“কাশ্মীরে যদি হিন্দু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হতো, তাহলে বিজেপি সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে স্পর্শও করত না। কিন্তু যেহেতু কাশ্মীরে মুসলমান সম্প্রদায়ই সংখ্যাগুরু, সেজন্যই বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে। বিশ্বের কোথাও কী এমন নজির আছে যেখানে পেশীশক্তির সাহায্যে কোনও দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে?”
“এক তরফাভাবে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিভক্ত করে দিয়ে জাতীয় সংহতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজই বিপন্ন হয়ে পড়ল। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জেলবন্দি করে এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিকে অস্বীকার করে বিজেপি জাতীয় সংহতি প্রচেষ্টাকেই পিছিয়ে ছিল। মনে রাখতে হবে ভারত তৈরি হয়েছে এর জনসমষ্টিকে নিয়ে। সেখানে কিছু জমির কিছু অংশই সব নয়। প্রশাসনিক ক্ষমতার এই অপব্যবহার আমাদের জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। কাশ্মীরের মূলস্রোতের জননায়করা ভিন্ন ভিন্ন অজানা এলাকায় জেলবন্দি হয়ে রয়েছেন। এই আচরণ শুধু অসাংবিধানিকই নয়, অগণতান্ত্রিকও। এটা দূরদৃষ্টির অভাব সঞ্জাত এবং তীব্র মূখামি। নেতৃত্বের এই ফঁক পূরণে এগিয়ে আসবে জঙ্গিরাই এবং তার দায় বর্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই।”
“আমি কোনোদিন ভাবতেই পারিনি ভারতবর্ষের মুকুট, ভারতবর্ষের মস্তিষ্ক জম্মু ও কাশ্মীরকে এভাবে হেঁটে ফেলা হবে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল সংক্রান্ত বিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সংসদে বিলটি পেশ করলেন, মনে হলো সশব্দে ফেটে পড়ল একটি আণবিক বোমা। জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ মুসলমান হয়েও কখনও পাকিস্তানভুক্ত হয়নি। তারা ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতাকেই আঁকড়ে থেকেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া পদক্ষেপ দেশের সংহতির ভিতটুকুকেই দুর্বল করে দিল। জাতীয় সংহতি বিল পাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় না। ওটা সম্পূর্ণভাবে আত্মিক বিষয়।”
‘জনগণের বিশ্বাস অর্জন না করে, রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা না করে, কাশ্মীরে ৪৫০০ আধা সেনা নিয়োগ করে কেন্দ্র যেভাবে ৩৭০ ধারা বাতিল-সহ কাশ্মীরকে দুভাগে বিচ্ছিন্ন করল, তাতে দেশকে একত্রিত করার বদলে উলটো পথেই হাঁটল কেন্দ্র। এখনই যদি পদক্ষেপ বদল না করা হয়, তাহলে জনগণ রাস্তায় নামবে দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করতে এবং এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করতে।”
“যদি সংখ্যাধিক্যের জোরই মূল শক্তি হতো, তাহলে মেনে নিতে হবে হিটলারও গণতন্ত্রের ধ্বজাবাহী ছিলেন। ভারতবর্ষে এখন যা হচ্ছে, তাতে মোদী এবং হিটলারের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”
“জম্মু ও কাশ্মীরে যখন ৩৭০ ধারা লাগু হয়েছিল, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তখন সংসদে আলোচনার সময় সর্দার প্যাটেল তো চেয়েইছিলেন যে কাশ্মীর পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হোক।”
এগুলো সবকটিই বিবৃতি। প্রথমটি কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের। দ্বিতীয়টি প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর। তৃতীয়টি কাশ্মীরের কংগ্রেস নেতা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদের। চতুর্থটি সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির। পঞ্চমটি সিপিআই-এর সর্বভারতীয় নেতা ডি রাজার এবং ষষ্ঠ বিবৃতিটি কংগ্রেসের প্রবীণ সাংসদ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বালের। | লক্ষণীয়, জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল, জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবং দুটি রাজ্যকেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার জন্য মোদী সরকারের ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেবার পর বিরোধী পক্ষের হাজারো বিবৃতির মধ্যে এগুলো মাত্র বাছাই আধ ডজন। আরও লক্ষণীয় যে প্রতিটি বিবৃতিরই মূল লক্ষ্য কাশ্মীরকে ইস্যু করে দেশে লাগামহীন অশান্তি তৈরিতে কাশ্মীরের জনগণকে উস্কানি দেওয়া, জিভের লাগামহীন মন্তব্য করে জঙ্গিবাদকে সমর্থন জোগানো। সাংবিধানিক পদক্ষেপের অকারণ বিরোধিতা করে রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ভাবনা না ভেবে দেশদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় দেওয়া এবং কোনওভাবে একটা রাজনৈতিক ভাবনা জড়িয়ে দেওয়া যে বিজেপি সরকারের এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক এবং বাকি সব রাজনৈতিক শক্তিই ধর্মনিরপেক্ষভাবে একত্রিত ও সংগঠিত।
