Doctorji had chosen Madhav Sadashiv Golwalkar, a professor at Benares Hindu University, as his successor during his lifetime. The students used to call the handsome young professor, who looked like a monk, ‘Guruji’. That address later became public. He was a disciple of Swami Akhandananda, a disciple of Sri Ramakrishna. Swamiji told him not to join the Sri Ramakrishna Mission, but to take charge of the Sangh. After 33 years of tireless work as the second Sarsanghachalak, he has made the Sangh much wider and multidimensional. It was said, ‘The train compartment was his home. He always traveled from one end of the country to the other. On the night of June 5, 1973, this sage died in Nagpur. The next morning for his last visit Rathindra Mohan Bandyopadhyay, the former Mahanagar Sanghachalak of Howrah, was one of the few who flew to Nagpur from Kolkata. On his return, he wrote a report in two issues of the weekly Swastika on June 16 and 25, 1973, the day of Sri Guruji’s last journey. Considering the historical significance of the day, the report is reprinted exactly.

i

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) এর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘফচালক (প্রধান) পরমপুজনীয় মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর (গুরুজী)-র ৫০ তম মহাপ্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(আবির্ভাব-১৯.২.১৯০৬, তিরোধান-৫.৬.১৯৭৩)

ডাক্তারজি তাঁর জীবদ্দশাতেই নিজের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করে গিয়েছিলেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরকে। সন্ন্যাসীসদৃশ সুদর্শন তরুণ অধ্যাপককে ছাত্ররা ‘গুরুজি’ বলে ডাকত। সেই সম্বোধনই পরবর্তীকালে সর্বজনীন হয়ে গেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্য স্বামী অখণ্ডানন্দের শিষ্য ছিলেন তিনি। স্বামীজিই তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনে যোগদান নয়, সঙ্ঘের দায়িত্বভার নিতে বলেন। দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক হয়ে ৩৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি সঙ্ঘকে বহুধা বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক করেছেন। বলা হত, ট্রেনের কামরাই ছিল তাঁর ঘরদোর। সর্বদাই দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়াতেন। ১৯৭৩ সালের ৫ই জুন রাতে নাগপুরে এই ঋষিকল্প কর্মযোগীর দেহাবসান ঘটে। তাঁকে শেষ দর্শনের জন্য পরের দিন ভোরে কলকাতা থেকে যে কয়েকজন বিমানে নাগপুরে পৌঁছেছিলেন, হাওড়ার পূর্বতন মহানগর সঙ্ঘচালক রথীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের একজন। ফিরে এসে তিনি সাপ্তাহিক স্বস্তিকা-র দু’টি সংখ্যায় ১৮ই ও ২৫শে জুন, ১৯৭৩ শ্রীগুরুজীর শেষযাত্রার সেই দিনটি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন লেখেন। দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় সেই প্রতিবেদনটি হুবহু পুনর্মুদ্রিত করা হল।

রাজপথে

অমৃতবাজার পত্রিকা একবার শ্রীগুরুজীর নেতৃত্বের প্রশংসা করে লিখেছিল, “তিনি আসিলেন, দেখিলেন এবং বিজয়ের সম্ভাবনা সূচিত করিলেন’ (He came he saw & gave every indication that he might conquer)। সত্যই তাই। সুমহান ব্যক্তিত্ব, পিতৃসুলভ স্নেহ ও অপুর্ব সংগঠন ক্ষমতার গুণে আসেতুহিমাচল লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের গভীরে যে তিনি স্থান করে নিয়েছিলেন, দুঃসংবাদ পাওয়া মাত্র গুরুজীকে শেষবারের মতো দেখার জন্য নাগপুরে ছুটে আসা সেদিনের শোকাকুল বিশাল জনসমষ্টিই তার প্রমাণ। ৫ জুন রাত্রে মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাগপুরে হেডগেওয়ার ভবনে শুরু হয়েছে জনস্রোত। তারপর সারারাত, সারাদিন; বিকেলে শোকযাত্রা শুরুর আগে পর্যন্ত দর্শনার্থীরা এসেছেন অবিরাম। লাইন দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে দেখেছেন গুরুজীকে— শান্ত, সমাহিত। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে কেউ কেউ ভেঙে পড়েছেন কান্নায়, কারও চোখ অশ্রুসজল, কেউ শোকস্তব্ধ।

