জাতীয় সঙ্গীতকে যিনি ভালোবাসেন না, তিনি কি শিল্পী?

বাংলাদেশিরা ইস্যু ভিত্তিক জাতি। তারা ইস্যু চান। একটার পর একটা ইস্যু না হলে তাদের চলে না! একটা ইস্যু এলে আগেরটা চাপা পড়ে যায়? মাদ্রাসায় হুজুরদের ধর্ষণ ও বলাৎকার নিয়ে যখন হৈচৈ হচ্ছে, তখন প্রিয়া সাহা এসে সবকিছু ওলট-পালট করে দিলেন। হুজুর উপাখ্যান চাপা পড়ে গেলো। তারপর এলো ডেঙ্গু ইস্যু, প্রিয়া সাহা তাই বাই বাই করছেন। মধ্যখান থেকে নোবেল জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে মন্তব্য করে নতুন ইস্যু সৃষ্টি করলেন। এক সাক্ষাৎকারে গায়ক মইনুল হোসেন নোবেল বলেছেন : “রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা’ যতটা না দেশকে এক্সপ্লেইন করে তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণে এক্সপ্লেইন করে প্রিন্স মাহমুদ স্যারের লেখা ‘বাংলাদেশ’ এই গানটা”। এই বক্তব্যের মধ্যে হয়তো না বলা অনেক কথা আছে। বাংলাদেশে নোবেলকে কেউ চিনতো না, সারে গামা তাকে চিনিয়েছে। অথচ সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্যে সারেগামার প্রতি উত্মা আছে?
নোবেল ভালো গায়, গলাটা দরাজ। কিন্তু গায়ক? এত তাড়াতাড়ি? একজন মন্তব্য করেছেন, সরকারের উচিত নোবেলকে ‘বাড়িগাড়ি দিয়ে সম্মান করা? পাল্টা অন্য একজন বলেছেন, ক্রিকেট টিমকে আমরা বাড়িগাড়ি সব দিয়েছি, যাতে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে নাকানি-চুবানি খেতে পারে? একজন লেখেন, “হে বঙ্গজননী, লক্ষ কোটি নোবেল বানিয়েছে, বাঙ্গালি বানাওনি। আমি গান বুঝি না, কিন্তু গান পছন্দ করি বটে! আচ্ছা নোবেল কি ভালো গায় ? অবন্তী ও নোবেলকে সারেগামায় দেখে দেশি হিসাবে ভালোই লেগেছে, কিন্তু এঁরা ফাইনাল পর্যন্ত যাবে তা ভাবিনি। আমি নিয়মিত টিভি দর্শক নই, সবটা দেখিনি, জানিও না, নোবেলকে ফাইনালে দেখে অবাক হয়েছি, কিছুটা খুশিও। অঙ্কিতার ধারে কাছে কি নোবেল আছে? নোবেলকে আমার প্রফেশনাল মনে হয়নি, বরং অ্যামেচার মনে হয়েছে।
নোবেল আমেরিকায় আসছেন। শুনলাম, ফোবানা এবং পূজা সমিতিতে গান গাইবেন। পরে জানলাম, জাতীয় সংগীত নিয়ে তাঁর মন্তব্যের পর পূজা সমিতি’র ওপর চাপ পড়ছে। পূজা সমিতি নিউইয়র্কে প্রথম সংগঠন যারা বাংলাদেশ থেকে শিল্পী আনার রেওয়াজ চালু করে, তাদের ওপর চাপ থাকাটা স্বাভাবিক। শেষমেষ তারা নোবেলকে বাদ দিয়েছেন জেনে ভালো লেগেছে। তাদের অগ্রিম দেয়া টাকা মার গেছে। ফোবানা’র কথা জানি না, কারণ অনেকগুলো ফোবানা’র প্রায় সব কটি এন্টি আওয়ামী লিগ বা বঙ্গবন্ধু বিরোধী। নোবেল কোনো ফোবানায় গান গাইলে তারা নতুন করে আবার সেই কথা। প্রমাণ করবেন। না গাইলে তাদের আগাম ধন্যবাদ।
মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী তাজুল ইমাম নোবেলের ওপর বেজায় ক্ষেপেছেন। তিনি লিখেছেন, “শ্রীকান্ত আচার্যবাবু, আপনারা আমাদের আবাল পোলাডারে গায়ক বানানোর নামে রাম ছাগল বানাইয়া দিলেন। অহন সে জাতীয় সঙ্গীত ম্যারামত করতে। চায়। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত জামাতিদের খুবই অপছন্দ। এরা বহুবার প্রস্তাব দিয়েছে বদলে ফেলার জন্য। জিয়াউর রহমানকে আলি আহসান মুজাহিদ এবং নিজামী মন্ত্রী থাকাকালে প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিল কিন্তু জিয়ার সাহসে কুলায়নি। ক্ষেপেছেন আরো অনেকে, যা স্বাভাবিক। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত, বঙ্গবন্ধু নিয়ে কারো কোনো বিরূপ মন্তব্য অসহ্য। অথচ নোবেল ঠিক সেই জায়গায় আঘাতটা হানলেন।
নোবেলকে টেনে তোলার জন্যে অনেকে মোনালী ঠাকুর ও শান্তনু মৈত্রকে গালি দিচ্ছেন, যা তাদের প্রাপ্য। নোবেল এক ধারার গায়ক। বাংলাদেশে কোনো টিভিতে সুবিধে করতে না পারলেও কলকাতায় গিয়ে নাম করেছেন। নাটক বা সিনেমায় আমাদের শিল্পীরা কলকাতায় ভালো করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একদা হঠাৎ তাদের ভেতরের রূপটা বেরিয়ে পড়ে। নায়ক ফেরদৌস ঠিক তাই করেছেন। নোবেল করলেন। এতে কি কলকাতায় আমাদের কদর কমবে না? দেশে বড়ো শিল্পী হবার সুযোগ তেমন নেই, ভারতে গিয়ে শিল্পী হবার সুযোগটাও আমরা নষ্ট করবো ? ধর্ম ব্যবসায়ীরা শিল্প জগতে সফল তেমন দৃষ্টান্ত কিন্তু নেই? কীর্তন বা নাদ যারা গায় তারা শিল্পী বটে, কিন্তু তাদের শ্রোতারা ভিন্ন। সর্বজনীন শিল্পীকে ব্যক্তি ও পার্থিব, অপার্থিব জগৎ থেকে নিজেকে কিছুটা ওপরে তুলে নিতে হয়? নোবেল গোড়াতেই সেই ভুলটা করে ফেললেন। নিজের জাতীয় সঙ্গীতকে যিনি ভালোবাসেন না, সেই শিল্পীর কী প্রয়োজন? গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ বলে দিয়েছেন, ‘জাতীয় সঙ্গীত আমাদের অস্তিত্বের নাম। তাকে ধন্যবাদ। আসলে আহাম্মকরা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বানজরুলকে মুসলমান ভাবে। এরা যে ধর্মীয় গণ্ডির ঊর্ধ্বে এই বোধ নোবেল নামীয় উজবুকদের নেই! রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, তাই জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে? প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচয়িতা হিন্দু পানিনি, ওটা বাদ দিতে হবে! কোরানের বঙ্গানুবাদ করেছেন গিরিশচন্দ্র, ওটা বাদ যাবে? দিনক্ষণ, অর্থাৎ রবি, সোম, মঙ্গল-এগুলো তো হিন্দু পুরাণ থেকে নেওয়া, ওগুলো বাদ। আরে ব্যাটা, সূর্য তো হিন্দুদের দেবতা, ওটাও বাদ দিবি নাকি? সারেগামার ক’জনা অতি উৎসাহী বিচারক আমাদের একজন নব্য রাজাকারকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়েছেন, এখন তিনি লেডি গাগা ও শ্রেয়া ঘোষাল ছাড়া আর কারো সঙ্গে ডুয়েট গাইবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন, এমনকী মোনালি ঠাকুরের সঙ্গেও না? এখানে কি কিছুটা ধর্মান্ধতার গন্ধ আছে? এজন্যেই কি লোকে বলে, ‘কাঙালকে শাকের খেত দেখাতে নেই’?
শিতাংশু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.