সপ্তাহের ছুটিতে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবছেন? কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, থাকার জায়গা আছে কি না, কী কী দেখবেন– এ সবও নিশ্চয়ই ভাবতে হচ্ছে। এবার থেকে সেই দায়িত্ব আমাদের। যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, যাঁরা দেখতে চান বাংলার মুখ, তাঁদের কথা মনে রেখেই শুরু হল নতুন এই ধারাবাহিক ‘পায়ে পায়ে বাংলা’। এ হল বেরিয়ে পড়ার ভ্রমণ গাইড। এ এমন এক সোনার কাঠি, যার ছোঁয়ায় জেগে উঠবে রোজকার হাঁপিয়ে ওঠা জীবন, ফুসফুসে ভরে নেওয়া যাবে তাজা হাওয়া, মন মেতে উঠবে আনন্দে। তা হলে আর দেরি নয়। খুঁজে নিন আপনার পছন্দের জায়গা, গুছিয়ে ফেলুন ব্যাগ, হুশ করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষে। আপনার সঙ্গে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে বাংলা’।

বাড়ির বাগানে পেঁপে ঠোকরানো কালো কুচকুচে পাখিটার দিকে তাকিয়ে চক্ষুস্থির। আরে, এ যে ঋতুরাজের দূত! তার মানে সুপ্ত প্রাণকে জাগাতে দুয়ারে দখিন হাওয়ার করাঘাত! পলাশে–শিমুলে, বাতাবি ফুলের সোহাগে ঝিম হয়ে থাকা এ সময় যখন রঙিন তখন আর ঘরে আবদ্ধ কেন? বিবর্ণ ধ্বস্ত জীবনটাকে রাঙিয়ে নিতে বেরিয়ে পড়া যাক পথে। যে পথে চলতে গেলেই পা পড়ে আদুরি লাল পলাশের নরম তুলতুলে গায়ে, মুগ্ধ হতে হয় কুসুম গাছের লাল কচি চিকন পাতায় রোদের কাটাকুটি খেলা দেখে। দিবারাত্র টুপটাপ ঝরে পড়া মহুয়ার চড়া মিঠে গন্ধে মন পাগল হয়ে ওঠে। রাঢ়ভূম তো সেজে ওঠে এই বসন্তেই। সেই সাজে নিজেকে সাজাতে চেপে পড়লাম রাতের আদ্রা চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে।

আদ্রা স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো ধরে সোজা রঘুনাথপুর। রঘুনাথপুর থেকে পথ চলল তরতরিয়ে চেলিয়ামা গ্রামের দিকে। এই পথেই ডানদিকে বেঁকে গেলে পাওয়া যাবে পলাশ বনে ঘেরা ছোট্ট একরত্তি গ্রাম বান্দা।

বান্দা শব্দটি শুনলেই পরাধীন, পরাধীন মনে হয়। কিন্ত না, বান্দা যুক্তাক্ষরের শৃঙ্খল ভেঙে হয়েছে বাঁদা। রঘুনাথপুর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বাঁদা। পথের দুধারে সৌন্দর্যের পশরা নিয়ে সারিবদ্ধ শাল সেগুন বহেরা ভেলা গলগলি গাছেরা সরে সরে যেতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে পৌছে গেলাম বাঁদা গ্রামের প্রবেশপথে। মূল সড়ক ছেড়ে নেমে এলাম লাল কাঁকুরে মাটির রাস্তায়। পথের দু’ধারে পিটিসের ঝোপ, ঝোপের ওপাশে বিস্তৃত মাঠে কচি ধানের সবুজাভা। গাছপালার ঘেরাটোপে নিকানো মাটির বাড়ি, বাড়ির দেওয়ালের নীচে কালো, মাঝে গেরুয়া, ওপরটা সাদা রঙে রাঙানো। রংগুলো সবই প্রকৃতি থেকে নেওয়া। খড় পুড়িয়ে জলে গুলে কালো, মাটি গুলে গেরুয়া আর শামুক গুগলি পুড়িয়ে পাওয়া যায় সাদা রং।

শুকনো রাঙা ধুলো উড়িয়ে পথ চলতে চলতে চোখে পড়ল নিঃসঙ্গ ইঁদারা। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা গরুর গাড়ি, ছিটে বেড়ার মাথায় টকটকে লাল ঝুঁটিওলা মোরগের সচকিত চাহনি , টিউবকলের জলে আদিবাসী রমণীর বাসনমাজা। হেঁশেল থেকে নাকে ভেসে আসছে পাঁচফোড়নের সুবাস অথবা পেঁয়াজ-রসুনের চড়া গন্ধ।

উদোম শিশুদের মুরগির ছানার পিছনে অথবা ফাটা টায়ারের পিছনে ছোটা দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই পলাশ বনে ঘেরা এমন এক জায়গায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের এক দেউল। উচ্চতায় ৭০ ফুট আর বয়স তার মাত্র হাজার। এরকম এক অজ গাঁয়ে প্রায় হাজার বছরের প্রাচীনত্বের ভার বহন করে ঝড় জলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে সে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সেটাই বিস্ময়ের। একটি বড় বেদির ওপর তার অবস্থান। পলাশের জঙ্গলে যেন রঙের দোল লেগেছে।

প্রায় নিস্পত্র গাছগুলিতে শুধুই থোকা থোকা পলাশ। শিখায় শিখায় দিকে দিকে যেন আগুন জ্বলছে। লাল ঠিক নয়, লাল আর কমলার মাঝামাঝি এক অদ্ভুত রঙে পলাশের লেলিহান শিখা মনে করিয়ে দিচ্ছে ফাগুনের বুকের মাঝে আগুন লুকিয়ে আছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় গাছের নীচে মেটে সিঁদুর ছড়ানো। এমন রক্তিমাভার মধ্যে পাথরের দেউলটি যেন জিজ্ঞাসা চিহ্ন। কে বা কারা তৈরি করেছিল, কেনই বা করেছিল? পুরুলিয়ায় এরকম দেউল সাধারণত জৈনদের দ্বারা নির্মিত। ভগবানকে ডাকতে গেলে একটু নির্জনতা দরকার, তাই হয়তো নির্জন প্রকৃতির মধ্যে এমন স্থান নির্বাচন। আনুমানিক নবম–দশম শতাব্দীতে দেউলটি তৈরি হ্য়। দেউলের তিন দিকের কাজ নজর কাড়ে। দেউলের মাথায় রয়েছে বিশাল আমলক যার আকৃতি ফোটা পদ্মের মতো। বর্তমানে দেউলটি সরকার দ্বারা সংরক্ষিত।

হাত নিশপিশ করছে সবুজ ঘাসে বিছিয়ে থাকা পলাশ কুড়িয়ে আঁজলায় তুলে নেওয়ার জন্য। পলাশ কুড়োতে কুড়োতে পৌঁছে গেলাম তিরতির করে বয়ে যাওয়া অনামা এক নদীর ধারে। তবে এই নদী স্থানীয়দের কাছে বাঁদার জোড় নামে পরিচিত।

এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য হয়ে ওঠে শীত ও বসন্তে। শীতের মরশুমে এই জোড়ের পাশে বনভোজনের জমাটি আসর বসে যায়। জোড়ের ডানদিকে রয়েছে বাঘরাই চণ্ডীর প্রাচীন মন্দির। পাশেই ভৈরবের মন্দির।

বসন্তে পলাশের আগুন রঙে বান্দাও রঙিন হয়ে ওঠে। নিঃসঙ্গ জোড়ের ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বান্দার মোহনরূপ দেখছিলাম। জোড়ের জলে নামছে কাচ–ছায়া। কোথাও একটা কাঠঠোকরা আপনমনে ঠুকরে যাচ্ছে। ঠক ঠক আওয়াজ ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। একলা শালিখ বসে আছে গাছের মাথায়, ফুলের মাঝে। সেও কি উদাস চোখে পলাশের বনে অন্ধকার নেমে আসা দেখছে? তাকে দেখছি আমরা। আমাদের দেখছে এই নিস্তব্ধ নির্জন পলাশপুরী। পলাশের বন থেকে উড়ে গেল একঝাঁক সবুজ টিয়া, তাদের ওড়ার তরঙ্গ ছড়িয়ে গেল পলাশ বনের ফুলে ফুলে। টুপ টুপ করে ঝরে পড়ল আরও কিছু পলাশ, একান্তে নিভৃতে যদি কেউ এসে অন্তরঙ্গ কোলে তুলে নেয়, এই আশায়।

বান্দা এখন ছায়া ছায়া আলো–আঁধারির রূপকথা। সেই অলৌকিক জগত ছেড়ে ফিরে চলেছি মানব সভ্যতার ভিড়ে। তবে আবার ফিরে আসব গ্রামবাংলার অঙ্গনে, রূপকথার জীবনের সন্ধানে।

বান্দায় থাকতে ইচ্ছে করলে থাকার কোনও উপায় নেই। থাকতে হবে চেলিয়ামার মানভূম লোকসংস্কৃতি কেন্দ্রের গেস্টহাউসে। কেন্দ্রটি হল মানভূমের পুরাতত্ব বা লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র। এছাড়াও এখানে আছে লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা। চেলিয়ামায় থাকার ব্যাপারে বিশদে জানতে হলে যোগাযোগ করতে হবে সুভাষ রায়ের সঙ্গে। এছাড়া রঘুনাথপুরে থেকেও বান্দা দেখে নেওয়া যেতে পারে।


রত্না ভট্টাচার্য্য


শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.