বে থাকাকালীন ঘটিয়ে বসলেন এক কাণ্ড। কৃষকদের খাজনা দিলেন কমিয়ে। রক্তচোখ দেখালেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। আর উল্টো দিকে কৃষকেরা তাঁকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বদলে ডাকতে শুরু করলেন ‘দয়াল রায়’ নামে। বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা হল। ছোটলাট এলেন পরিদর্শনে। বাঙালি কবি ছোটলাটকে কী বলেছিলেন? তাঁর ভাষায়— ‘আইন বিষয়ে তাঁহার অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়ে দেই’। ফলে যা হওয়ার, তাই হল! বিষয় গড়াল আদালতে। কোনও ক্রমে চাকরি বাঁচলেও পদোন্নতি রুদ্ধ হল। আর দ্বিজেন্দ্রলাল খুশি রইলেন এই ভেবে যে, ‘নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত বঙ্গদেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত’ হয়েছে। ইংরেজের চাকরি তাঁর ভাষায় ছিল ‘দাস্য’। শেষ দিকে মাথায় চেপে বসেছিল স্বেচ্ছাবসরের ভাবনা।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (১৮২০-৮৫) ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। তাঁর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যস্রষ্টা।
দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন। এরপর কিছুদিন ছাপরা’র রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারীতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind। এই বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কর্মে নিযুক্ত হন দ্বিজেন্দ্রলাল। কিন্তু তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়।
ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারী দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন ১৮৮৭ সালে। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারী চাকরী হতে অবসর নেন।
বাল্যকালে তিনি একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত হয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় ও হরেন্দ্রলাল রায় – দু’জনেই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল। এরকম একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। তিনি পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন, যা দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্নিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে।
হাস্যরসেও তিনি অসামান্য পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন।
গ্রন্থতালিকা
কাব্যগ্রন্থ
আর্যগাথা, ১ম খণ্ড (১৮৮৪)
The Lyrics of India (ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রচিত) (১৮৮৬ )
আর্যগাথা, ২য় খণ্ড (১৮৮৪)
হাসির গান (১৯০০)
মন্দ্র (১৯০২)
আলেখ্য (১৯০৭)
ত্রিবেণী (১৯১২)
রম্য ও ব্যঙ্গাত্মক রচনা
একঘরে (১৮৮৯)
সমাজ বিভ্রাট ও কাল্কি অবতার (১৮৯৫)
বিরহ (১৮৯৭)
ত্র্যহস্পর্শ (১৯০০)
প্রাশচিত্ত (১৯০২)
পূনর্জন্ম (১৯১১)
গীতিনাট্য
পাষাণী (১৯০০)
সীতা (১৯০৮)
ভীষ্ম (১৯১৪)
সামাজিক নাটক
পারাপারে (১৯১২)
বঙ্গনারী (১৯১৬)
ঐতিহাসিক নাটক
তারাবাঈ (১৯০৩)
রাণা প্রতাপসিংহ (১৯০৫)
দুর্গাদাশ (১৯০৬)
নূরজাহান (১৯০৮)
মেবার পতন (১৯০৮)
সাজাহান (১৯০৯)
চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১)
সিংহল বিজয় (১৯১৫)
……………….
দ্বিজেন্দ্রলাল …রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দ্বিজেন্দ্রলাল যখন বাংলার পাঠকসাধারণের নিকট পরিচিত ছিলেন না তখন হইতেই তাঁহার কবিত্বে আমি গভীর আনন্দ পাইয়াছি এবং তাঁহার প্রতিভার মহিমা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হই নাই। দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সত্য, অর্থাৎ আমি যে তাঁর গুণপক্ষপাতী, এইটেই আসল কথা এবং এইটেই মনে রাখিবার যোগ্য। আমার দুর্ভাগ্যক্রমে এখনকার অনেক পাঠক দ্বিজেন্দ্রলালকে আমার প্রতিপক্ষশ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া কলহের অবতারণা করিয়াছেন। অথচ আমি স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারি এ কলহ আমার নহে এবং আমার হইতেই পারে না। পশ্চিম দেশের আঁধি হঠাৎ একটা উড়ো হাওয়ার কাঁধে চড়িয়া শয়ন বসন আসনের উপর এক পুরু ধুলা রাখিয়া চলিয়া যায়। আমাদের জীবনে অনেক সময়ে সেই ভুল-বোঝার আঁধি কোথা হইতে আসিয়া পড়ে তাহা বলিতেই পারি না। কিন্তু উপস্থিতমতো সেটা যত উৎপাতই হোক্ সেটা নিত্য নহে এবং বাঙালি পাঠকদের কাছে আমার নিবেদন এই যে, তাঁহারা এই ধুলা জমাইয়া রাখিবার চেষ্টা যেন না করেন, করিলেও কৃতকার্য হইতে পারিবেন না। কল্যাণীয় শ্রীমান দেবকুমার তাঁহার বন্ধুর জীবনীর ভূমিকায় আমাকে কয়েক ছত্র লিখিয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছেন। এই উপলক্ষে আমি কেবলমাত্র এই কথাটি জানাইতে চাই যে, সাময়িক পত্রে যে-সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয় তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব-সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি এবং আমার লেখায় বা আচরণে কখনো তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই।– আর যাহা-কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র, তাহার সম্পূর্ণ কারণ নির্ণয় করিতে আমি তো পারিই না, আর কেহ পারেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না। [১৩২৪ বঙ্গাব্দ]
ধনধান্য পুষ্পভরা
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি তিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা!
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে!
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে, ওঠে পাখির ডাকে জেগে,
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়;
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
– ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা