কালীঘাট পরিহরি বেয়ে চলে দ্রুত তরী
মহা আনন্দিত সদাগর।
বাজে দামা দড় মাশা বামে রহে গ্রাম রসা
গীত গায় গাঠের গাবর।
সাকুভাকু সার ডাঁটা বাহিল বৈষ্ণবঘাটা
করে সব হরি হরি রব।।
বারুইপুরের পর রত্নাকর সওদাগর
সাধুঘাটা করিল পশ্চাৎ।
বারাসাত গ্রামে গিয়া নানা উপহার দিয়া
পূজা কৈল অনাদী বিশ্বনাথ।
মনসামঙ্গল , চৈতন্যচরিতামৃত , চন্ডীমঙ্গল ছাড়াও অষ্টাদশ শতকে লেখা কবি #অযোধ্যারামপাঠকের #সত্যনারায়ণেরপাঁচালিতে রত্নাকর সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রার পথের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বৈষ্ণবঘাটা, বারুইপুর, বারাসাত ইত্যাদি বর্ধিষ্ণু গ্রামের উল্লেখ করেছেন। অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে রচিত #দ্বিজ_হরিদেবের #শীতলামঙ্গল কাব্যেও সমুদ্রমুখী ভাগীরথীর বামতীরে বৈষ্ণবঘাটা গ্রামের বর্ণনা রয়েছে। ভাগীরথী সে সময় শীর্নকায়।
ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত গঙ্গানদীর ধারা রাজমহলের পাহাড় অতিক্রম করার পর থেকে বর্তমান মালদহ জেলায় অবস্থিত প্রাচীন গৌড় নগরীর উত্তর দিক থেকে এসে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হত।বর্তমান কালে চল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে সরে এসে গঙ্গা মুর্শিদাবাদ জেলার সুতীর নিকট দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে। দক্ষিণ পশ্চিম মুখী ধারাটি #ভাগীরথী নাম নিয়েছে। পূর্ব দক্ষিণ মুখী ধারাটির নাম #পদ্মা।
বারো বছর বয়সে কবি #কৃত্তিবাস নদিয়ার গঙ্গাতীরে ফুলিয়া গ্রাম থেকে পড়াশোনা করার জন্য পদ্মা পার হয়ে গৌড়ে যান। তিনি গৌড়ের #রাজা_গণেশের সভায় গিয়ে রামায়ন রচনা করেছিলেন।
তাই তো কৃত্তিবাস লিখেছেন :
পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড় গঙ্গা পার।
ছোট গঙ্গা বড় গঙ্গা বড় বলিন্দা পার।।
ছোট গঙ্গা অর্থে ভাগীরথী । বড় গঙ্গা অর্থে পদ্মা। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় পদ্মার প্রবাহ ভাগীরথীর তুলনায় প্রবলতর ছিল। আমাদের নিকট গঙ্গার স্রোত ধারা অর্থেই পবিত্র।
গঙ্গা ভাগীরথীর সমগ্র প্রবাহপথেই বহু তীর্থভূমি, দেবালয়, জনপথ, ব্যবসাকেন্দ্র যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , আদিগঙ্গার দুই তীরে তেমন কেবল মন্দির ও শ্মশান নয় ,তৎকালীন উন্নত জনবসতির সর্ববিধ উপকরণের নিদর্শন রয়েছে।কালীঘাট থেকে সুচিত হয়ে রসা, বৈষ্ণবঘাটা, ফরতাবাদ, বোড়াল , রাজপুর, হরিনাভি, গোবিন্দপুর , আটিসারা এবং আরো দক্ষিণে জয়নগর মজিলপুর থেকে সমুদ্রের মোহনা পর্যন্ত আদিগঙ্গার তীরে প্রাচীন সভ্যতার বহু চিন্হ পাওয়া গিয়েছে।
সামুদ্রিক প্লাবন , বিধ্বংসী ঝড়, ভূমির অবনমন এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে এই সকল জনবসতি ভিন্ন ভিন্ন সময় লুপ্ত হয়ে গেছে। দক্ষিণবঙ্গের এসকল অঞ্চলে নরগোষ্ঠীগুলির বাস ছিল প্রধানত ছিলেন অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। কাওড়া, বাগদি, হাড়ি ডোম, বাউড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায় এঁদেরই বংশধর।
