যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (২৬ শে জুন, ১৮৮৭ — ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৫৪)-র ‘হাট’ কবিতাটি (‘মরীচিকা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দ/১৩৩০ বঙ্গাব্দ) ছাত্রজীবনে আমাকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেই গ্রামের হাট, প্রভাতে যেখানে ঝাঁট পড়ে না, সন্ধ্যায় যেখানে জ্বলেনা প্রদীপ। সেই দশবারোখানি গাঁয়ের মাঝে একটি হাট — পড়ে থাকে আঁধারে, তার দোচালায় মুদে আসে নয়ান। অথচ এই হাটেই তো সকাল থেকে কত বিকিকিনি, শত হাতে পরখে যায় পণ্য — প্রভাতে নিয়ে আসা শিশির-বিমল ফল; আর তারই জন্যে কত অনন্ত কোলাহল — মাল চেনার, দর জানার বাচনিক। এমন করেই জীবনের উন্মুক্ত হাট বসে আবহমানকাল ধরে, যেন নিত্য নাটের খেলা মনে হয়। জীবনের কড়ি গাঁটে বেঁধে নিজ নিকেতনে ফেরার গল্প। ‘হাট’ কবিতার কয়েকটি লাইন আমার আজোও মনে পড়ে, কীভাবে হাটে সন্ধ্যা নামে তার বর্ণনা — “বকের পাখায় আলোক লুকায়/ছাড়িয়া পূবের মাঠ” অথবা “নিশা নামে দূরে শ্রেণীহারা একা/ক্লান্ত কাকের পাখে” অথবা “নির্জন হাটে রাত্রি নামিল/একক কাকের ডাকে”।
তাঁর কলেজ জীবনে (১৯১১ সালে স্নাতক) রবীন্দ্র কাব্যের সঙ্গে পরিচয়, তারপর প্রণয়-কলহ, তারপর বলা যায় রবীন্দ্রে বন্দী কিংবা রবীন্দ্রেই মুক্তি। ‘বাইশে শ্রাবণ’ (‘ত্রিযামা’ কাব্যগ্রন্থ, ১৯৪৮/১৩৫৫) কবিতায় রবীন্দ্র-বিষাদে মর্মাহত তিনি– “আমি ফুল দিইনি বন্ধু, / আমার পথে ফুলের দোকান পড়ে না।” অবশেষে করজোড়ে, নতশিরে প্রণাম করেছেন বিচিত্র শোভায়, বিচিত্র সাজে চলমান এক ব্যক্তিত্বকে মহাপ্রস্থানের পথে; আর পরাজয়ের জয়োল্লাসে চুপিচুপি চোরের মতো নিজে ঘরে ফিরে গেছেন হয়তো রবীন্দ্র-ভবনেই।
এই সেই কবি যার কবিতার উজ্জ্বল উদ্ধার আমাকে বারবার ধার নিতে হয়, যেমন নিতে হয়েছিল কল্লোল যুগকে — “চেরাপুঞ্জির থেকে, /একখানি মেঘ ধার দিতে পারো গোবি-সাহারার বুকে?” কবি আর আমাকে কত ঋণী করবেন? আজ তাঁর ঋণের বোঝা স্মরণ করছি পুণ্য জন্মদিনে কবিতা-যাপনে।
কল্যাণ চক্রবর্তী