জীবনের বিনিময়ে টেলিপাড়াকে একজোট করে দিয়ে গেলেন পল্লবী দে, বিদিশা দে মজুমদার, মঞ্জুষা নিয়োগী, সরস্বতী দাস। চার মডেল-অভিনেত্রীর পর পর আত্মহনন ইন্ডাস্ট্রিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সত্যিই কি প্রতিভার যোগ্য কদর নেই এখানে? বৃহস্পতিবার সল্টলেকে রাজ্য মহিলা কমিশনের দফতরে এক আলোচনায় তারই হদিসে ছোট পর্দার তাবড় ব্যক্তিত্বরা।
কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের আহ্বানে এই প্রথম এক ছাদের নীচে এক মঞ্চে বাদশা মৈত্র, ইন্দ্রাণী হালদার, ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস! উপস্থিত ছিলেন প্রযোজক গিল্ডের অন্যতম প্রধান শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়, আর্টিস্ট ফোরামের তরফে ইন্দ্রাণী হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, শঙ্কর চক্রবর্তী, লাভলী মৈত্র, দিগন্ত বাগচী, বিনোদন চ্যানেলের প্রতিনিধি কৌস্তুভী ঘোষ প্রমুখ। ছিলেন প্রশান্ত রায়, পবিত্র রায়-সহ বিশিষ্ট মনোবিদ, চিকিৎসকেরাও।
আলোচনায় কোন কোন দিক উঠে এসেছে? বিধায়ক-অভিনেত্রী লাভলী মৈত্র আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সবাই অকপটে স্বীকার করেছেন, সব বয়সের সব ধরনের অভিনেতা, কলাকুশলীর মানসিক ভাবে ভাল থাকা প্রয়োজন। এর জন্য স্টুডিয়ো পাড়ায় কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে কাজের অভাবে বা কাজের চাপে কেউ দিশা হারিয়ে না ফেলেন। প্রয়োজনে মনের কথা খুলে বলতে পারেন। অবসন্নকে মৃত্যু নয়, বাচাঁর পথ দেখাবে সুচিকিৎসা। একই সঙ্গে আত্মহনন রুখতে সাহায্যকারী নম্বর চালু করার প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে এ দিন। যেখানে ফোন করে কথা বলে চূড়ান্ত পদক্ষেপ থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে পারবেন বিনোদন দুনিয়ার মানুষেরা।
অতিমারির সময়ে নানা বিষয় নিয়ে আর্টিস্ট ফোরাম-ফেডারেশনের মধ্যে মতবিরোধ দেখেছে টেলিপাড়া, সংবাদমাধ্যমও। এ দিন সব ভুলে সমাধানসূত্র খোঁজার তাগিদ ছিল ফেডারেশনের সভাপতির কথাতেও। কথার শুরুতেই স্বরূপ বিশ্বাস এই প্রজন্মকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান। বলেন, ‘‘চাইলেই সব পাওয়া যায় না। অবশ্যই স্বপ্ন দেখা উচিত। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু শুরুতেই সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। সেটাও মেনে নিতে হবে। না হলেই বিপত্তি।’’ প্রযোজক, পরিচালকদেরও নতুনদের পাশাপাশি প্রতিভাসম্পন্নদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ারও অনুরোধ জানান। ইন্দ্রাণী হালদারের মতে, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন প্রজন্মকে লড়ে এগিয়ে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে আরও। তাঁর কথায়, ‘‘একটা সময় সবাই বলতেন সিনেমায় নেমেছে। এখন তো সিনেমার হাত ধরে সবাই উঠছেন। খ্যাতি, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি পাচ্ছেন। ইন্ডাস্ট্রি অনেক কিছু দিচ্ছে। তাই খারাপ সময় এলে ভেঙে পড়বেন না। অনুরোধ, আত্মহত্যা করবেন না। এতে আদতে কলুষিত হচ্ছে বিনোদন দুনিয়া। ’’
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের নাট্যদল ‘নান্দীকার’-এর কথা আলোচনা সভায় তুলে ধরেন সোহিনী সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘খুব ছোটবেলায় বাবার দলে নাম লিখিয়েছি। তখন থেকে দেখেছি একটি প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে অভিনেতা তৈরি করতেন মা-বাবা।’’ সেই অনুযায়ী আজও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা বজায় আছে নাট্যদলে। সবাই সমান, এই মনোভাব ধরে রাখতে দেবশঙ্কর হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, সপ্তর্ষি মৌলিক-সহ প্রথম সারির অভিনেতারা সবাই নিজেরা মঞ্চে সেট বয়ে নিয়ে যান। পোশাক ইস্ত্রি করেন। নিজের রূপটান নিজে নেন। একই কাজ রুদ্রপ্রসাদ বা স্বাতীলেখা সেনগুপ্তও করতেন। পাশাপাশি, দলের শিক্ষক বা পরিচালকের আচরণ পছন্দ না হলে শিক্ষার্থীরা সরাসরি তার প্রতিবাদ জানাতে পারেন।
আত্মহত্যার পর সাধারণত সমাজ মৃতকেই দোষারোপ করে। এ দিনের আলোচনা সভায় তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাদশা মৈত্র। আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে অভিনেতার দাবি, ‘‘কেউ শখে আত্মহত্যা করেন না। প্রবল চাপে তলিয়ে যাওয়ার আগেও আত্মহননকারী খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চান। না পেলে তবেই জীবনের হাত ছাড়তে বাধ্য হন। মৃত্যুর পরেও তাঁর রেহাই নেই। সমাজ, চারপাশের মানুষ তাঁকেই দায়ী করেন। এই মনোভাব একুশ শতকে মানায় না। যেখানে আইন বলছে, আত্মহত্যা অপরাধ নয়।’’ বাদশার মতে, সবাই এই প্রজন্মের ভোগবিলাসকেও দায়ী করছেন। অথচ চারদিকে রকমারি নামীদামি পণ্যের মেলা। সমস্ত পেশাতেই সারা ক্ষণ প্রলোভনের হাতছানি। সব সময়ে তার থেকে দূরে থাকা সম্ভব? এগুলো বন্ধ না হলে প্রজন্মর পর প্রজন্ম নষ্ট হবে।
অন্য দিকে, আর্টিস্ট ফোরামের পক্ষ থেকে দিগন্ত বাগচী জানিয়েছেন, আত্মহত্যা একটা জোরালো প্রবণতা। এক জন এই পথে হাঁটলে, সেই খবর ছড়িয়ে পড়লে অবসাদে ভোগা অন্য মানুষটিও তখন একই পথে হাঁটতে চান। সেই কারণেই হয়তো পর পর চার মডেল অভিনেত্রী একই ভাবে নিজেকে শেষ করে ফেললেন।
উপস্থিত চিকিৎসকদের দাবি, ২০ থেকে ২৫ এবং ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তাই দ্রুত প্রতিটি শ্যুটিং ফ্লোরে মনোবিশ্লেষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এই বয়সের অভিনেতা, কলাকুশলীদের সঙ্গে কথা বলে আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকানো যায়।