আমাদের ভারত, ১৯ ডিসেম্বর: ১৯৪৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ৩৭ জন বালক-নারায়ণকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম। তার একমাস আগে ১৬ আগষ্ট ঠাকুর-মা-স্বামীজির পূজা ও হোমের মাধ্যমে আশ্রমের কাজ শুরু হয়ে যায়। রহড়া বালকাশ্রমের প্রথম কর্মসচিব স্বামী পুণ্যানন্দজী মহারাজ। তাঁর সঙ্গে নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার কার্যকরী সভাপতি ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৪৫ সালে স্বামী পুণ্যানন্দজী মহারাজ আমন্ত্রণে শ্যামাপ্রসাদ রহড়ায় এলেন।
সেবাকার্যের সুবাদেই এই দুই কর্মযোগী সান্নিধ্যে আসেন। শ্যামাপ্রসাদ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের কাছে সবসময় ছুটে গেছেন, সর্বহারার পাশে দাঁড়িয়েছেন, রাজনীতিতেও তাই। মানুষের সেবাই ছিল রাজনৈতিক আদর্শ, যার অবস্থান পেশাদারী রাজনীতির অনেক ঊর্ধ্বে। মন্ত্রী থাকার সময়েও তিনি দুর্গত মানুষের কাছে গেছেন, বাধাপ্রাপ্ত হলে বিনা দ্বিধায় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছেন।
স্বামী পুণ্যানন্দের সেবাকাজ সম্পর্কে রহড়া-খড়দার প্রবীণ মানুষের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। রহড়ায় আসার আগেও নানা জায়গায় তিনি সেবাকাজ পরিচালনা করেছেন। বিগত শতকের তিন/চারের দশকে তিনি ছিলেন রেঙ্গুন রামকৃষ্ণ মিশনের হাসপাতালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেভাবে নির্ভীক সৈনিকের মত আহত ও অর্ধমৃত মানুষকে কোলে তুলে এনে হাসপাতালে সেবাযত্ন করতেন তাঁর তুলনা ছিল না। তাঁকে অনেকসময় মাটির ভেতর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বাঙ্কারের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল। দুঃসাহসে ভর করে দীর্ঘ সময় তিনি রেঙ্গুনে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৪২ সাল নাগাদ জাপানী আগ্রাসনে রেঙ্গুন শহরের পতন হলে তিনি কয়েক হাজার শরণার্থীকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়-অরণ্য সমাকীর্ণ বিপদ সঙ্কুল আরাকানের পথ ধরে পদব্রজে ভারতে আসেন।
দেশে তখন ভয়ঙ্কর পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) এবং প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় (মেদিনীপুরের বন্যা)। ত্রাণের কাজে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী বলা হত) ফজলুল হক। বর্মার বাঙালী শরণার্থীদের জন্য কলকাতায় তৈরি হয়েছিল রিলিফ ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার। মুখ্যমন্ত্রী এই কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনকে আহ্বান করলেন। যেহেতু রেঙ্গুনে থাকাকালীন স্বামী পুণ্যানন্দের দুঃসাহসিক কাজের খবর রামকৃষ্ণ মিশনের জানা ছিল, তাই মিশনের পক্ষ থেকে রেঙ্গুন থেকে আসা বাঙালিদের রিলিফের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল স্বামী পুণ্যানন্দকে।
এদিকে হিন্দু মহাসভার কর্ণধার ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হত। বাংলাদেশের খুলনার সেনহাটি হাইস্কুল ছিল এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান। নানান কারণে শ্যামাপ্রসাদ এই স্কুলটি চালাতে পারছিলেন না। তিনি পুণ্যানন্দজীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং এই সমস্ত ছেলেদের পাঠাতে চাইলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামীজি রাজি হলেন। পরবর্তীকালে ওই ছাত্রদের জন্য একটি গৃহ নির্মাণের ব্যাপারে তিনি হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দান করলেন। এই টাকায় খড়দায় তৈরী হয়েছিল ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’। এটি রহড়া বালকাশ্রমে প্রথম সারির দ্বিতীয় হোস্টেল। এখনও তার ফলক দেখতে পাওয়া যাবে।
