Mountaineering: কাল নন্দাঘুণ্টি, আজ এভারেস্ট, শৃঙ্গজয় বাঙালির নতুন রোমান্স

অভিযাত্রী দলের সদস্যরা ছিলেন অবিবাহিত। কেউ শিক্ষক। কেউ বা কেরানি। কেউ দোকানি। কিন্তু চেহারায়, সহযাত্রী সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন, সকলেই বাঙালি।

২০,৭০০ ফুট উঁচু নন্দাঘুণ্টি অভিযান তখন ছিল এক বিস্ময়কর প্রয়াস। এভারেস্ট স্বপ্নেরও বাইরে। আজ ২০ জনেরও বেশি বাঙালি এভারেস্ট ছুঁয়েছেন। এক জন আবার পৌঁছে গিয়েছেন অক্সিজেন ছাড়া।

এমনটি আগে ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ যদিও হিমালয়ের পাদদেশে। এবং বাঙালিরা সব সময়ে ভ্রমণপিপাসু। তা সত্ত্বেও পর্বত অভিযান বাঙালিদের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি।

আসলে এর কারণটি একটু অন্য রকম। দিল্লির অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং পর্বত উৎসুক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গোটা বিশ্বে কোথাওই পর্বতারোহণ খুব জনপ্রিয় খেলা নয়। বলেন, ‘‘দুন স্কুলে দুই পর্বতারোহী শিক্ষক ছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে হোল্ডসওয়ার্থের কথা বলতে হয়। তাঁর উৎসাহে ছাত্রেরাও কেউ কেউ মাউন্টেনিয়ারিং শেখার দিকে ঝোঁকে। কিন্তু অন্যান্য নামী স্কুলে কাউকে সে ভাবে পর্বতারোহণে মন দিতে দেখা যায়নি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তেমন ছিল না।’’ রুদ্রাংশুবাবুর মতে, পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ট্রেকিং করার ইচ্ছা আলাদা। সেটি তো বেড়ানো। কিন্তু শৃঙ্গজয়ের জন্য যথেষ্ট কঠিন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তা পাওয়াও সহজ নয়। সে কারণেই হয়তো সাধারণ বাঙালির জীবনের অঙ্গ ছিল না পর্বতারোহণ। তাঁর কথায়, একটি সময় পর্যন্ত বাঙালিদের পাহাড়ে যাওয়া মানে ছিল তীর্থ। মূলত কেদার-বদ্রী যাওয়া।

৬০ বছরে অবশ্য বাংলায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। বাঙালির আগ্রহেও বৈচিত্র এসেছে। পর্বত অভিযান তার একটি মাত্র। রুদ্রাংশুবাবুর কথায়, ‘‘এটি একেবারেই হালের প্রবণতা। কিছু কাল আগেও এত বাঙালি পর্বতারোহী দেখা যেত না।’’

বাঙালির প্রথম নন্দাঘুণ্টি অভিযান সম্ভব হয়েছিল আনন্দবাজার সংস্থার অর্থানুকূল্যে। এখন বিভিন্ন জেলার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা টাকা ধার করে পাহাড়ে ওঠেন। সফলও হন। ছন্দা গায়েন, টুসি দাসের মতো এভারেস্ট জয়ীরাও রয়েছেন সেই তালিকায়। বিনা অক্সিজেনে এ বছর এভারেস্টে উঠলেন পিয়ালি বসাক। এমন কীর্তি বাঙালির এই প্রথম। তিনিও কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে গিয়েছেন।