বোড়াল থেকে শুরু করে বারুইপুরের কাছে আটঘরা বা আটিসারা পর্যন্ত আদি গঙ্গার তীরবর্তী যে অসংখ্য প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে নিঃসংকোচে বলা চলে মৌর্য , শুনগ , গুপ্ত, পাল, ও সেন যুগে এসকল অঞ্চলে সমৃদ্ধ সভ্যতার অস্তিত্ব সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। মধ্যযুগেও এসকল অঞ্চল শিল্পকলা, সাহিত্য, বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল। মঙ্গলকাব্যগুলি তার জাজ্জ্বল্য প্রমান।
আদিগঙ্গার প্রবাহপথে প্রায় সমান্তরাল একটি রাস্তা প্রাচীন কাল হতে ছিল যার নাম #দ্বারিরজাঙ্গাল। পরবর্তী সময় অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতকেও কলকাতার দক্ষিণে এই জনপথ বিশেষ করে বৈষ্ণবঘাটা, বোড়াল , রাজপুর, হরিনাভি, গোবিন্দপুর অঞ্চল শুধুমাত্র প্রাচীন শাস্ত্রচর্চা নয় , আধুনিক সভ্যতায় আলোকিত হয়ে ঊনবিংশ শতকের নবজাগরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। #রাজনারায়নবসু, #পন্ডিতশিবনাথশাস্ত্রী, #দ্বারকানাথবিদ্যাভূষন, #রামনারায়ণতর্করত্ন, #ভরতচন্দ্র_শিরোমণি প্রভৃতি বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত ও সমাজ সংস্কারকের জন্ম গড়িয়া থেকে বোড়াল , লাঙ্গলবেরিয়া, কোদালিয়া , হরিনাভি, মালঞ্চ – আদিগঙ্গার তীরে এই ভূখণ্ডটির মধ্যেই।
কোদালিয়া গ্রাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পিতা #জানকীনাথবসুর জন্ম স্থান। ব্যাপক ও গভীর সারস্বত সাধনার নিমিত্ত রাজপুর হরিনাভি অঞ্চলটি #দক্ষিণেরনবদ্বীপ নামে সুবিখ্যাত ছিল ।
প্রাচীন ভাগীরথীর যে অংশটিযে আদিগঙ্গা বলা হত , অর্থাৎ হেস্টিংস থেকে কালীঘাট , গড়িয়া হয়ে ছত্রভোগ, খাঁড়ি অতিক্রম করে সমুদ্রের মোহনা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল একসময় সুন্দরবনের অন্তর্গত ছিল। দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলির ভাঁটা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হত। সেই কারণেই একে #ভাটির_দেশ বলা হত।
আরো একটি কথা বলে রাখি। এসকল অঞ্চল যেমন বিখ্যাত ছিল আবার একটি কারনে একসময় কুখ্যাত হয়েছিল। কারন ছিল জলদস্যুতা। সপ্তদশ শতকে কলকাতা পত্তন হলে তাকে কেন্দ্র করে পর্তুগিজ #বোম্বেটে ও মগ জাতি ব্যাপক লুন্ঠন কার্য চালাত গঙ্গার বুকে। মাঝদরিয়ায় মৃতদেহ ভেসে যেত কত শত……
এহেন ঐতিহাসিক বৈষ্ণবঘাটা- রথতলার রথের মেলা এবং দুর্গাপুজো শতাধিক বছরের প্রাচীন। এখানে ডাকের সাজের দুর্গা পূজার প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ।
প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্দেশ্য নিয়ে বৈষ্ণবঘাটায় খনন কার্য আজঅব্দি হয়নি । বৈষ্ণবঘাটা সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিভিন্ন প্রাচীন মানুষের কাছ থেকে এবং যেটুকু ইতিহাস রচনার হয়েছে বা মঙ্গলকাব্য গুলিতে যা তথ্য পাওয়া যায়, তা থেকে জানতে পারা যায় বৈষ্ণবঘাটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। সেই গ্রামে #বড়পুকুর ও #কোটাপুকুর খননের সময় পোড়ামাটির বাসন ,লোহার তৈরি জালের কাঠি, নৌকার ভাঙা গলুই ,কিছু প্রাচীন তাম্র মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল । সেগুলো কোথাও সংরক্ষিত হয়েছে কিনা তা জানতে পারা যায় না….