সেদিন নাগপুরে

গুরুজীর শোকযাত্রায় বিপুল জনসমাগম নাগপুর শহরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব হলেও সারা ভারতের শোকসন্তপ্ত নরনারীর তা একটা অতিসামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। কেননা, যানবাহনের অভাবে অধিকাংশ প্রান্তেরই মানুষ পৌঁছতে পারেননি নাগপুরে। অনন্যোপায় হয়ে অসহায়ের মত ছটফট করেছেন। পৌঁছতে পেরেছেন কেবল আশেপাশের কয়েকটি প্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চলের স্বয়ংসেবকরা। অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাডু, বিদর্ভ, মহারাষ্ট্র, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ থেকে, স্বয়ংসেবকরা যে যা যানবাহন পেয়েছেন, তাতে করেই ছুটে এসেছেন। বাসে, ট্রেনে, বিমানে। দিল্লী ও বোম্বাই থেকে এসেছে দুটি চ্যার্টার্ড বিমান। কলকাতা থেকেও পশ্চিমবঙ্গের সংঘচালক অধ্যক্ষ কেশবচন্দ্র চক্রবর্তীসহ আমরা কয়েকজন বিমানে পৌঁছাই। বিবেকানন্দ শিলা স্মারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রী একনাথ রানাড়ে কলকাতায় ছিলেন। তিনিও যান আমাদের সঙ্গে।

হেডগেওয়ার ভবনে

সকাল ন’টা নাগাদ নাগপুরে পৌঁছে মনে হচ্ছিল, দুপুর হয়ে গিয়েছে। রোদের প্রচণ্ড তাপ। কিন্তু তারই মধ্যে হেডগেওয়ার ভবনের সামনে দর্শনার্থীদের বিরাট লাইন। উঠোনে, বাইরের মাঠে শোকার্ত স্বয়ংসেবকরা বসে আছেন। এখানেই দেখা পেলাম। ভারতীয় মজদুর সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্রী দত্তপন্থ ঠেংড়ির – স্বয়ংসেবকদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। গুরুজীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় তিনি তাঁর শয্যাপার্শ্বে ছিলেন। অসুস্থ গুরুজীকে দেখতে এসে এরকম একটা চরম বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী হতে হবে, ঠেংড়িজী তা কখনও ভাবতেও পারেননি।

হেডগেওয়ার ভবন প্রাঙ্গণে

হেডগেওয়ার ভবনের একতলার প্রশস্ত পাঠাগার কক্ষে গুরুজীর মরদেহ শায়িত ছিল। প্রখর তাপে দেহ যাতে বিকৃত না হয় বা তাতে পচন না ধরে তারজন্য ঘরটিকে ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। মৃতদেহের চারপাশে থালায় করে বরফের চাঁই রাখা হয়, চালিয়ে রাখা হয় গোটা চারেক এয়ার কুলিং মেশিন। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি তক্তপোষের উপর দক্ষিণে মাথা এবং উত্তরে পা করে মরদেহ রাখা ছিল। মুখমণ্ডল ছাড়া শরীরের সর্বাংশ ফুলে ফুলে ঢাকা। পূর্বের দেওয়ালের গা ঘেঁসে একটি উঁচু বেদীর উপর রাখা ছিল গুরুজীর একটি তৈলচিত্র – গত বছর দিল্লীতে দীনদয়াল গবেষণা কেন্দ্র ভবনের উদ্বোধনের সময় গুরুজী হোম করছেন, শিল্পীর তুলিতে ধরে রাখা সেই মুহূর্তের চিত্র। উত্তরের একটি দরজা দিয়ে দর্শনার্থীরা আসছেন, শ্রদ্ধা নিবেদন করে বেরিয়ে যাচ্ছেন পশ্চিমের একটি দরজা দিয়ে। ঘরেরই উত্তর-পশ্চিম কোণে বেশ কয়েকজন মহিলা বসে চোখের জল ফেলছেন। দেখলাম, জনসঙ্ঘ নেত্রী শ্রীমতী সুকলিকরও রয়েছেন তাঁদের মধ্যে।

আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন সঙ্ঘের কলকাতা শাখার কার্যবাহ ডাঃ সুজিত ধরও। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবারই তিনি নাগপুরে এসেছেন। সে আসার সঙ্গে এবারের অনেক ফারাক। আগে এসেছেন গুরুজীকে বাঁচানোর সংকল্প নিয়ে, এবার এসেছেন নিয়তির হাতে পরাজিত সৈনিকের বেদনা নিয়ে। বিশিষ্ট আয়ুর্বেদ চিকিৎসক পণ্ডিত রামনারায়ণ শাস্ত্রী গুরুজীর চিকিৎসা করছিলেন। তাঁকে সাহায্য করছিলেন যেসব চিকিৎসক, তাঁদের মধ্যে ডাঃ সুজিত ধরও একজন। কিছুদিন অন্তরই এজন্য তাঁকে নাগপুরে আসতে হত। শেষ এসেছিলেন দশদিন আগে। গুরুজীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সঙ্গী অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে রিপোর্ট লিখেছিলেন, এখন অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। সুতরাং এখন সাতদিন অন্তর পরীক্ষার প্রয়োজন নেই, একমাস অন্তর করলেই চলবে। তাই গুরুজীর মৃত্যুসংবাদ তাঁর কাছে কেমন যেন অবিশ্বাস্য লেগেছিল।

গুরুজীর মরদেহে বালাসাহেব দেওরসজির পুষ্পার্ঘ্য

অশ্রুসজল দৃশ্য

পাঠাগার কক্ষে ঢুকে ডাঃ ধর ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন গুরুজীর পায়ের কাছে মাথা রেখে। পশ্চিমবঙ্গের সংঘচালক অধ্যক্ষ কেশব চন্দ্র চক্রবর্তী সহ অন্যদেরও একই অবস্থা।

গুরুজী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হেডগেওয়ার ভবন সংলগ্ন তাঁর ছোট বাড়িতেই। জনসাধারণের দর্শনের সুবিধার জন্য রাত্রে মরদেহ পাঠাগার কক্ষে নিয়ে আসা হয়।

যে ছবি মোছবার নয়

মৃত্যুর সময় গুরুজী বসেছিলেন একটি বেতের চেয়ারে। বুধবার সকালে গুরুজীর ঘরে ঢুকে দেখলাম সেই চেয়ারটিতে রাখা হয়েছে গুরুজীর একটি ছবি, মালা দেওয়া। চেয়ারটির ঠিক মাথার উপরে দেওয়ালে টাঙানো শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি। চেয়ারের বাঁ পাশে চাদরে ঢাকা দু’টি টুল। টুলের উপরই রাখা গুরুজীর চশমা, পকেট ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি ইত্যাদি কয়েকটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস। চেয়ারের ডানপাশে একটি কমণ্ডলু। গুরুজীকে সেটি দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্য স্বামী অখণ্ডানন্দ। শুনলাম সাধারণতঃ কমণ্ডলুটি গুরুজী রাখতেন তার বাঁ পাশে। কিন্তু যখন বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেন তখন সেটি রাখতেন ডান পাশে। ৫ই জুন সকালে তিনি কমণ্ডলুটি বাঁ দিক থেকে তুলে নিয়ে ডান ধারে রাখেন। তখন অবশ্য কেউ বোঝেনি এর তাৎপর্য কী, বোঝেনি একেবারে চলে যাওয়ার জন্যই তিনি তৈরি হচ্ছিলেন। ঘরের পূর্ব দিকে মেঝেতে এক জায়গায় একটি হরিণের চামড়া বিছানো, এতে বসেই গুরুজী রোজ সন্ধ্যা আহ্নিক করতেন। পূর্বের দেওয়ালে টাঙানো স্বামী অখণ্ডানন্দের একটি ছবি। দক্ষিণ দিকে তাঁর শোবার খাট। শেষদিন পর্যন্ত ওতেই শুয়েছেন। ৫ তারিখ ডঃ পরাঞ্জপে তাঁর জন্য একটি বিশেষ ধরনের খাট নিয়ে আসেন, যাতে তিনি হেলান দিয়ে আরামে শুতে পারেন, গুরুজী ডঃ পরাঞ্জপেকে বলেন ঐ খাট আর তাঁর ব্যবহার করা হয়ে উঠবে না। তার চেয়ে এই বেতের চেয়ার অনেক বেশি আরামের।

