জয়পুর লিটারেরি ফেস্টে হলভর্তি বিদগ্ধ শ্রোতা ও দর্শকদের মুগ্ধ করে ভাষণ দিলেন হ্যারল্ড গার্ডনার। বিষয় – ‘Multiple Intelligences’. এই তত্ত্বের তিনিই উদ্ভাবক। মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় এ এক নতুন দিগন্ত যা পশ্চিম বিশ্বের একাডেমিক বৃত্তের সৈকত প্লাবিত করেছে। প্রশ্নোত্তর পর্বে উঠে দাঁড়ালেন এক স্বদেশী ভারততত্ত্ববিদ, কোন ভণিতা না করেই সরাসরি অভিযোগ তুললেন,
‘আপনি তো পাতার পর পাতা শ্রী অরবিন্দের লেখা থেকে আওড়ে গেলেন! সত্তার বিভিন্ন স্তর এবং অংশ আছে, সেগুলি জেনে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, এ ধারণা তো শ্রী অরবিন্দ দিয়েছেন তাঁর ‘Planes and Parts of the Being’ চর্চায়। এমন এক মনীষীর প্রতি ঋণ স্বীকার না করে আপনি এই তত্ত্বটিকে নিজের নামে পেটেন্ট করিয়ে নিয়েছেন’?
হ্যারল্ড সাহেব প্রথমে একটু থতমত খেয়ে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষরক্ষা হোল না। উদ্যোক্তারা তড়িঘড়ি সেদিনের মত ভারতীয় হীনমন্যতা কর্ষণের ঝাঁপি ফেলতে বাধ্য হলেন।
এ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাহেবরা বিদায় নিলেও তাঁদের চৌর্যবৃত্তির স্পৃহা এতটুকু দমেনি, বরং উত্তরোত্তর সূক্ষ্ম ও সর্বনাশা হয়ে উঠেছে। ধনী শ্বেতাঙ্গরা যখন আমাদের কৃষ্টি এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন, ভারতীয় যোগ ও আধ্যাত্মিকতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন, আমরা তখন ‘বিশ্বগুরু’ অভিমানে আপ্লুত হয়ে যাই। সাহেবরা ধুতি পরেন, তিলক কাটেন, মেমরা শাড়ি পরে কপালে বিন্দু এঁকে শঙ্খ বাজান, ধুপ জ্বালেন, উলু দেন, বরণডালা সাজান, আমরা তখন ভারতীয় সংস্কৃতির মহিমায় পুলকিত হয়ে উঠি। একদিন তাঁরা দীক্ষা নেন, নতুন একটি ভারতীয় নাম পেয়ে ধন্য হয়ে যান, গুরুরা তখন উজাড় করে গুপ্ত পারমার্থিক জ্ঞান প্রদান করেন, বিনিময়ে আর্থিক প্রতিদানও মেলে।
সেই নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সশস্ত্র হয়ে তখন প্রায়-নব্য ভারতীয় মেম ও সাহেবরা আপন আপন দেশে ফেরেন। বিভিন্ন মঞ্চে বলতে আরম্ভ করেন, লেখালেখি শুরু করেন, অচিরেই ভারতীয় শিকড়টিকে কেটে বাদ দেন, যেন তাঁদেরই মস্তিষ্ক-উদ্ভুত এই নতুন অভিনব তত্ত্ব। মেধাসত্বের অধিকার চলে আসে, প্রচুর উপার্জন হয়, বই লেখার বরাত আসে প্রকাশকের কাছ থেকে, সেমিনারে ডাক পড়ে, অধ্যাপকের পদ জোটে। এখানেই শেষ নয়। ভারত থেকে চুরি হওয়া এই সকল তত্ত্ব আবার নতুন নামরূপে ও আকর্ষণীয় মোড়কে ভারতের মত দেশগুলিতে রপ্তানি হয়। আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা লুফে নেন এই ‘আধুনিক’ ও ‘বৈজ্ঞানিক’ সংজ্ঞায় পরিবেশিত চেতনা বা বুদ্ধি বা গভীর মানস’এর বিশ্লেষণ।