আশ্চর্যের বিষয় হল, যে সব জেলায় একটি ঢিবি পর্যন্ত নেই, সেখানেও পর্বতারোহণের চল বেড়েছে। একটি সময়ের পর থেকে বাংলার কোণে কোণে পর্বতারোহীদের ক্লাব খুলতে শুরু করে। সে সব ক্লাব এখনও আছে। হাওড়া থেকে কৃষ্ণনগর, সর্বত্র। ২০১০ সালে বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস এভারেস্টে পা রাখার পর থেকে কৃষ্ণনগর ক্লাবের নাম বেশি ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে তিন বছরে পর পর তিনটি সামিট হয়। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে নন্দাঘুণ্টি অভিযানের পর্বতারোহীদের।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে নন্দাঘুণ্টি অভিযানের পর্বতারোহীদের।
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

‘দেশ’ পত্রিকায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সান্দাকফু ভ্রমণের গল্প পড়ে কৃষ্ণনগরের এক ভ্রমণপ্রেমী বাঙালি অশোক রায়ের ইচ্ছা হয়, তিনিও সেই পাহাড়ে যাবেন। সাধারণত বাঙালি একটি লেখা পড়লে আরও একটি লেখার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু কৃষ্ণনগর আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানেই। সেখানকার অশোকবাবু অন্যদের থেকে জামা-জুতো ধার করে, পিঠে সে সব বেঁধে বেরিয়ে পড়েন পাহাড়ে চড়তে। ‌আশির দশকে বাঙালির রোমান্স কিন্তু পাহাড়ে চড়া ছিল না। সিপিএম-নকশাল ঘিরে রোমান্টিকতা অনেক দেখা গিয়েছে। কবিতা লেখাও ছিল। সান্দাকফু যাত্রা থেকে কৃষ্ণনগরের অন্য রোমান্টিকতা শুরু।

অশোকবাবু এর পর ঠিক করেন, একটি মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব তৈরি করবেন। ১৯৮৬-তে ক্লাব তৈরি হল। পরের বছর সেখানেই যোগ দিলেন ব্যাঙ্ককর্মী বসন্তবাবু। তার কয়েক বছরের মধ্যে এলেন কলেজপড়ুয়া দেবাশিসবাবু। বসন্ত সান্দাকফু-ফালুট গেলেন। দেবাশিস ঘুরে এলেন জোংরি। অন্য সদস্যরাও একটু একটু করে এক-এক দিকে। সেই ক্লাবে তত দিনে বাৎসরিক রক ক্লাইম্বিং কোর্স চালু হয়েছে। অশোকবাবু গেলেন পহেলগামে মাউন্টেনিয়ারিংয়ের কোর্স করতে। তার থেকে লাভ হবে সকলেরই। বসন্তবাবু আর দেবাশিসবাবুও গেলেন শিখতে। তবে উত্তরকাশীর ‘নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং’-এ। এর বেশ কিছু বছর পর তৈরি হল তাঁদের জুটি। ১৯৯৬ সালে গঢ়বালের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কামেট (৭,৭৫৫ মিটার) পাড়ি দিলেন বসন্ত-দেবাশিস। তার পর থেকে আর থামেননি। যেমন সুযোগ পেয়েছেন, নিজেদের মতো করে এগিয়ে গিয়েছেন। ২০১০ সালে সেই জুটিই বাংলার প্রথম এভারেস্টজয়ী হয়ে ফেরে।

সে বার এভারেস্টের পর কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং অন্নপূর্ণাও জয় করেন কৃষ্ণনগর ক্লাবের সদস্যরা। একই ক্লাব থেকে। সেই ১৯৬০-এর নন্দাঘুণ্টি অভিযানের পর আবারও যেন পর্বতারোহণের সার্কিটে নবজাগরণ ঘটে বাংলায়। ২০১৬ সালে এভারেস্ট জয়ী দেবরাজ দত্ত বলেন, ‘‘আসলে বাংলার শিল্পাঞ্চলগুলিতেই মূলত বাড়তে পেরেছে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলি। এই খেলায় অনেকটা টাকা লাগে। শিল্পাঞ্চলে তবু তার জোগান হয় । হাওড়া, ব্যারাকপুর, কৃষ্ণনগর, আসানসোল, কলকাতায়। যেখানে অর্থসাহায্য দেওয়ার মতো কিছু মানুষ রয়েছেন, সেখানেই।’’ সেই কিছু মানুষের উৎসাহ পেয়ে এক দল লড়ে চলেছেন নতুন কিছু করার তাগিদে। বাজি রাখছেন নিজেদের সবটুকু। জীবনও।

