এএফসি এশিয়ান কাপের মূল পর্বে ওঠার পুরস্কার। ফিফা ক্রমতালিকায় ১০৬ থেকে ১০৪ নম্বরে উঠে এলেন সুনীল ছেত্রীরা। যোগ্যতা অর্জন পর্বে ভারতীয় দলের দুর্দান্ত খেলার রহস্য থেকে আসন্ন কাতার বিশ্বকাপে ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকার দেশগুলির দ্বৈরথের বিশ্লেষণ। পোল্যান্ডে ছুটি কাটানোর ফাঁকে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকারে অকপট ভারতীয় দলের কোচইগর স্তিমাচ।
প্রশ্ন: চার বছর ধরে ভারতীয় দলের কোচ থাকার অভিজ্ঞতা কেমন?
ইগর স্তিমাচ: দীর্ঘ এই যাত্রাপথ খুবই কঠিন ছিল। ভারতীয় দলের জন্য নতুন ফুটবলার নির্বাচন, তরুণদের ফুটবলের মানের উন্নয়ন করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। এর জন্য নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু কখনওই হাল ছেড়ে দিইনি। ধীরে ধীরে পুরো দলটাকে এক সুতোয় বাঁধতে সফল হয়েছি।
প্র: ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে ধারণা?
ইগর: অস্বীকার করার জায়গা নেই, আমরা যে লক্ষ্য স্থির করেছি তার চেয়ে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছি। এশীয় ফুটবলে সেরা দেশগুলির সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনাই হবে প্রধান কাজ। এখনও অনেক দূর যাওয়া বাকি।
প্র: এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের আগে ভারতীয় দলের হতাশাজনক ফলে অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ধাক্কা কাটিয়ে নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের রহস্য কী?
ইগর: আমি এর মধ্যে কোনও রহস্য রয়েছে বলে মনেই করি না। পরিশ্রম এবং আত্মবিশ্বাসই আমাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ। যোগ্যতা অর্জন পর্বের প্রস্তুতির জন্য আমরা পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিলাম। ফলে পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু করতে পেরেছি। বল নিজেদের দখলে রেখে খেলা, লক্ষ্যভেদ করতে না পারা আমাদের মূল সমস্যা ছিল প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে। অনুশীলনের মাধ্যমে সেই ভুলত্রুটিগুলি শুধরে নিতে পেরেছিলাম। এই কারণেই তিনটি ম্যাচ জিতে ‘ডি’ গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জন করেছি।
প্র: মূল পর্বে উঠতে না পারলে নাকি আপনার বিদায় নিশ্চিত ছিল। এ বার সমালোচকদের কী বলবেন?
ইগর: এশিয়ান কাপের মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জন করা নিয়ে আমার মনে কখনওই কোনও সংশয় ছিল না। তাই কাউকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।
প্র: অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ কী?
ইগর: সবার আগে বলতে চাই, মানুষ হিসেবে সুনীল অতুলনীয়। ভারতের যে শিশুরা ফুটবল ভালবাসে, সুনীল তাদের আদর্শ। ওরা সকলেই স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতে সুনীল হওয়ার। অধিনায়ক হিসেবেও ওর কোনও তুলনা নেই। দলের প্রত্যেককে সম্মান করে, ভালবাসে। সুনীলের জন্যই আমরা এত ভাল খেলে মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি।
প্র: মূল পর্বে এশিয়ার দেশগুলির বিরুদ্ধে খেলতে হবে ভারতকে। প্রস্তুতির জন্য কোনও বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে?
ইগর: অবশ্যই। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হল সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সিওএ, বর্তমান সচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসা। সেপ্টেম্বর ও মার্চ মাসে ফিফা ফ্রেন্ডলি খেলা নিশ্চিত করা। সিনিয়র, অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ফুটবলারদের কী ভাবে এই ম্যাচগুলিতে ব্যবহার করব তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। তবে আমি জানি এই মুহূর্তে সকলেই প্রচণ্ড চাপে রয়েছেন। তবুও আশা করব, ফিফা ফ্রেন্ডলি আয়োজনের ক্ষেত্রে বেশি বিলম্ব যেন না হয়।
প্র: যুবভারতীতে যোগ্যতা অর্জন পর্বের শেষ ম্যাচে হংকংকে হারানোর পরেই সাংবাদিক বৈঠকে ফেডারেশনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এর জন্য যদি আপনার কাছে জবাব চাওয়া হয় কী করবেন?
ইগর: আমি তৈরি। আমি পেশাদার কোচ। আমার কর্তব্য ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।
প্র: কাতার বিশ্বকাপের আর খুব বেশি দেরি নেই। নিজের দেশ ক্রোয়েশিয়া ছাড়া কাকে ফেভারিট মনে করছেন?
ইগর: এই বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে কখনওই ফেভারিট মনে করছি না। তবে আমার দেশ অনেক অঘটনই ঘটাতে পারে। ক্রোয়েশিয়া এই বিশ্বকাপে কালো ঘোড়া হতে পারে। আর্জেন্টিনা যে রকম ছন্দে রয়েছে, কাতারে ওরা ভাল কিছু করবে বলেই আশা করছি।
প্র: ইউরোপ না লাতিন আমেরিকা, কোন মহাদেশের দল কাতার বিশ্বকাপে এগিয়ে থাকবে?
ইগর: অবশ্যই ইউরোপের দেশগুলি। গতি, শক্তি, রণকৌশলে লাতিন আমেরিকার দেশগুলির চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে ওরা। লাতিন আমেরিকার দেশগুলির প্রধান সমস্যা, ওরা বরাবরই নির্ভরশীল শুধু মাত্র কয়েক জন ফুটবলারদের ব্যক্তিগত দক্ষতার উপরে। যদিও সাম্প্রতিক কালে আর্জেন্টিনার খেলায় ব্যতিক্রমী ছবি দেখা গিয়েছে। একটা দল হিসেবে খেলছে ওরা। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠতে পারে। তবে এখনও অনেক দিন বাকি রয়েছে। বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছন্দ ধরে রাখা খুবই কঠিন। তার উপরে রয়েছে কাতারের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষা।
প্র: ভারতকে ফুটবল বিশ্বকাপে কবে দেখা যাবে?
ইগর: এর আগেও বহুবার বলেছি, বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনের জন্য ভারতে ফুটবল মরসুম দীর্ঘায়িত করতে হবে। আরও বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ দিতে হবে ফুটবলারদের। বাড়াতে হবে প্রতিযোগিতার সংখ্যাও। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, এশীয় ফুটবলে সেরা দেশগুলির চেয়ে ৮-১০ বছর পিছিয়ে রয়েছি। প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার তুলে আনার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগেই। কিন্তু করোনা অতিমারির ধাক্কায় সব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে অবশ্যই এক দিন বিশ্বকাপে খেলবে ভারতীয় দল।