গত ৭০ বছর ধরে জওহরলাল নেহরুর সৃষ্টি করা কাশ্মীর সমস্যাকে দগদগে ঘায়ের মতো জিইয়ে রেখেছিল কংগ্রেস। কারণ শেয়ালের একটাই কুমিরছানা দেখানোর মতো কাশ্মীর সমস্যাকে জিইয়ে রেখে সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটের জায়গির নেওয়া এবং তাবেদার স্থানীয় নেতৃত্বকে সবরকম আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান করে নেহরু তথা গান্ধীপরিবার পরিচালিত কংগ্রেসের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। বামপন্থী দলগুলির উদ্দেশ্য এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়ে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ইতিহাসই বলে দেয়— বামপন্থীরা কখনই দেশের স্বার্থে দেশের পতাকা তুলে ধরেনি। চিরকালই তারা চীনকে তাদের স্বদেশভূমি বলে মেনে এসেছে এবং প্রয়োজনে সুযোগ সন্ধানীর মতো চোরাপথে ভারতীয় সাজার অভিনয় করে দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে।
আজ যখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সাহসের সঙ্গে এবং সম্পূর্ণভাবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ৭০ বছরের জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান করেছে, তখন কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে এবং যেভাবে লাগামহীন বিবৃতির বান ডাকছেন, তাতে তাদের দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া যেতেই পারে এবং কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ওমর আবদুল্লা বা নেত্রী মুফতি মেহবুবার মতো এদেরও জেলবন্দি করা উচিত দেশের সার্বভেমৈত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থেই। কারণ কংগ্রেসের এবং বামপন্থীদের বক্তব্য বিচ্ছিন্নতাবাদেরই শামিল।
১৯৮৯ সালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লার প্রত্যক্ষ মদতে যখন কাশ্মীরে জেহাদি দৌরাত্ম্য কাশ্মীরের ভূমিপুত্র ছ’ লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিতকে ঘরছাড়া করেছে। যখন প্রকাশ্য রাজপথে খুন করা হয়েছে জনপ্রিয় কাশ্মীরি পণ্ডিত নেতা টিকালাল টাপলুকে, যখন বিচারপতি নীলকণ্ঠ গঞ্জকে খুন করে ফেলে রাখা হলো প্রকাশ্য রাজপথে এবং হুমকি দেওয়া হলো— মৃতদেহ কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। যখন শিক্ষিকা গিরিরাজ টিপ্পকে গণধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, সেদিন কিন্তু এই ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস, এই সাম্যবাদী বামপন্থীরা কেউ বিবৃতি দেননি। ঝান্ডা নিয়ে পথে নামেননি। এবারও প্রতিবাদ জানাতে কাশ্মীরের মাটি ছোননি। আজও যখন লক্ষ লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছেন তখনও এদের চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করে ওঠে না। তখন এরা সংখ্যালঘুদের স্বার্থেই রাজনীতি করে যান নির্দয়ভাবে। কারণ ওরা বুঝে গেছেন—ভারত এখন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, ইসাহি– সকলেই সেই জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে সমবেত। এখন আর সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কও যথেষ্ট নয়।
অতএব, দেশে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দাও। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উস্কানি দাও। দেশের কোণে কোণে আগুন জ্বালাও। সর্বোপরি কথা বলো করাচীর ভাষায়। পাকিস্তানকে উজ্জীবিত কর। উত্তেজিত কর যাতে একটা যুদ্ধ বাঁধে। তাহলে অর্থনৈতিক অবদমনেরও সমস্ত দোষারোপ চাপানো যাবে মোদীর ঘাড়ে।
এটা পরিষ্কার — প্রতিটি বিবৃতির পিছনেই রয়েছে এক গভীর চক্রান্ত। দেশের জনগণ তা বুঝে গেছে, তাই দেশের মাটিতেই আজ মুসলমান ভাই-বোনেরাও মিছিল করে মোদীজীর, অমিত শাহের পদক্ষেপকে স্বাগতম জানাচ্ছে। আওয়াজ ওঠেছে— ভারতমাতাকে টুকরো হতে দেব না।
পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বুঝে গেছেন—সংখ্যালঘু তাস খেলার দিন শেষ। সুতরাং কাশ্মীর প্রসঙ্গে তাঁর বিবৃতি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের। বলা মুশকিল, এত বড়ো ইস্যুতে তার মুখে বল্লা পরালেন কে? প্রশান্ত কিশোর নাকি তার বিবেক?
সুজিত রায়
2019-08-22