দেবরাজ, পিয়ালি কিংবা দেবাশিস, সকলে একটি কথা বলে থাকেন, পাহাড়ের শিখরে পৌঁছনোর আনন্দই আলাদা। মনে হয়, সব শ্রমের পর তৃপ্তি। নন্দাঘুণ্টি অভিযানের কথা লিখতে গিয়েও সে কথা উল্লেখ করেছেন গৌরকিশোরবাবু। শৃঙ্গজয় করার ক্লান্তি সত্ত্বেও সেই সন্ধ্যা কেটেছিল হইচই করে। নাচ-গানও হয়েছিল। শিখরে ওঠার আনন্দ এমনই।

২০১০-এর পর থেকে পরপর বেশ কয়েক বছর এভারেস্ট জয় করেছে বাঙালি। দেবরাজবাবু জানান, প্রতি বছরই চেষ্টা করেন অনেকে। আর অর্থসাহায্য কোনও মতে জোগাড় করে, ধার-দেনা করে শৃঙ্গজয়ের স্বপ্নও বেড়েছে। দেবাশিসবাবু যেমন লক্ষ্য করেছেন, বেশ কিছু বছর ধরেই বাঙালি পর্বতারোহীরা অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা দুর্বল শ্রেণি থেকে আসছেন। তিনি বলেন, ‘‘এই খেলায় তো তেমন টাকা নেই। উল্টে নিজের সর্বস্ব দিয়ে তবে যাওয়ার সুযোগ মেলে। তবু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কিছু প্রাপ্তির একটা অনুভূতি আছে। সেটাই টানে!’’ নিজের পরিবারের সব সম্বল দিয়ে ‘সামিট’ করায় বিশ্বাসী নন দেবাশিস। তবে তিনি বোঝেন, এর মধ্যে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা হয়ে দেখা দেওয়ার লড়াই আছে। জেদ রয়েছে। আর আছে রোমাঞ্চ। তাঁর যখন এভারেস্ট যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল, দেবাশিসবাবুর স্ত্রী তো নিজের সব গয়না বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ঠিক যে ভাবে ‘পথের পাঁচালী’ বানানোর সময়ে বিজয়া রায়ের গয়না সাহায্য করেছিল সত্যজিৎ রায়কে!

তবে এই আকাঙ্ক্ষার গল্পের শিকড় আরও গভীরে। বাংলার মফস্‌সলের কয়েক জন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েও যে কিছু করে দেখাতে পারেন, এক জনকে দেখে আর এক জনের সেই ইচ্ছা জাগে। যেমন কৃষ্ণনগর ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অশোকবাবুর হয়েছিল। দার্জিলিঙের ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট’ (এইচএমআই)-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং পিয়ালির শিক্ষক কর্নেল গুলশন চড্ডা জানাচ্ছেন, এইচএমআই-এ স্কলারশিপ নির্ভর শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। প্রায় ২৫ শতাংশ। তাঁদের অনেকেই আসেন প্রান্তিক স্তর থেকে। কারও পরিবার চা বাগানে কাজ করে, কারও বা আরও কষ্টে দিন চলে। পিয়ালির জীবনও খুব আলাদা নয়। চন্দননগরে বাড়ি। বাবার সাধারণ ব্যবসা ছিল। অসুস্থ হওয়ার পর সেটুকুও নেই। পিয়ালি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করেন। সেই বেতনের টাকায় সংসার চলে। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা চলে। সেই মেয়ে যদি ছন্দার বাড়ির গয়না বন্ধক রেখে এভারেস্ট জয়ের কথা জেনে উদ্বুদ্ধ হন, নতুন কিছু করার কথা ভাবেন, তবে তো তা আলাদাই।

বিনা অক্সিজেনে এভারেস্ট জয় করা মহিলা এ দেশে পিয়ালিই প্রথম। সে খ্যাতি পাওয়ার পর তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারির গল্পের কথা মনে পড়ছে তাঁর। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলায় নোরগে আর হিলারির এভারেস্ট জয়ের গল্প পড়েছিলাম। সেই থেকেই পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছা হয়।’’ এখন সেই তালিকায় রয়েছে তাঁর নামও। তবে আলাদা করে ইতিহাস গড়েছেন। অক্সিজেন ছাড়া গিয়েছেন। এমন আরও ইতিহাস তৈরি করতে চান। কিন্তু অর্থের দিকটি ভাবায়। এভারেস্ট জয়ের পর যদি অর্থসাহায্য বেশি পান, সে কথাই বার বার মনে হচ্ছে তাঁর। তবে আরও কিছু স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব হলেও হতে পারে।

দেবাশিসবাবুরা যখন প্রথম এভারেস্ট যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তখন টাকার জন্য নানা জায়গায় কথা বলেছিলেন। এমনও শুনতে হয়েছিল যে, তাঁরা ‘বেড়াতে’ যাবেন বলে হঠাৎ অন্য লোকে নিজের টাকা দিতে যাবেন কেন!

বাঙালির এত দফা এভারেস্ট জয়ের পরও যে পরিস্থিতি খুব বদলায়নি তা যেমন বলে দেয় পিয়ালির ঘটনা, তেমনই আরও একটি ঘটনার কথা মনে করায়।

২০১৬ সালের মে মাসে কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর গৌতম ঘোষ ও তাঁর দুই সঙ্গী সুভাষ পাল, পরেশ নাথ এভারেস্টের পথে নিখোঁজ হয়ে যান। আট জনের একটি দল রওনা হয়েছিল। কলকাতার চার জন পর্বতারোহী। আর নেপাল থেকে চার জন শেরপা। কলকাতার নিখোঁজ তিন অভিযাত্রীর সঙ্গে ছিলেন ৪২ বছরের সুনীতা হাজরা। একমাত্র তিনিই বেঁচে ফিরেছিলেন সে বার। এভারেস্টের চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে দলটির অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। দেখা দেয় আরও কিছু সমস্যা। সঙ্গী শেরপারা তাঁদের ছেড়ে চলে যান।

ব্রিটেনের এক অভিযাত্রীর সাহায্য পেয়ে কোনও ভাবে প্রাণ বেঁচেছিল সুনীতার। বাকিরা সেটুকুও পাননি। একটি ক্যাম্পে অক্সিজেন মাস্ক পরে বিশ্রাম নিতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের। দিনটি ছিল মে মাসের ২০ তারিখ। পরদিন, ২১ তারিখ তাঁদের শেষ বার দেখা গিয়েছিল। তার পর থেকে আর খোঁজ মিলছিল না দলটির। যে সময়ে তাঁরা রওনা হয়েছিলেন, তখন অভিযান মরসুমের প্রায় শেষের দিক। আরোহীদের সংখ্যা সে পথে কমে যাচ্ছিল। নিখোঁজদের খোঁজ করতেও অপেক্ষা করতে হবে একটি গোটা বছর। সঙ্গে চাই আরও অনেকটা অর্থ। যা এঁদের কারও পরিবারেরই ছিল না।