এইভাবেই ভারতীয় ‘যোগনিদ্রা’ হয়ে উঠেছে স্টিভেন লাবার্চের ‘Lucid Dreaming’. গৌতম বুদ্ধের ‘বিপাসনা’ আজ ‘Mindfulness’ নামে জনপ্রিয়। শ্রী অরবিন্দের Integral Yog ও মহেশ যোগীর ‘তুরীয় ধ্যান’ আজ হার্ব বেনসনের ‘Relaxation Response’ যেখানে আবার ভারতীয় সংস্কৃতির পদচিহ্ন লুকাতে ধ্যানের মন্ত্রে ‘ওঁ’ সরিয়ে ‘ওয়ান’ (ONE) বলানো হয়। বিপুল জনপ্রিয় ও সমাদৃত এই সকল যোগের কৌশল পাশ্চাত্যে থেরাপি বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসায় কাজে লাগে, জীবনের সত্য সন্ধানে ওঁদের তেমন রুচি নেই। অবলীলায় ভারতীয় যোগ আজ ‘ক্রিশ্চান যোগা’ হয়ে ফিরে আসছে। কিছু মার্কিনিরা ইতিমধ্যেই দাবি করতে শুরু করেছেন যে ‘যোগা’ আসলে ক্রিশ্চানদেরই অবদান।
আমাদের থেকেই চুরি করা বিদ্যা আজ ভাষা পাল্টে আমাদেরই শেখানো হচ্ছে, এই অধর্ম আজও সম্ভব হচ্ছে আমাদেরই অবিমৃশ্যকারিতার দোষে। শ্রী অরবিন্দের সাধনলব্ধ কোন ভাবনা’কে যখন কোন সাহেবের আবিষ্কৃত তত্ত্ব বলে চালানো হচ্ছে, আমরা নির্বোধ ছাত্র হয়ে থাকছি কারণ আমাদের তথাকথিত পণ্ডিত সমাজও অরবিন্দ’কে নিয়ে তেমন চর্চা করেন না। যাঁরা করেন তাঁরা কোন প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য পান না। আমাদের ‘মনস্তত্ত্ব’ বা ‘যোগ’ বা ‘দর্শন’ বিভাগে নিজস্ব ভারতীয় ভাবনা প্রায় সম্পূর্ণ ব্রাত্য। এই তথাকথিত ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ মাশুল গুণে প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান আজ বিদেশি পেটেন্টধারী পুঁজিপতির সম্পত্তি হয়ে উঠছে। একে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বলে না। একে এক সংস্কৃতির দ্বারা অপর সংস্কৃতিকে আত্মস্মাৎ করা বলে।
সব শ্বেতাঙ্গই কুচক্রী নন। অনেকেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করেন ভারতীয় যোগ ও দর্শনের প্রতি তাঁদের ঋণের কথা। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। এক) ভারতীয় সূত্র স্বীকার করলে স্কলারশিপ পাওয়া যাবে না, ফাণ্ডিং আসবে না, পেপার প্রকাশ হবে না ও বই বেরোবে না। এবং দুই) ভারতীয় চিন্তার দুটি প্রধান স্তম্ভ, জন্মান্তর ও কর্মচক্র বাদ দিয়ে তত্ত্ব সাজাতে হবে। কারণ ওগুলি ক্রিশ্চান ধর্মমতে নেই। অর্থাৎ, যোগই হোক বা চেতনা বা শক্তিতত্ত্ব, যতটা সম্ভব ক্রিশ্চানিকরণ করতে হবে। তিন) পশ্চিমি বৌদ্ধিক মহলের আখ্যান অনুযায়ী ভারতকে নিকৃষ্ট ও হীন দেখাতে হবে। Caste Cows Curry … এর বাইরে ভারতের আর কোন ছবি যেন সাহেবী মূলস্রোতে না ভাসে।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অধিকাংশ দার্শনিক ও মনিষীরা গভীর ভাবে ভারতীয় জ্ঞান ও বিচারের কাছে ঋণী। নিৎসে, হেগেল, ইম্যানুয়েল কান্ট, ওয়াইটহেড, ওপেনহাইমার, হাকস্লি থেকে কার্ল য়ুঙ, এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের ভাবনার ইমারত রচনা করেছেন ভারতীয় মাল-মশলা দিয়ে। এমনকি, প্লেটো, আ্যরিস্টটেল, সক্রেটিসের মত কিংবদন্তি বা পাইথগোরাসের মত গণিতজ্ঞ যে ভারতীয় প্রেরণায় পুষ্ট সে কথাও ইতিহাসের বিবর্ণ পৃষ্ঠার খাঁজে খাঁজে লুকানো আছে। কিন্তু সে ইতিহাস আজ আর কেউ জানে না। আদি নাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে দেওয়া হয়েছে। ঠিক যেমন ইওরোপ আমাদের শিখিয়েছে যে শূণ্য ছাড়া বাকি সংখ্যা নাকি এসেছে আরব থেকে। অথচ আরব পণ্ডিতেরা কিন্তু ভারতের কাছে ঋণ স্বীকার করেছিলেন তাঁদের মূল পাণ্ডুলিপিতে। ভারতের সাধু-সন্তরা অধিকাংশই এ বিষয়ে নির্বিকার। বিদেশি প্রশংসায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা বিগলিত হন। আরও দুটো প্রধান কারণ; এক) তাঁদের বক্তব্য, জ্ঞান তো বিতরণের জন্যই। কে কী মতলব নিয়ে আসছে সেটা দেখা তো সাধুর কাজ নয়। যে জিজ্ঞাসু যে আগ্রহী তাকে সর্বতোভাবে পথ দেখানোই ধর্ম। এবং দুই) সাধুরা শাস্ত্র জানেন, আধ্যাত্মিক দর্শন তাঁদের নখদর্পণে কিন্তু পশ্চিমি দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে তাঁদের তেমন আগ্রহ বা পরিচিতি নেই। ওসব ‘ম্লেচ্ছ’ সংস্কৃতি নিয়ে বরং তাঁদের একধরনের উন্নাসিকতাই আছে। এই নিরীহ অথচ দাম্ভিক উদারতা বহু ক্ষেত্রেই আত্মঘাতি হয়ে উঠছে।
স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রী অরবিন্দ এই পরিকল্পিত আত্মবিস্মৃতি ও নির্মাণ-করা হীনমন্যতার বিরুদ্ধে এক কড়া চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিলেন। ইওরোপিয়ান ও মার্কিন দর্শন অধ্যায়ন করার বিষয়ে এই দুই বিষ্ফোরক প্রতিভার কোন ছুঁৎমার্গ ছিল না। ভাবলে কৌতুক হয় যে দার্জিলিং’এর কনভেন্টে বালক অরবিন্দের শুরু হয়েছিল ক্রিশ্চান ধর্ম, ইওরোপিয়ান দর্শন ও ইতিহাসের সাথে প্রাথমিক পরিচয়। তারপর বিলেতে গিয়ে ভারতীয় দর্শন নিয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়। তার আগে তিনি ক্রমাগত বাইবেল শিক্ষার কষাঘাতে বিরক্ত হয়ে নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরাজি ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি ইওরোপিয়ান ভাষা জানতেন, অতুলনীয় ছিল তাঁর মেধা ও অন্তর্দৃষ্টি, সেই কারণে তিনি অতি সহজেই উপলব্ধি করেছিলেন যে এক মিথ্যা ‘বহিরাগত আর্য’ তত্ত্ব গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া সাহেবদের কাছে কতটা জরুরী সভ্যতার প্রকৃত সত্য’কে চিরকালের মত ধামাচাপা দেওয়ার জন্য।
ঠিক সেই কারণেই চোদ্দ বছর পর দেশে পা রাখতেই তরুণ অরবিন্দের এক অপূর্ব আত্মিক অনুভূতি হোল, সে যেন মায়ের শান্ত, স্নিগ্ধ, মৌন আলিঙ্গন। বরোদায় অধ্যাপনা, নিরন্তর পড়াশোনা ও অবিরাম অন্তর্মুখে খোঁজ সত্ত্বেও তিনি একডাকে চাকরি ও নিরাপত্তার বেষ্টনি ত্যাগ করে কলকাতায় চলে এলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে। প্রথম দিন থেকেই তাঁর দাবি ‘পূর্ণ স্বরাজ’। এ ছাড়া তাঁর কন্ঠে ভিন্ন কোন আপোসের সুর কোনদিন শোনা যায়নি। গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি সহজেই বুঝেছিলেন যে স্বাধীনতার প্রশ্নটা শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়। তার চেয়েও গূঢ়; প্রকৃত সভ্যতার মুক্তি, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা যে এখনও অপেক্ষায় সে কথা প্রতিদিন আমরা টের পাচ্ছি।
✍️ – জয়দীপ।