শেষঘণ্টা বাজছে।

সকালে স্নানের পরই তিনি বেশ দুর্বলতা অনুভব করেন। ব্যক্তিগত সচিব ডাঃ আবাজী থাটে বলেন, ‘আখরি ঘন্টি বাজ রহি হ্যায়’ (শেষ ঘণ্টা বাজছে)। তা সত্ত্বেও সকাল আটটা নাগাদ জনসঙ্ঘ নেতা শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী তাঁকে দেখতে এলে তিনি তাঁর সঙ্গে বেশ ভালভাবেই কথাবার্তা বললেন। তখন বেশ প্রফুল্লই ছিলেন তিনি। স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়েনি। অটলজীর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় অন্ধ্রের আদিলাবাদ থেকে আসা একজন ডাক্তারও ছিলেন সেখানে। গুরুজী ডাক্তারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘একজন রোগী নিজেকে দেখানোর জন্য ডাক্তার ডাকেন। ডাক্তার এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী হয়েছে? রোগী তো অবাক, তার কী হয়েছে ডাক্তার কোথায় বলবে, না সে-ই জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে? ডাক্তার তখন চলে গিয়ে একজন পশু চিকিৎসককে নিয়ে এলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন, ‘ইনি রোগীকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই চিকিৎসা করতে পারেন। আপনি ওঁর সাহায্য নিতে পারেন।” গল্পটি বলে গুরুজী হাসলেন। বললেন, “তাহলে দেখলেন দু’রকম ডাক্তার আছেন। এখন বলুন আপনি কোন ধরনের ডাক্তার?” গুরুজীর এই রসালাপ সকলেই বেশ উপভোগ করেন। তারপর সকলের জন্য চা আসে। গুরুজী দেখলেন একজন চা খাচ্ছেন না। তিনি কী খাবেন জিজ্ঞেস করে তাঁর জন্য এক কাপ দুধ আনতে বলেন।

দুপুরের পরই তাঁর অসুস্থতা বাড়ে। খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা হয়। ডাক্তাররা তাঁকে পেথিড্রিন দেন। এইভাবে চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা সওয়া সাতটায় সঙ্ঘের প্রার্থনার সময়। শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও গুরুজী চাইলেন, অন্যদিনের মত দাঁড়িয়েই প্রার্থনা বলবেন। ডাক্তার ও সঙ্ঘের অধিকারীরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে চেয়ারে বসে প্রার্থনা করতে রাজি করান। প্রার্থনার সময় নিয়মমত ডান হাতটি তিনি সর্বক্ষণ বুকের কাছে রাখেন। তবে একটানা উচ্চারণে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল।

সাড়ে সাতটা নাগাদ তাঁর অবস্থা বেশ ভাল দেখে ডাক্তাররা চলে যান। এই অবস্থা চলে প্রায় আটটা পর্যন্ত। এই সময় তিনি একবার বলেন, “একটা মাত্র ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন। সারা ভারতে এখন সংঘ শিক্ষা বর্গ চলছে। সেগুলি বিঘ্নিত হয় বা অধিকারীদের সফর কর্মসূচী বাতিল হয়, তা আমি চাই না।”

ডাক্তাররা তাঁকে বাথরুমে না গিয়ে বেড প্যান ও ইউরিন পট ব্যবহার করতেও বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সেই কথা শোনেননি। সন্ধ্যাহ্নিকের জন্য তৈরি হওয়ার উদ্দেশ্যে রাত আটটা নাগাদ তিনি বাথরুমে যান। সঙ্গে ছিলেন দু’জন স্বয়ংসেবক। ফেরার সময় কারোর সাহায্য না নিয়ে উঠে দাঁড়ান বটে, কিন্তু চলতে চলতে শক্তিহীন হয়ে পড়েন। স্বয়ংসেবক দু’জন তাঁকে তুলে ধরে নিয়ে আসেন।

থাটেজী দেখেন, গুরুজী খুব ঘামছেন নাড়ীও পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ডাক্তারকে ডেকে পাঠানো হয়। তাঁরা এসে ওষুধ দেন, অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের জন্য নাড়ীর স্পন্দন বাড়ে, তারপর আবার তা ডুবতে থাকে। ডাঃ পেনডসে, শাস্ত্রী, ইম্বপাওয়ারের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঘণ্টাখানেক বাদে রাত ৯টা ৫ মিনিটে গুরুজী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

দুঃসংবাদ যখন বাতাসে ছড়ালো

নাগপুরের সংঘ শিক্ষা বর্গের একজন শিক্ষক জানালেন, ওইদিন বিকালে শিক্ষার্থীদের পথ সঞ্চলন ছিল। সেসব সেরে বাড়ি ফিরে সবে খেয়ে উঠেছেন, সঙ্গে সঙ্গে দুঃসংবাদটি গিয়ে পৌঁছায়। দুঃখ করে বললেন, গুরুজী রোজ সকালে নাগপুরে সংঘ শিক্ষা বর্গে আসা কিছু স্বয়ংসেবকের সঙ্গে মিলিত হতেন। এইভাবে সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গিয়েছিল। বর্গের শিক্ষকদের ইচ্ছা ছিল, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন দেখা হয়ে গিয়েছে, তখন গুরুজীকে কয়েকদিন বিশ্রাম দিয়ে তাঁরা একবার তাঁর সঙ্গে মিলিত হবেন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না।

সবাই এলেন নানাদিক থেকে

গুরুজী যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন সংঘের বিশিষ্ট অধিকারীদের কেউই নাগপুরে ছিলেন না, সবাই তখন বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে। সর-কার্যবাহ শ্রী বালাসাহেব দেওরস ছিলেন হায়দ্রাবাদে। নানাভাবে সকলকে খবর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। গুরুজীর শেষকৃত্যের আগে নাগপুরে পৌঁছাবার ক্ষীণতম আশা যিনি দেখতে পেয়েছেন, তিনিই রওনা দিয়েছেন। অনেকে সময়ে পৌঁছে যান, অনেকে পারেননি। শ্রী বালাসাহেব দেওরস এসে পৌঁছান পরের দিন দুপুরের কিছু আগে। জনসঙ্ঘ সভাপতি শ্রী লালকৃষ্ণ আদবানী, সাধারণ সম্পাদক শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারী, শ্রীবাজপেয়ী প্রমুখ আসেন বিকালে।

পৌরসভা বন্ধ

গুরুজীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এদিন নাগপুর পৌরসভার কাজকর্ম বন্ধ রাখা হয়। শহরের অনেক অঞ্চলে স্বতঃস্ফুর্তভাবে দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। পৌরসভার অধিবেশনে গুরুজীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে অন্যান্যদের মধ্যে মুসলীম লীগ সদস্যও বক্তৃতা করেন।