১৯৪৫ সালে শ্যামাপ্রসাদ একবার রহড়ায় এসেছিলেন ছাত্রদের দেখতে। পুরনো আশ্রম বাড়ীর বাইরে প্রাচীন সাধুনিবাস, তারই উল্টোদিকে প্রাচীন আমগাছের তলায় সেদিন সভা হয়েছিল। আবাসিক ছাত্ররা সঙ্গীত পরিবেশন করে মুগ্ধ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদকে। ছাত্রদলের মধ্যে ছিলেন সেনহাটি হাইস্কুলের ছাত্র কৃষ্ণকমল চক্রবর্তী বা কেষ্ট, যিনি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন স্বামী নিত্যানন্দ, রহড়া বালকাশ্রমের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ এবং বারাকপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা।
কৃষ্ণকমল হিন্দু মহাসভার শাখা কেন্দ্র কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে ৮নং শিবনারায়ণ দাস লেনের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছুদিন পর চলে গেলেন হিন্দুমহাসভার খুলনা জেলার সেনহাটি হাইস্কুলে। হিন্দু মহাসভার স্কুল উঠে গেলে ১৯৪৪ সালের গোড়ায় কলকাতার ১০ নং নলিনী সরকার স্ট্রিটে ড. শ্যামাপ্রসাদ মখোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় স্বামী পুণ্যানন্দের কাছে উপস্থিত হন।
স্বামী নিত্যানন্দ মহারাজ বারাকপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মুখপত্র ‘তত্ত্বমসি’ পত্রিকায় লিখেছেন রহড়া বালকাশ্রমের ইতিহাস। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের পর তাঁর মেজদি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে ধরে হিন্দুমহাসভা পরিচালিত একটি ছাত্রাবাসে তাঁকে ভর্তি করে দেন। পুণ্যশ্লোক স্বামী পুণ্যানন্দের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সুসম্পর্ক বজায় ছিল। আশ্রমের শিক্ষক শ্রী বিধুভূষণ নন্দ একান্ত আলাপচারিতায় বলতেন, গভীর সম্পর্ক।
রহড়া আশ্রমে শ্যামাপ্রসাদ উপস্থিত হলে স্বামীজি নিজে তাঁকে সাদরে বরণ করেন। ফুলমালা দিয়ে স্বামীজি নিজে সম্মান জানান। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক গুরুজীর নির্দেশে শ্যামাপ্রসাদ ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’ নামে নূতন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করলেও রহড়ার সঙ্গে অমোচ্য সম্পর্ক ছিল, কারণ উভয়েই ছিলেন মনেপ্রাণে শিক্ষাবিদ, আর শ্যামাপ্রসাদের প্রিয় স্কুলের ছেলেরাও যে সেসময় পড়ছেন রহড়ায়। হয়তো নিজে আর পরে আসতে পারেননি, সমকালীন নানান ঘটনাবর্তে শ্যামাপ্রসাদের চূড়ান্ত ব্যস্ততা ছিলেন — ১৯৪৫ সালে নেতাজীর অন্তর্ধান, ১৯৪৬-এর দাঙ্গা, ১৯৪৭-এ ভারত বিভাজন, স্বাধীনতা লাভ এবং জাতীয় সরকারে যোগদান, ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী হত্যা, ১৯৪৯-এ হিন্দু মহাসভা থেকে পদত্যাগ, ১৯৫০-এ নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি, ১৯৫৩-তে কাশ্মীর নিয়ে আন্দোলন ও বন্দী অবস্থায় মৃত্যু। আর আসা হয়নি শ্যামাপ্রসাদের।
কিন্তু তদানীন্তন আশ্রমিকের অনেকের কাছেই শোনা, রহড়ার সঙ্গে সবসময় তিনি যোগাযোগ রেখেছিলেন। এমনকি শ্যামাপ্রসাদের আত্মবলিদানে বাকরুদ্ধ হয়েছিল আশ্রম চত্বর। এই ইতিহাসের কথা তথ্যনিষ্ঠভাবে স্মৃতিচারণ করা উচিত ছিল প্রাক্তন আশ্রমিকদের। ২০০০ সালে কল্যাণ চক্রবর্তী সম্পাদিত খড়দা থেকে প্রকাশিত স্থানীয় সংবাদপত্র ‘সংবাদ এখন’-এ সেই বিষয়ে একটি ছোটো নিবন্ধ লেখেন প্রত্যক্ষদর্শী আশ্রমিক ও শিক্ষক শ্রী বিধুভূষণ নন্দ। খড়দার হারিয়ে যাওয়া সে ইতিহাস তুলে আনা হলে, সন্তুষ্ট করতে পারেনি খড়দার তদানীন্তন বাম বুদ্ধিজীবী মহল ও রাজনীতিবেত্তাদের। কারণ ‘শ্যামাপ্রসাদ’ নিয়ে গবেষণা করাটা সেই সময় ‘সাম্প্রদায়িক পদবাচ্য’ হত স্থানীয় প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে। ভয়ে-ভক্তিতে সে পথে আর কেউ যাননি। কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাস উপাদানের পুঁথি গেঁথে গেঁথেই সামগ্রিক ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়। “তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।” অনাথ ছাত্রদের জন্য শ্যামাপ্রসাদের বেদনার্ত হৃদয়, তাঁর সেবাকাজ, আর্তত্রাণের ইতিহাসও বোধহয় হারিয়ে যায়নি।
–ক্রমশ।
(খড়দহের ভূমিপুত্র ও বিশিষ্ট নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর খড়দহ বিষয়ক আগামী নিবন্ধগুলিতে নজর রাখুন।)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী