ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির জট খুলবে! মিলবে গুপ্তধনও! ইসরো বলল, কেন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে গোটা বিশ্ব

চাঁদের দক্ষিণ মেরু যেন গুপ্তধনের আরত। পরতে পরতে রহস্য জড়িয়ে রয়েছে এর অন্ধকার, হিমশীতল, পাথুরে কণায়। মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেন, তেজস্ক্রিয় মৌলের ভাণ্ডার রয়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠের ওই রুদ্ধদ্বারে। পৃথিবী সৃষ্টির রহস্যে কি সেখানেই সুপ্ত? সৌরজগতের অজানা দিকগুলো দরজা বন্ধ করে সেখানেই কি ঘুমিয়ে রয়েছে, কোনও এক অদৃশ্য জাদু কাঠির ছোঁয়ায়? তাহলে কেন চাঁদের দক্ষিণ মেরু অভিযানের জন্য এত ব্যতিব্যস্ত গোটা বিশ্ব! ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো জানাল তার কয়েকটি কারণ।

শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ইসরোর ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ উপগ্রহ দিয়ে। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্থির করেছিল প্রতিরক্ষা, নজরদারি আর আবহাওয়া পূর্বাভাসেই আটকে থাকবে না ভারতের মহাকাশ-অভিযান। মহাকাশের গভীর থেকে গভীরতর কক্ষের কপাট খুলবে ইসরো। মহাকাশ গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে ব্রহ্মাণ্ডের অজানা, অচেনা মুলুকে। পৃথিবী সৃষ্টির জট যদি খুলতে হয়, তাহলে প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত চাঁদ। কারণ চাঁদ ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের সম্ভাবনাই থাকত না।

পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য, ব্রহ্মাণ্ডের অজানা দিকের ভেদ খুলতে পারে দক্ষিণ মেরু অভিযান

ইসরোর মহাকাশবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কোটি কোটি বছর ধরে দক্ষিণ মেরু সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত। সৌরগজগতের অনেক গোপন রহস্যের বীজ বুনে চলেছে সন্তর্পনে। আমাদের নীল গ্রহের জন্মরহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও সেখানে মেলা সম্ভব। পৃথিবীর আত্মজা হল চাঁদ। ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীতে যে দিন-রাতের চক্র ঘুরে চলেছে সেটাও সম্ভব হচ্ছে চাঁদের অভিকর্ষজ বলের জন্যই। এই টানের কারণেই পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি একটু একটু করে কমছে, বিপরীতে বাড়ছে পৃথিবীর দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য। মহাসাগরে জোয়ার-ভাঁটা থেকে পৃথিবীর ঋতুচক্র— সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছে চাঁদ। কাজেই প্রাণ সৃষ্টির গোপন কথা সেখানেই নিহিত রয়েছে যত্ন করে।

জলের খোঁজে..

১০ কোটি টন জল রয়েছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে (৭০ ডিগ্রি অক্ষাংশ), এমনটাই দাবি মহাকাশবিজ্ঞানীদের।  চাঁদ তার কক্ষপথে সামানঅয় হেলে থাকায়, সূর্যের আলো যতটা উত্তর মেরুতে এসে পড়ে, ততটা দক্ষিণ মেরুতে পড়ে না। ফলে চাঁদের ওই অংশে সৌর বিকিরণের প্রভাব অনেকটাই কম। বিজ্ঞানীদের ধারণা, তরল জলের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় রয়েছে চাঁদের ওই ৭০ ডিগ্রি অক্ষাংশেই।

তাহলে কি চাঁদ-মুলুকে বাসা বানাতে পারে মানুষ? ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সেই সম্ভাবনা কম। কারণ চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, চৌম্বকক্ষেত্রও নেই। তবে বিপুল জলের খোঁজ পেলে, (H2O)সেখান থেকে তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাইড্রজেন ও অক্সিজেনে ভেঙে নেওয়া সম্ভব। এই অক্সিজেন শ্বাসপ্রশ্বাসকে স্বাভাবিক রাখবে। আর হাইড্রজেন ব্যবহার করা যেতে পারে জ্বালানি হিসেবে। চাঁদের ওই মেরুতে আবার বরফ থাকার সম্ভাবনাও অনেক বেশি।

ভবিষ্যতে জ্বালানির উৎস হতে পারে চাঁদের দক্ষিণ মেরু

পৃথিবীতে যে ভাবে জনবসতি বাড়ছে তাতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে টান পড়তে বাধ্য। এ দিকে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো অপ্রচলিত শক্তির (বায়ুমণ্ডল, সৌরশক্তি) বদলে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে পরমাণু বিদ্যুতের উপর। সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভরসা পরমাণু চুল্লি বা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর। বিভাজন প্রক্রিয়া বা নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, প্ল্যাটিনামকে জ্বালি-পুড়িয়ে তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি। কিন্তু, যে ভাবে যথেচ্ছ পরিমাণ তেজস্ক্রিয় মৌল ব্যবহার হচ্ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে, তাতে অচিরেই সেই ভাঁড়ার খালি হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে তেজস্ক্রিয় মৌলের বড়সড় ভাঁড়ার রয়েছে। যার লোভেই আমেরিকা, রাশিয়া, চিন বারে বারেই অভিযান চালানোর চেষ্টা করেছে চন্দ্রপৃষ্ঠের দক্ষিণ ভাগে। আমেরিকার ‘অ্যাপোলো’ মিশনেরও লক্ষ্য ছিল তেজস্ক্রিয় মৌল আহরণ।

চাঁদের দক্ষিণ মেরু অভিযান

তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাব কমবে, যদি হিলিয়াম-৩ মৌল মেলে দক্ষিণ মেরুতে

অপ্রচলিত শক্তির উৎপাদন বাড়াতে বর্তমানে তৎপর গোটা বিশ্ব। কারণ ‘গ্রিন হাউস’ গ্যালের প্রভাব কমিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ণ রুখতে ভরসা এই অপ্রচলিত শক্তিই। ইসরো জানিয়েছে, হাইড্রজেন, অ্য়ামোনিয়া, মিথেন, সোডিয়াম, পারদ (মারকারি) এবং রূপো তো মিলবেই, পাশাপাশি চাঁদের বালিকণা থেকে নিষ্কাশন করা যেতে পারে হিলিয়াম-৩ মৌল। পৃথিবীতে প্রাপ্ত ডয়টেরিয়াম অক্সাইড (D2O)-এর সঙ্গে হিলিয়াম-৩ মৌলের বিক্রিয়ায় তৈরি হবে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এড়ানো যাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের বিপদ। চাঁদের ধুলো, বালিকণা হাতড়ে হাতড়ে এই হিলিয়াম-৩ মৌলের খোঁজ চালাবে চন্দ্রযানের রোভার ‘প্রজ্ঞান।’

ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট বোঝার আগে চাঁদেই হাতেখড়ি উন্নত মহাকাশ গবেষণার

ইসরোর ‘সোলার মিশন’ হতে পারে ২০১০ সালেই। আদিত্য-অভিযামের স্বপ্ন শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিরও রয়েছে। তারই শুরুটা হবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু দিয়েই। সৌর-মুলুকের সুলুকসন্ধান দেবে চাঁদই। পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝের এক কক্ষপথ ‘ল্যাগরাঞ্জিয়ান পয়েন্ট’ বা ‘ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট’-এ ইসরোর আদিত্য এল ১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.