শেষ দর্শনের জন্য

আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল শোকযাত্রা শুরু হবে বিকাল পাঁচটায়। তার জন্য চারটে নাগাদ প্রস্তুতি শুরু হয়। হেডগেওয়ার ভবনের বাইরে দুপুর দু’টো থেকে লোক জমতে শুরু হয়। গুরুজীকে শেষ দর্শনের লাইনও ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাঁচ-ছুটি লাইন পড়ে যায়। শুধু স্বয়ংসেবকরা নয়, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ আসেন বিপুল সংখ্যায়। মহিলারা আসছেন হাজারে হাজারে। পাঁচটার অনেক আগেই হেডগেওয়ার ভবনের আশেপাশের সমস্ত জায়গা ভরে যায়। সব রাস্তা হয়ে যায় একমুখী। সকলের লক্ষ্য তখন হেডগেওয়ার ভবন।

এদিকে হেডগেওয়ার ভবনের উঠোনে চলছে তখন পদযাত্রার প্রস্তুতি। কোন ভাল খাট আনা হয়নি, দুটি বাঁশ ও তার মাঝে কয়েকটি বাখারি লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে শবাধার। গুরুজী অতি সাধারণ মানুষের মত যেতে চেয়েছিলেন, তারই জন্য হয়ত এই ব্যবস্থা। বাঁশের শবাধারের ওপর প্রথমে দর্মা, তার উপর সামান্য বিছানা এবং বিছানার উপর হরিণের একটা চামড়া পেতে শোয়ানো হয়েছিল গুরুজীকে। তারপর মৃতদেহ আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হয় দড়ি দিয়ে।

শেষ যাত্রার আগে

সারাদিন রোদের এক মুহূর্ত বিরাম ছিল না। শবযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে এল। মরদেহ হেডগেওয়ার ভবন থেকে উঠোনে বের করে আনার আগে, স্বয়ংসেবকদের উদ্দেশে গুরুজীর লেখা শেষ পত্রগুলি মাইকে পড়ে শোনানো হয়। প্রথম পত্র—যাতে গুরুজী শ্রীবালাসাহেব দেওরসকে সরসঙ্ঘচালক মনোনীত করার কথা ঘোষণা করেছেন—পড়ে শোনান শ্রী বালাসাহেব ভিড়ে। দ্বিতীয় পত্রটি ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। সেটা পড়তে গিয়ে শ্রী বালাসাহেব দেওরসের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায়। বাইরের বিশাল জনসমুদ্রও নিজেদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। পারেনি প্রকৃতিও, ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও।

উঠোনে বের করে এনে গুরুজীর মরদেহকে একটি পিঁড়ের উপর বসানো হয়। তারপর বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের পর তাঁকে স্নান করানো হয়। পুরনো কাপড় জামা বদলে নতুন কাপড় জামা পরানো হয়। তারপর তোলা হয় শবাধারে। এই সময় নাগপুর নগর কংগ্রেস সভাপতি, নগর পুলিশের প্রধান, কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শবাধারে মাল্যদান করা হয়।

শোকযাত্রা শুরু হল

গুরুজীর দেহ গৈরিক বস্ত্রে ঢেকে শবাধারটি একটি ট্রাকের উপর স্থাপন করা হয়। তারপর শুরু হয় শোকযাত্রা। সকলের কণ্ঠে তখন ‘শ্রীরাম জয় রাম জয় জয় রাম’ ধ্বনি। মাঝে মাঝে ‘ভারতমাতা কী জয়’, ‘পরম পূজনীয় শ্রীগুরুজী অমর রহে’ ধ্বনিও উঠেছে। মরদেহবাহী ট্রাকের ঠিক পিছনে ছিলেন শ্রী বালাসাহেব দেওরস, শ্রী একনাথ রানাড়ে প্রমুখ সঙ্ঘের বিশিষ্ট অধিকারীরা। আগে পিছে লাইন করে চলেছে বিরাট জনস্রোত। শোকযাত্রা যে-সব রাস্তা দিয়ে যাবে ঘণ্টাখানেক আগে থেকে সে-সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাস্তার দুধারে, বাড়ির বারান্দায় ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসংখ্য মানুষ। অনেকের হাতে ফুলের মালা। পাহাড়ী পথের মত নাগপুরের অনেক রাস্তায় খাড়াই উৎরাই রয়েছে। শবযাত্রার সাথী হয়ে খাড়াই রাস্তার একেবারে উঁচুতে উঠে পিছন ফিরে দেখেছি, যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। বলতে গেলে সারা নাগপুর শহর। নেমে এসেছিল রাস্তায়। অনেকের মুখেই শুনেছি, পরের দিন স্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতেও পড়েছি, নাগপুরের ইতিহাসে এরকম জনসমাবেশ নাকি ইতিপূর্বে আর কখনও হয়নি। জায়গায় জায়গায়, অনেক বাড়ির বারান্দায় গুরুজীর ছবি মালা দিয়ে সাজানো। হিন্দু মহাসভা ও জনসংঘ অফিসের পতাকা অর্ধনমিত।