উক্ত আলোচনা থেকে অনুমান করা যায় যে সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকের বৈষ্ণবঘাটা অঞ্চলে যে আধুনিক মানব বসতি শুরু হয়েছিল তারও বহু বহু বছর, প্রায় ৪০০ ,৫০০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকের এখানে নদীকেন্দ্রিক জনবসতি ছিল । এসকল অঞ্চলের প্রাচীন বসতির মধ্যে প্রধানত ছিল জেলে, চাষী, তাঁতী,কুমোর প্রভৃতি গ্রাম্য #কারিগর সম্প্রদায়ের মানুষ। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে শ্রীচৈতন্যদেব যখন এখানে এসেছিলেন তখন এইসব অরণ্যচারী মানুষেরা এখানকার প্রধান বাসিন্দা ছিলেন । চাষবাস, পশুপালন ও মৎস্য শিকারই ছিল প্রধান জীবিকা।
এই পরিশ্রমী মানুষদের লৌকিক সংস্কৃতি বেশ কিছু চিহ্ন এখানকার জনজীবনে আজও প্রতিফলিত হয়। আর তারই নিদর্শন হলো ওলাইচন্ডী ,বনদেবীর পুজো করা ।মনে রাখা দরকার প্রবল ভাগীরথী নদী এই বৈষ্ণবঘাটার পাশ দিয়ে দক্ষিণমুখী বাঁক নিয়েছিল ।এই অঞ্চলটি সুন্দরবন অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল ।সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে এখানে যারা বসতি করেছিলেন তাদের উত্তর পুরুষদের বর্তমানে এখানকার আদি বাসিন্দা বলা হয় ।
হাওড়া, হুগলি এবং ২৪ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মন ও কায়স্থরা এখানে এসেছিলেন ।পূর্বেই বলেছি বৈষ্ণবঘাটা একসময় সংস্কৃত চর্চার ক্ষেত্র ছিল। এখানে বেশ বিখ্যাত কয়েকজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের বাস ছিল। সংস্কৃতচর্চা ও শাস্ত্র আলোচনার জন্য বৈষ্ণবঘাটা বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। এই সব পন্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আত্মীয়তা ও জ্ঞানচর্চার সূত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল নবদ্বীপ,
ভাটপাড়া ,হালিশহর এবং দক্ষিনের নবদ্বীপ অর্থাৎ রাজপুর হরিনাভি অঞ্চলের বিশিষ্ট পণ্ডিতদের সঙ্গে। বৈষ্ণবঘাটায় একসময় #টোল স্থাপিত হয়েছিল সংস্কৃত মাধ্যমে শিক্ষা দানের জন্য।
শ্ৰী দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন , রামকমল ভট্টাচার্য , রামধন বাচস্পতি, প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর এমনি সব সিংহের ন্যায় পন্ডিতদের আবাসভূমি ছিল দ্বিতীয় নবদ্বীপের বর্ধিষ্ণু অংশ রাজপুর। তাছাড়া এই সুবিশাল আদি গাঙ্গেয় অঞ্চলের সঙ্গে বঙ্গের নবজাগরণেরও একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী পাঠ করলে এই অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়
এই হেন বর্ধিষ্ণু আদি গঙ্গারতীর নানা সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিক ইতিহাস , জনশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তেমনি একটি আধ্যাত্মিক স্থান হল রাজপুর। ১৩১৩ বঙ্গাব্দে এখানেই জন্মেছিলেন শাক্ত সাধক নন্দদুলাল। তিনি সাধারণের নিকট বাবা দুলাল নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিপত্তারিণী দেবীর মন্দির রাজপুর , সোনারপুর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে খুবই জাগ্রত এবং পবিত্র উপাসনা স্থল।
সাধনচন্দ্র দাশ এবং বাসন্তীকুমারী দেবীর সন্তান হলেন নন্দদুলাল। রাজপুরেই তাঁর পৈতৃক ভদ্রাসন। নন্দদুলাল এঁদের প্রথম সন্তান ছিলেন। গর্ভস্থ অবস্থায় মাতা তাঁর প্রসর মোটেই অনুভব করতে পারতেন না। কেউ কেউ বলতেন যোগী ঋষিরা যখন দ্বিতীয় জন্ম নেন তখন মাতৃ জঠরে ধ্যানস্থ থাকেন, ফলে মা সন্তানের প্রসর অনুভব করতে পারেন না। ফলত, ১৩২৩ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংক্রান্তির দিন যখন নন্দদুলাল জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হলেন তখন পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন এমনকি গ্রাম বাসীর আনন্দের সীমা ছিল না। সকলে তাঁকে আদর করে দুলাল নামেই ডাকতেন।
