অবশেষে সুবাতাস! স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আর্থিক গবেষণা বিভাগ থেকে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে ভারতে আর্থিক বৈষম্য কমেছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নেওয়া পরিসংখ্যান বলছে রাজ্যওয়াড়ি ও অন্যান্য গড় আয়ের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা জিনি সূচক এই বৈষম্য কমছে বলেই নির্দেশ করছে।
জিনি সূচক কী? জেনে রাখুন এই সূচক যখন ০ তখন বৈষম্য নেই আর যখন ১০০ তখন বৈষম্য তীব্র। আর এই সূচক তৈরি হয় দেশের আয়ের কিছু গড় পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে।
কিন্তু এই দাবির সঙ্গে যখন বাস্তবকে মিলিয়ে নিতে যাচ্ছি সমস্যা হচ্ছে তখনই। আর্থিক বৈষম্য যদি কমবেই তা হলে সারা দেশে পিছিয়ে পড়া জেলার সংখ্যা বাড়বে কেন? সরকারি পরিসংখ্যাই বলছে সারা দেশে পিছিয়ে পড়া জেলার সংখ্যা ছিল ১১২, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩ তে! অনগ্রসর জেলার অঙ্ক নির্ভর করে, সেই জেলার কৃষি পণ্যের উৎপানশীলতা, দারিদ্র, সাধারণ ও সামাজিক পরিকাঠামোর উপর।
আর্থিক বৈষম্যের মানে তো সোজা। দেশের সাধারণ মানুষ দিন যাপনের জন্য কতটা আর্থিক অধিকার ভোগ করছে। অর্থাৎ সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে স্কুলের খরচ দিতে গলদঘর্ম হচ্ছে কিনা, শরীর খারাপ হলে চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা, বৃদ্ধ বয়সে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে কিনা, ইত্যাদীই তো নির্ধারণ করে বৈষম্যের তীব্রতা। যে দেশে বৈষম্য কম, সেই দেশে সাধারণের আর উচ্চবিত্তের আর্থিক অধিকারে কোনও বৈষম্য থাকে না। বিনা চিকিৎসায়, বা অপুষ্টিতে মরার সম্ভাবনা থাকে না। শিক্ষার অধিকার পকেটে রেস্তর অভাবে খর্ব হয় না। এবার যদি দেখা যায় যে পিছিয়ে পড়া জেলার সংখ্যা বাড়ছে, তাহলে তার সঙ্গে আর্থিক বৈষম্য কমার দাবি মেলাই কী করে? পিছিয়ে পড়া জেলার সংখ্যা বাড়া মানেই তো আরও বেশি সংখ্যার মানুষের সাধারণ জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাওয়ার অধিকার কমে যাওয়া। আর তাই যদি হয় তাহলে বৈষম্য কমার অঙ্কটা কী করে মেলাই?
আরও আছে। শুধু আর্থিক অঙ্কে প্রান্তবাসীর সামাজিক পরিষেবার অধিকার হারানোর কথাই নয়, শহুরে মানুষের ক্ষেত্রেও অঙ্কটা মেলানো কঠিন হয়ে উঠছে। ২০১৭ সালের পর থেকেই বেকারের সংখ্যা ৭ শতাংশের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সমস্যাটা এতটাই তীব্র যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সরকারি কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। আগামী দেড় বছরে আরও ১০ লক্ষ সরকারি কর্মসংস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অথচ সরকারি সংস্থাগুলিতে তো কর্মী কমানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। সরকারি সংস্থায় কাজের তুলনায় কর্মী বেশি না কম এই তর্কের মধ্যে না গিয়ে যেটা পরিষ্কার তা হল দেশের কর্মসংস্থানের হাল যা তাতে ভোটের আগে এই ঘোষণা হয়ত রাজনৈতিক। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক ঘোষণাই (বিশেষ করে এই জাতীয়), করা হয় না যদি না নাগরিককে তুষ্ট করার প্রয়োজন থাকে। যদি বাজারে যথেষ্ট কাজের সুযোগ থাকত তাহলে অবস্থানের বিপরীতে হেঁটে নাগরিককে তুষ্ট করতে প্রধানমন্ত্রীকে এই ঘোষণা করতে হত কি?
দেশে চাহিদার তুলনায় কর্মসংস্থান যদি অপ্রতুল হয়, তাহলে তো আয়েরও সমস্যা তৈরি হয়। আর যদি আয় অপ্রতুল হয় তাহলে আর্থিক অধিকারও খর্ব হয়। তাহলে কি বৈষম্য বাড়ে না কমে?
আরও আছে। আর্থিক উপদেষ্টা সংস্থা মোতিওয়াল অসওয়াল বলছে ভারতে নাকি চিকিৎসার খরচ বাড়ছে ১৪ শতাংশ হারে। এই হার নাকি এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক। সাধারণ পণ্যের দামও বাড়ছে লাফিয়ে। সাধারণের জন্য প্রোটিনের অন্যতম সূত্র ডিমও আজ সাত টাকা ছুঁতে চলেছে। এবার যদি আয়ের হার বাড়ার অঙ্ক করি তা কিন্তু এর ধারে কাছে গিয়ে পৌঁছয় না। পরিসংখ্যান বলছে এই আর্থিক বছরে গড় মাইনে বাড়ার হার ১০ শতাংশ ছাড়াবে। অত্যন্ত সুখবর। কিন্তু পাশাপাশি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ২২ শতাংশ কর্মী। অর্থাৎ যাঁর চাকরিতে থাকলেন তাঁদের মাইনে বাড়ল, আর আয়হীন হলেন ২২ শতাংশ। মানে তো একটাই। সম্পদের অধিকার আরও কুক্ষিগত হল।
ভারতের উন্নয়নের সমস্যাটা এখানেই। ভারতে যখন আয়ের পিরামিডের প্রথম ১০ শতাংশ দেশের ৫৭ শতাংশ বিত্তের অধিকারী তখন ইউরোপের সেই ১০ শতাংশই দেশের ৩৬ শতাংশ বিত্তের অধিকারী।
তাহলে স্টেট ব্যাঙ্কের অঙ্ক কি ভুল? পরিসংখ্যানের হিসাব হয়ত ঠিক, কিন্তু বৈষম্য মাপার অঙ্কে বোধহয় ঠিক নয়। পারিপার্শ্বিক অন্যান্য পরিসংখ্যান এই সূচককে মানতে দিচ্ছে না। তার কারণও আছে। জিনি সূচক হল এক গড়ের অঙ্কে। উন্নয়নের অর্থনীতি পাঠে তাই জিনি সূচককে কেউ একক ভাবে পড়ে না। এই সূচকে উন্নয়ন দেখালেও দারিদ্র বাড়তে পারে। জিনি সূচক যদি বলে বৈষম্য কমেছে, দৈনন্দিন জীবনের অঙ্ক কিন্তু অন্য কথা বলতে পারে। তাহলে জিনি সূচক ব্যবহার হয় কেন? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু সে আলোচনার পরিসর অন্য।