রেশমবাগে

প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে শোকযাত্রা রেশমবাগ সঙ্ঘস্থানে পৌঁছায়। ডাক্তারজীর সমাধি মন্দিরের ঠিক সামনে গুরুজীর শেষকৃত্যের জন্য একটি অস্থায়ী বেদী তৈরি করা হয়। ওইখানে দাঁড়িয়েই গুরুজী অনেকবার স্বয়ংসেবকদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন। বেদীর আশেপাশের কিছু জায়গা ছাড়া গোটা রেশমবাগ ময়দান ভরে গিয়েছিল স্বয়ংসেবক এবং শবানুগমনকারী নরনারীদের দ্বারা। মাঠের একদিকে মহিলাদের বসার ব্যবস্থা হয়েছিল, কিন্তু এত বিপুল সংখ্যায় তাঁরা এসেছিলেন যে, একসময় এই জায়গা ছাপিয়ে যায়।

তিনি যে চেয়ে আছে! ডাক্তারদের প্রতিমূর্তির সামনে গুরুজীর বহ্নিমান চিতা

আগুনের পরশমণি

বেদীর উপর চন্দনকাঠের চিতায় গুরুজীর মরদেহ স্থাপন করা হয় রাত আটটায়। গুরুজীর সম্পর্কিত এক ভাই শ্রীবাসুদেব গোলওয়ালকর মুখাগ্নি করেন। সমবেত সকলে তখন ‘শ্রী রাম, জয় রাম, জয় জয় রাম’ ধ্বনি দিচ্ছিলেন। এর আগে সকলে সমবেতভাবে গীতার পঞ্চদশ অধ্যায় পাঠ করেন।

চিতার ঠিক পিছনে রাখা ছিল মাল্যভূষিত গুরুজীর একটি প্রতিকৃতি। অগ্নিসংযোগের পর সকল স্বয়ংসেবক দাঁড়িয়ে সরসংঘচালক প্রণাম দেন। তারপর ডাক্তারজীর স্মৃতি মন্দিরে সঙ্ঘের ধ্বজ উত্তোলন করা হয়। প্রার্থনা শেষে ধ্বজ অবতরণের পর ভিড় আস্তে আস্তে পাতলা হতে থাকে। চিতার একপাশে বসেছিলেন শ্রী বালাসাহেব দেওরস, শ্রী মাধবরাও মূলে, শ্রী যাদবরাও যোশী, শ্রী ভাউরাও দেওরস প্রমুখ অধিকারীরা।

রেশমবাগে জনতার নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য ব্যবস্থাদি করেন নাগপুরে সংঘশিক্ষা বর্ষে যোগদানকারী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত স্বয়ংসেবকরা। ভিড় কমে গেলে গুরুজীর প্রজ্জ্বলিত চিতার সামনে তাঁরা সারিবদ্ধভাবে সমবেত হয়ে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।

হেডগেওয়ার ভবনের পাঠাগার কক্ষে যেখানে গুরুজীর মরদেহ শায়িত ছিল, সেখানে জ্বেলে রাখা হয় একটি প্রদীপ ও কয়েকটি ধূপ। দূরের থেকে দেরিতে এসে পৌঁছানর জন্য গুরুজীকে শেষ দর্শন থেকে যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরা নীরবে প্রণাম করেছেন সেই জায়গাটিতে, আর ফেলেছেন দু’ফোঁটা অশ্ৰু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.