কখনও এক কামরার ঘরে সংসার টানতে হিমশিম খেয়েছেন মা। কখনও দুই ছেলের পড়ার খরচ জোগাড়ে বিক্রি করে দিয়েছেন নিজের শাড়ি। মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে ঝামেলা করা বাবা এক মূক ও বধির মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টায় গ্রেফতার হওয়ার পরে তাকে বার করে আনতে আইনজীবীর টাকার ব্যবস্থাও করেছেন সেই মা-ই! তার পরেও সহ্য করতে হয়েছে জামিন পেয়ে বেরোনো বাবার অত্যাচার।
এত কিছুর পরেও বাবাকে কেন ছেড়ে যাননি মা? কাঁকুড়গাছিতে বাবার হাতে মাকে খুন হতে দেখা ছেলের মনে এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। অভিষেক বাকুলি নামে বছর চৌত্রিশের সেই ছেলে বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আলাদা হয়ে গেলে হয়তো মাকে এ ভাবে খুন হতে হত না। ওই লোকটা আমার বাবা, এটা ভাবতে লজ্জা করছে। ভবিষ্যতে আমার আর ভাইয়ের সঙ্গে ওই লোকটার আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। পুলিশ যা করার করবে। মাকে খুন করার পরে পুলিশের কাছে গিয়ে বিষ খেয়েছে বলায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সে কেমন আছে তার খোঁজ নিইনি, আর নেবও না। বেসরকারি হাসপাতালের খরচও আমি দেব না।’’
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাঁকুড়গাছি রোডে একটি মুদির দোকানের সামনে বছর পঞ্চাশের বাবি বাকুলির গলায় ছুরি চালিয়ে তাঁকে খুন করার অভিযোগ ওঠে তাঁর স্বামী, বছর ছাপান্নের উত্তম বাকুলির বিরুদ্ধে। এর পরে ফুলবাগান থানায় গিয়ে রক্তাক্ত ছুরি জমা দিয়ে স্ত্রীকে খুন করার কথা জানায় উত্তম। খুন করার পরে সে নিজেও বিষ খেয়েছে বলে দাবি করে। বাবিকে রক্তাক্ত অবস্থায় ইএম বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উত্তমকেও সেই হাসপাতালেই ভর্তি করায় পুলিশ। কিন্তু পরে তার ছেলে অভিষেক বাবার চিকিৎসার খরচ বহন করতে রাজি না হওয়ায় উত্তমকে বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে খবর। বেসরকারি হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাদের বিল মিটিয়েছে বিমা সংস্থা।
কেন এমন কাণ্ড ঘটাল উত্তম, সে নিয়ে রহস্য ছিল। অভিষেক জানান, উত্তম আগে বাস চালাত। পরে কাজ ছেড়ে দেয়। ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পরে আরও কাজ-বিমুখ হয়ে যায় উত্তম। সংসার টানা থেকে দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ চালানো— সবই তাঁর মা একার হাতে করেছেন বলে দাবি অভিষেকের। রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র অভিষেক বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে যুক্ত। পড়া শেষ করে উত্তমের ভাই উজ্জ্বলও দাদার সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন। অভিষেকের কথায়, ‘‘ছোট্ট ঘরে থাকতাম। মা বলত, ছেলেরা বড় হলে তাঁর দুঃখ ঘুচবে। কাজ করে টাকা জমিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনি। সেটা মায়ের নামেই কিনেছি। এই নিয়েই বাবার সঙ্গে রাগারাগির শুরু। বাবা যাতে কোনও রকম হীনমন্যতায় না ভোগে, তাই প্রতি মাসে ন’হাজার টাকা করে তার হাতে দিতাম। মাকেও পাঁচ হাজার টাকা করে দিতাম হাত খরচের জন্য।’’
ছেলের অভিযোগ, প্রতিদিনই মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে ঝামেলা করত উত্তম। স্ত্রী বাবির সব কিছুতেই তার সমস্যা ছিল। অভিষেক জানাচ্ছেন, তাঁর মা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মহিলা সমিতি করতেন। তাই লোকজনও তাঁকে পছন্দ করতেন। সেটাও উত্তম ভাল ভাবে নিতে পারত না। এর মধ্যেই মঙ্গলবার ওই কাণ্ড। অভিষেকের কথায়, ‘‘বাবা সারা দিন অপরাধমূলক সিরিয়াল দেখত। সেই থেকেই এমন কাজের পরিকল্পনা করল কি না, বুঝতে পারছি না। বিষ খাওয়ার পরে বুঝেছিল, আমাদের বলে লাভ হবে না। বরং পুলিশকে বললে পুলিশ অন্তত হাসপাতালে ভর্তি করাবে। সে এখন বাঁচল না মরল, তার খোঁজও নিতে যাব না।’’
মায়ের শেষকৃত্য করে এসে এ দিন কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই যুবক। পরে বলেন, ‘‘কিছু দিনের মধ্যেই আমার বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু এর পরে কী হবে জানি না। এক বার ধর্ষণের চেষ্টায়, আর এক বার স্ত্রীকে সরাসরি খুনের দায়ে গ্রেফতার হওয়া কোনও ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে কি কেউ তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন!’’