এক বছর পর নানা ব্যবস্থাপনা করে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। সে খবর করতে আমেরিকার খোদ নিউ ইয়র্ক টাইমস কলকাতায় পাঠিয়ে দিল দুই সাংবাদিককে। তাঁদের মধ্যে এক জন আবার পুলিৎজার জয়ী। কিন্তু কলকাতার সংবাদপত্রে এ নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। উদ্ধারকাজে কিন্তু সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে। কী আশ্চর্য! সরকারি ভাবে কোনও কাজে অনুদান দিলে সব সময়েই তার প্রচার চলে। কিন্তু একটা সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সরকার কিন্তু নিজেদের পিঠ চাপড়াল না। দেবাশিসবাবু একেও সার্বিক সচেতনতার অভাব হিসাবেই দেখেন। সে সময়ে উদ্ধারকাজে যুক্ত ছিলেন তিনিও। বলেন, ‘‘এ ধরনের উদ্ধারকাজে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়। সরকার সে সব কথা বলে দিলেও মুশকিল হতে পারে। এই খেলা সম্পর্কে তো অধিকাংশের যথেষ্ট উৎসাহ নেই। অনেকে খরচের পরিমাণ শুনে উল্টে বিরক্ত হতে পারেন।’’

নিখোঁজ তিন অভিযাত্রীর মধ্যে সুভাষ পালের নাম উঠেছে এভারেস্ট জয়ীদের তালিকায়। তা-ও বিশেষ কেউ জানতেন না সে সময়ে। দেবরাজবাবু মনে করেন, খেলা হিসাবে পর্বতারোহণ নিয়ে সচেতনতা ২০২২-এও সে ভাবে তৈরি হয়নি। অথচ বাঙালির উত্তেজনা আছে। সুভাষবাবু তো এভারেস্ট রওনা হয়েছিলেন নিজের সবটুকু খুইয়ে। একটি মালবাহী গাড়ি চালাতেন। তা বিক্রি করে কিছু টাকা পান। সঙ্গে বাড়ি বন্ধক রাখেন। পারিবারিক সব সম্বল জলে যায়। সুভাষ পাহাড় থেকে ফেরেন না। এ দিকে, পাহাড়ে চড়ার উন্মাদনার এমন কথাও অধিকাংশ মনে রাখেন না।

মনে কি সত্যিই রাখেন না? তবে পিয়ালিরা জন্মান কী ভাবে? এক ছন্দা নিখোঁজ হলে আর এক পিয়ালির দেখা মিলত কি, কেউ কিছু মনে না রাখলে? উত্তর দিয়ে দেন পিয়ালিই। বলেন, ‘‘ছোটবেলায় পাহাড়ের গল্পের পাশাপাশি আরও কিছু গল্প পড়েছি। অধিকাংশই বিখ্যাতদের জীবনী। তাঁরাও তো কষ্ট করে, প্রায় সব খুইয়ে নিজেদের কাজ করেছেন। তাঁদের সকলে মনে রেখেছেন।’’ পিয়ালিদেরও তেমন হতে ইচ্ছা হয়।

দেবাশিসের মনে হয়, স্বপ্নপূরণের জন্য হঠকারিতা না করাই ভাল। ধীরে ধীরে এগোতে হয়। আট হাজার মিটারের শৃঙ্গে যাওয়ার আগে যদি বেশ কয়েক বার ছ’হাজার, সাত হাজারের শৃঙ্গ অভিযানে যাওয়া যায়, তবে দুর্ঘটনা কম ঘটে। উত্তর পাওয়া যায় গৌরকিশোর ঘোষের ‘নন্দাকান্ত নন্দাঘুণ্টি’-তে। দেশের প্রথম অভিযান অযোধ্যা পাহাড়ে হয়নি। হয়েছিল সোজা ৬,৩০০ মিটারে। কৃষ্ণনগরে কোনও ঢিবি না থাকা সত্ত্বেও প্রথম অভিযানে অশোকবাবু চলে গিয়েছিলেন সান্দাকফু। তা-ও তো ৩,৬০০ মিটার উঁচু!

অর্থাৎ, মরা মরা করতে করতেই বাঙালি শেষ পর্যন্ত রাম বলতে শিখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.