কোভিডের সময় যখন ভারতবর্ষ অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে‚ সেই সময়ের পত্র-পত্রিকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টিও নিশ্চয়ই আপনারা খেয়াল করেছেন? বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর সংগে দেশের নিরাপত্তা জড়িয়ে আছে। মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশ করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি কাশ্মীরে কয়েকজন রোহিঙ্গা ধরা পড়ায় সেই সমস্যা আবারও সবার সামনে এসেছে। এদেশে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেছে এই ঘটনায় কিছু লিবারেল বিশ্বমানব খুশি হলেও দেশপ্রেমিক ভারতবাসী যে কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন হবেন তা বলাই বাহুল্য।
মায়ানমারে তাদের অপকর্ম আর বাংলাদেশে তাদের ব্যপক উচ্ছৃঙ্খলতার কথা সবার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে অতি লিবারেল বিশ্বমানবদের বক্তব্য ছিলো – রোহিঙ্গারা অতিদরিদ্র ও অনুন্নত সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই তারা উন্নত জীবন জীবিকার খোঁজে এ দেশে আসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। বিষয়টি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের বিষয় নায। এটা নাকি একান্তই মানবিকতার আবেদন।
কথায় তেমন একটা ভুল নেই। এই উদার মানবিকতা দেখিয়েই বকলমে সস্তায় শ্রমিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে জার্মানীসহ ইউরোপের কয়েকটি রাষ্ট্র জর্ডন, তুরস্ক ও উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত কয়েক লক্ষ শরনার্থীকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দেশগুলিতে অস্বাভাবিকহারে অপরাধ বৃদ্ধি সহ সন্ত্রাসবাদী হামলায় শরনার্থীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে সেই সব দেশের নেতৃবৃন্দ প্রমাদ গুনছেন।
আর এর ফলে বৃটেন সহ কয়েকটি দেশ শরনার্থীদের স্বদেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে।
এমতাবস্থায় ভারতেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে চিন্তা থাকাটা স্বাভাবিক। ২০১৭ সালে মায়ানমার যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। সে সময় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জনমত তীব্র আকার ধারণ করেছে সেই দেশে। সেটা ছিলো আমার স্বল্পকালীন ধর্মীয় সফর। তাই বিষয়টি নিয়ে বেশী অনুসন্ধান করা যায়নি। সাধারণত মানুষের সংগে কথা বলে যেটুকু জানা গিয়েছিল তাতে তাদের উদ্বেগের কারণটি যে অমুলক নয় তা বোঝাই যাচ্ছিল। মায়ানমারবাসীদের মতে রোহিঙ্গারা হল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আসা মুসলমান অনুপ্রবেশকারী। আবার একই অঞ্চল থেকে আগত হিন্দুদেরও ওরা রোহিঙ্গাই বলে থাকেন। অর্থাৎ বর্মা বাসীদের কথায় রোহিঙ্গা হল বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলমান ও হিন্দু অবৈধ অনুপ্রবেশকারী! এটা কোন একটি নির্দিষ্ট জাতি বিশেষ নয়। এদেশের অনেকে তাদের একটি জাতি বলে মনে করেন।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ হিসেবে নানারকম মতামত জানা গেল। রাখাইন প্রদেশকে একটি আলাদা মুসলমান রাষ্ট্র বানানোর জন্য রোহিঙ্গাদের পরিকল্পনাটি বিগত দু-দশক ধরে মায়ানমার সরকারের নজরে আসে এবং এই বিষয়ে বিদেশি সাহায্যে পুষ্ট রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা প্রমানিত হতে থাকে। ফলে মায়ানমার সরকার ও জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে জীবিকার সন্ধানে রোহিঙ্গারা অনুন্নত রাখাইন প্রদেশ ও
তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে বর্মার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে দেশের মূলনিবাসীদের তুলনায় তাদের মজুরী কম হওয়ায় বর্মীজরা ক্রমাগত কাজ হারাতে থাকে। স্থানীয় মুসলমানদের সহায়তায় কেউ কেউ ব্যবসাও শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের চেষ্টায় কিছু মসজিদ গড়ে ওঠে। বাঙ্গালাদেশে মন্দির সংলগ্ন স্থানে মসজিদ আর কসাইখানা বানানোর পদ্ধতিতেও সেখানেও মসজিদগুলো বুদ্ধ মন্দিরের নিকটবর্তী স্থানে তৈরী হচ্ছিল। প্রাথমিক দিকে তা নিয়ে আপত্তি উঠলেও শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধরা তা মেনে নিয়েছিল। তবে বিরক্তি যে ছিল তা বলাই বাহুল্য।
রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা বর্মীদের সেই অসন্তোষের আগুনে ঘৃতাহুতি করেছে। মায়ানমারে নারী সমাজ যথেষ্ট উন্নত এবং সমাজে শুধু সমানাধিকারই নয় বরং উচ্চস্থান লাভ করে। প্রাচীন বৌদ্ধ সংস্কৃতির দেশ মায়ানমারে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বিরলতম বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু গত এক দশকে এরকম যতগুলি ঘটনা সরকারী স্তরে নথিভুক্ত হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার প্রমাণ ছিলো। ফলে অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। এ সবের বিরুদ্ধেই বৌদ্ধ সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ নামে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্ব দেওয়ায় মিডিয়া এই প্রতিরোধকে বৌদ্ধ সন্ত্রাস নাম দিয়েছে।
সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে যে সমাজই প্রতিরোধ করুক না কেন তা অবশ্যই সমর্থন যোগ্য। একে খৃষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ বা হিন্দু সন্ত্রাস নাম দেওয়া ঘটনার দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘোরানোর প্রয়াস মাত্র।
মায়ানমারের জনগণ ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিপন্ন হতে বাধ্য। একজন বৌদ্ধ কখনও আক্রমনাত্মক হতেই পারেন না। শত অত্যাচারেও নয়। কিন্তু আত্মরক্ষার অধিকার তার আছে। মগধ রাজ্য যখন শ্যাক্য বংশীদের বিনাশে উদ্যত হলেন তখনও শাক্যমুনি বুদ্ধ তার স্বজাতিকে বলেছিলেন – ” আক্রমন নয়, আত্মরক্ষা কর”। মায়ানমারবাসীরাও তো তাই করেছেন। কিন্তু তাদের এই আত্মরক্ষার প্রয়াসকে বৌদ্ধ সন্ত্রাস নাম দিয়ে কলসিত করার চেষ্টা চলছে।
রোহিঙ্গারা শুধু বর্মা পুলিশ, সেনা এবং জনগণকেই তাদের নিশানা করেনি। রোহিঙ্গা হিন্দুদের ও গনহত্যা করেছে তারা। অথচ ভারতের পত্রপত্রিকায় বিষয়টিকে এমন ভাবে পরিবেশন করা হল যে পাঠকরা বুঝতেই পারেননি, ঠিক কারা তাদের হত্যা করল। কিছু ভারতীয় মিডিয়ার এই দ্বিচারিতা হতাশাজনক। এই বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের সামান্য অংশও যদি যদি সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়েন তবে তাদের খুঁজে বের করাও সহজ হবে না। করন তাদের চিহ্নিত করার মতো কোনো কাগজপত্রই নেই। একটি সম্প্রদায়ের সকলেই অপরাধী বা সন্ত্রাসবাদী হবে না তা জানা কথা। তবু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে জনগণ এবং রাষ্ট্রকে সাবধানে থাকতেই হবে।
লামা বর্জ্রপাণি