আমার দাদুরও একখান দ্যাশ ছিল। পরে সেই দ্যাশটি হারিয়ে যায় যখন, দাদু আর কোন মিসিং ডায়েরি করেনি। করবেই বা কোন থানায়? রিফিউজি ক্যাম্প থানা, কলোনি থানা, নতুন বাড়ি বানালো যে দক্ষিণ কলকাতা এলাকায় সেই থানা না ভিটেমাটি ছিল যেখানে সেই থানা। দাদুর একখান দ্যাশ ছিল। সেই দ্যাশে সুপুরি গাছ, নারকোল গাছ ছিল। খাল ছিল, বিল ছিল, নয়ামাটি, সাতক্ষীরা, বান্দরবান নামে সব মিষ্টি এলাকা ছিল, মহারশি, উদ্দাখালি, সনকোশ, হাড়িভাঙ্গা, খাসিমারা নদী ছিল, গোল্লাছুটের মাঠ ছিল, সন্ধেবেলার শাঁখ ছিল। আমন ধানের গন্ধ ছিল, ফজলুল চাচার থেকে কেনা রোববারের খাসির ঝোল ছিল। শীতে গাছিরা খেজুরের গাছ থেকে রস পেড়ে আনতো, দিদা-ঠাকুমারা তখন গিন্নি সব। দুধ গোকুল, পাকন পিঠে, গোলাপ পিঠে তৈরি হতো৷ দালানে অনেকের গরু বাঁধা থাকতো আবার সেই কবেকার নারায়ণ শালগ্রাম শীলাও ঘরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল৷ দাদুদের একখান দ্যাশ ছিল কিন্তু জীবনে জাদুকর পিসি সরকার ছিল না। চোখের সামনে ভ্যানিশ হয়ে যায় জিনিস, সেই জাদুর খেলা না দেখে, দাদুদের প্রজন্ম দেখলো ভীটেমাটিচাটি হয়ে যেতে। একরাতে দাদুদের দ্যাশ থেকে চৈল্যা আসতে হইবো। রাতের অন্ধকারেই সেফ!
ঠাকুমারা বোকার মতো নিশ্চয়ই সেই রাতে প্রশ্ন করেছিল, “কও কী? মাথার ঠিক আছে? আমাদের দ্যাশ ছাইড়া যামু ক্যান! ফিরবো কবে? তুলশী গাছে জল দিতে হয় রোজ, ঠাকুরকে নকুলদানা দিতে হয়, ময়না পাখিটারে দানা। ওরা তো আমাদের ছাড়া মরে যাবে।” পৃথিবীর সব রিফিউজি বাবার মতোই আমার দাদুর প্রজন্ম নিশ্চিত সেসময় চুপ করে গেছিল বা রেগে বলে ফেলেছিল, “নিজের জান বাঁচে কিনা দেখো আর তোমার ময়নাপাখি।”
শুনেছিলাম আমার দাদু দুটো বসার টুল নিয়ে চলে এসেছিল। আরেক বন্ধুর দাদু নাকি একটা কাঁচের হ্যাজাক। আমরা মানে যারা বিরিয়ানি আর বহুত্ববাদ এক থালায় সাজিয়ে খাই, কলকাতার কালচার মারাই তারা ফ্যাক করে হেসে দিয়েছিলাম। এতোকিছু থাকতে টুল আর হ্যাজাক? উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রথম জেনারেশন রিফিউজি পরিবার জবাবটা দিয়েছিল। এসব সময় হাতের কাছে যা পাওয়া যায় নিয়ে চলে আসে লোকে৷ ওই একখান সম্পত্তি তো ধরে রাখা গেল৷ বাকি সবটাই তো দুষ্টু লোকের মতো ভ্যানিশ৷
কিন্তু কারা যে দুষ্টু লোক, সেই জটিল অংক না কষে দাদুরা নতুন দেশে মানিয়ে নিলো৷ কোনদিন আর দুষ্টু লোকদের বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো না। গোটাটা র্যাডক্লিফ সাহেবকে দোষ দিয়ে উদারপন্থী, প্রগতিশীল, বাস্তুহারা মানুষের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজলো বরং। দাঁত চেপে এপাড়ে টিকে থাকার লড়াই তখন। ভাত না দিলে মানচিত্র চিবিয়ে খাওয়ার হুমকি। ঘর হলো, কলোনিতে নতুন রাস্তা হলো, পাট্টা পেল, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্যপদ পেল। আর সারাজীবনের জন্য একটা নস্টালজিয়া ব্যামো পেল। “আমার একখ্যান দ্যাশ ছিল।”
কিন্তু কী হবে দ্যাশ নিয়ে হাহুতাশ করে? যাক যা গেছে তা যাক। ক্ষতবিক্ষত হৃদয় উদারতায় শান্তি পাক। তারচেয়ে পদ্মার ইলিশ নিয়ে কথা বলি, ইলিশের বিরিয়ানি নিয়ে হাহুতাশ করি, পাঁচ রকমের মাছের ভর্তা নিয়ে আলাপ করি। এসব সেফ! রিফিউজি হয়ে আসা দাদু, বাবারা এপাড়ে এসে এসব নিয়েই বড়াই করতো। শুটকি কি দারুণ করে রান্না করা যায়, কতোগুলো সব্জির খোসা ভাজা ডালের সাথে খেলে ভালো লাগে, কবে বাংলাদেশে ভিটেমাটি দেখতে যাবে ইত্যাদি। ওই প্রজন্মকেও এসব খবর দিতে পারতাম না। কথা এড়িয়ে যেত তারপর কৃষানু দের বাঁপায়ের জাদুকরী নিয়ে আড্ডা দিত। ঠাকুমাদের ওপাড়ে ভিটেমাটি দেখতে যাওয়ার কথা বললে বলতো, “ধুস, ওখানে ওসব দেখে কি হবে? কিছুই তো নেই। তারচেয়ে পুরী বা দার্জিলিং ঘুরে আসি।”
ভিটেমাটিচাটি হওয়ার অভিমান আর একরাতে চলে আসার দীর্ঘশ্বাস মিশে গেলে যদি কোন শব্দ তৈরি হয়, তাকে রিফিউজিরা দ্যাশ বলে। আমার দাদুর একখান দ্যাশ ছিল।
ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