(জন্মঃ- ১৮৯৮ – মৃত্যুঃ- ১৩ জুন, ১৯৩২)
তিনি চট্টগ্রামের কোয়েপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ম্যাট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম এন. এম. স্কুলে ভর্তি হন। পরে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামের গুপ্ত বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালে ব্রহ্মদেশে যান। এর পরে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন-এ যোগদান করেন। ১৯২৪-এ গ্রেপ্তার হন এবং বিনা বিচারে ৩ বছর কারাবাসে কাটান। মুক্তির পর পুনরায় বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩০ সালে জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষন যুদ্ধে করার পর গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যান। ১৯৩২ এর ১৩ জুন ব্রিটিশ সৈন্যরা সূর্যসেন ও প্রীতিলতাসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের ধরতে ধলঘাট গ্রামের সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়ি ঘেরাও করে। সৈন্যদের সাথে গুলিবিনিময়ের সময় সূর্যসেন ও প্রীতিলতা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ব্রিটিশ অফিসার ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নিহত হন। সংঘর্ষে শহীদ হন বিপ্লবী নির্মল সেন।
……..
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধ
মাস্টারদা সূর্য সেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহরের অস্ত্রাগার দুটো দখল করে নেওয়া হোয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। অভিযান শুরু হয় ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, রাত দশটায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা – এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। সফল বিপ্লবের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হন এবং সেখানে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারী স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। রাত ভোর হবার পূর্বেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করেন।
কয়েক দিন পরে, পুলিশ বিপ্লবীদের অবস্থান চিহ্নিত করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাস সংলগ্ন জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া বিপ্লবীদের কয়েক হাজার সৈন্য ঘিরে ফেলে ২২ এপ্রিল ১৯৩০ সালে।
তিন ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর প্রায় ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন। এঁরা হচ্ছেন, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতিলাল কানুনগো, প্রভাসচন্দ্র বল, শশাঙ্কশেখর দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অংশ নিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীকালে পুলিসের আক্রমণে দুজন শহীদ হন, এঁরা হচ্ছেন অপূর্ব সেন এবং জীবন ঘোষাল।
জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে অভিযান চলছিলো। বিপ্লবীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করে ছিলো। সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪ এপ্রিল রাতে নিজ বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এবং এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। এ মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদন্ডের আদেশ হয় পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। এ রায়ের পর সূর্য সেনকে ধরার জন্য পটিয়া এবং গোমদন্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। সরকার ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।