চার বৎসর বয়সে দুলাল গাঁয়ের হেম চক্রবর্তীর পাঠশালে ভর্তি হন। তখন শীত কাল। পৌষের প্রবল শীতের এক সকালে গুরুদেব বললেন, “পাঠশাল আজ ছুটি। রাতে জগন্মাতা রক্ষাকালী পুজো হবে।” দুলাল ভাবলে জগন্মাতা মানে এই জগতের মা। তাঁর পুজো হবে। বেশ হবে। তাঁরই নাম বুঝি রক্ষাকালী। কেমনতর দেখতে হবে চিন্ময়ী মায়ের সেই মৃন্ময়ী মূর্তি খানি। অদ্য রাত্রে আমি পুজো দেখতে আসব।
সেদিন ছিল শনিবার। দুলালের পিতা সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকুরি করতেন। প্রতি শনিবার পুত্রের জন্য নানাবিধ উপহার নিয়ে শহর হতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন। সেদিন মাতৃরূপ দর্শনে ব্যাকুল দুলাল মনে মনে ভাবল, আজ পিতা ফিরলে কোনো।উপহার নেব না , কেবল পাঠশালে পুজো দেখানোর নিমিত্ত আবদার করব। কারণ শীতের রাতে নিঝুম গাঁয়ের পথে একলা আসা যাবে না। সেটাই হবে আমার উপহার। যথারীতি পিতা সাধন গৃহে ফিরলে দুলাল বায়না জুড়ে বসল জগন্মাতার পুজো দেখতে যাওয়ার জন্য।
সেসময় বঙ্গের গাঁ ঘরে যা শীত পড়ত তাতে ব্যাঘ্র পালাত কিনা জানি না , তবে খুব দরকার না পড়লে তারাও ডেরা থেকে বেরত না। শীতল রাত্রে সাধারণ মানুষ পুজো দেখার অধিক নিজের কম্বল, কাঁথা, গৃহের উষ্ণতাকেই পছন্দ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে কিছু মানুষ এই পৃথিবীর বুকে আসেন কেবলমাত্র ঈশ্বরকে ভালবাসতে। তেমনি একজন ছিলেন এই নন্দদুলাল। রাতের বেলা ঢাক কাঁসরের শব্দ শুনে পিতার সঙ্গে পাঠশালের অভিমুখে চললেন।
সেখানে গিয়ে দেখলেন , ওমা… এ যে দক্ষিণা কালী। এই কালীর পুজোতেই তো বাজি পোড়ানো হয়। ইনি আবার রক্ষা করেন নাকি? ইনি কি জগন্মাতা? এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলেন দুলাল। এদিকে শীতের প্রকোপ রাতের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুত গৃহে না ফিরলে যদি ছেলে জ্বর, নিমিউনে হয়…. সে চিন্তায় সাধনচন্দ্র অধিক সময় পুজোর জায়গায় থাকতে চাইলেন না। ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফেরার পথ ধরলেন। কিন্তু ফেরার পথে ছেলে পিতার নিকট বায়না ধরল যে, সেও জগন্মাতার পুজো করবে। সে শুনে পিতা সাধন কোনোক্রমে সেই রাত্রে ছেলেকে ভুলিয়ে ঘরে আনলেও পরের দিন ছেলে ঘুম থেকে উঠেই সেই বায়না ধরল। দুলালকে ভুলিয়ে পিতা তাঁকে পাঠশালে যাবার সময় কিছু পয়সা দিলেন বন্ধুদের সঙ্গে জলখাবারে কিছু কিনে খাওয়ার জন্য।
কিন্তু দুলাল তার থেকে একটা কড়িও নষ্ট না করে পাঠশাল শেষে সোজা গাজীপুর পটুয়াতলায় হাজির হলে। সেখানে তখন অতো সামান্য পয়সায় কে তাঁকে মূর্তি দেবে? সকাল গড়িয়ে দুপুর , দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। কেউ তাকে সামান্য পয়সায় মূর্তি তবুও দুলাল এক পটুয়ার পায়ে পড়ে কেঁদে কেটে একটি ছোট্ট কালীমূর্তি সংগ্রহ করে ঘরে ফিরলেন।
শীতের বেলা , এমনি ছোট। দিগন্ত রেখা রক্তিম করে অন্ধকার নেমে এল। খোকন রে তুই ঘরে আয় বলে কেঁদে কেঁদে মা বসন্তকুমারী সারা হলেন। অবেশেষে সন্ধ্যার আঁধার কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন দুলাল। বুকের কাছে ধরে আছেন তাঁর জগন্মাতা। তাঁরা দাশ, তাঁদের বংশে কস্মিনকালেও কেউ কালী পুজো করেন নি। সুতরাং বলতে গেলে কালিকা উপাসনার অধিকার তাঁদের নেই। খেলার ছলে পুজো করে যদি কোনো ক্ষতি হয়। ছেলেকে গঙ্গার বুকের মূর্তি ভাসিয়ে আসতে বললেন মা। কিন্তু ছেলে কোনো কথা শুনলে না। বুকে মহামায়াকে ধারণ করে উঠোনে পাছড়িয়ে কাঁদতে বসল। ছেলের প্রচণ্ড জেদ দেখে মা লাঠি দিয়ে প্রহার শুরু করলেন। এত প্রহার করলেন অন্য কেউ হলে হয়তো জ্ঞান হারাত। কিন্তু দুলাল নির্দ্বিধায় মার খেয়ে গেলেন। মার খেল দুলাল, কিন্তু লাঠি ভাঙল। মা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। তারপর কি হল? দুলাল কি জগন্মাতাকে নিজের মতো করে কাছে পেলেন?
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী