১.
ব্রত হল মনস্কামনার স্বরূপ; মানুষের কামনা চরিতার্থতার অন্যতম ক্রিয়াকর্ম। সনাতনী ধর্মের সুলভ সংস্করণ এই ব্রত, হিন্দু রমণীর সমকালীন জীবন্ত বর্ণনা, যে বর্ণনার পরতে পরতে নানা যুগের নানান আঁচড়, যে আবরণ একের পর এক সরালে বেরিয়ে আসে আবহমান ভারতবর্ষের এক শাশ্বত রূপ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “চিনির ডেলার আকারে কুইনাইন পিল।” ব্রতগুলি সনাতনী হিন্দু ধর্মের বহুজটিল অনুষ্ঠান, দেবদেবীর মাহাত্ম্য, তন্ত্র ও পুরাণকথা প্রচার ও সংযোগ-সামর্থ্যের এক ধারা। এ যেন অনন্য নীতিশিক্ষা আর ধর্ম-সংস্কৃতির এক প্রাথমিক স্কুল, বিদেশি কিণ্ডারগার্টেন প্রণালীর মতোই ভারতীয় নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় এক একটি ক্লাসের বই। গৃহ, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, প্রকৃতির প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধের একটি সহজ সরলতা ব্রতের যাবতীয় কৃত্য, চিত্র, পদ্য ও উপাখ্যানের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। এক ব্রতচারিণীর মধ্যেই রয়ে যায় দশের ছড়াছড়ি, কারণ নানান পৌনঃপুনিক সামাজিক জ্ঞানভাণ্ডার ব্রতের কৃত্যের মাধ্যমে একের পর এক এসে আচরিত হয়, একে-দশে আবারও মিলে যায় সমবেত ব্রতাচারে। একতায়-সমন্বয়ে তা হয়ে ওঠে সমগ্র জাতির প্রেরণা, অথচ আম-জনতার সাধারণ সম্পদ এগুলি, ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির উজ্জ্বল উদ্ধার। ব্যষ্টিগত উপাসনার ধারা সমষ্টির সঙ্গে অহরহ মিলে যায় ব্রতের কালে কালে অঞ্চলভেদে। পণ্ডিত মানুষদের বক্তব্য হচ্ছে, ঋতু ও বিশ্বপ্রকৃতির পট পরিবর্তনের সঙ্গে উদ্ভূত জীবনের নানান বিপর্যয়কে ঠেকাবার অদম্য ইচ্ছে থেকেই ব্রতের উৎপত্তি; বিচিত্রানুষ্ঠানের ক্রিয়াকর্মে চিরায়ত মানুষের অসংখ্য কামনা-বিন্যাস এবং প্রকৃতির সঙ্গে কখনও একান্ত নিভৃত-বাস।
২.
জ্যৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিনটিতে পালিত হয় আরণ্যক জীবনাভিজ্ঞতার এক অপরূপ কৃত্য ‘অরণ্যষষ্ঠী’। দিনটি জামাইষষ্ঠী, বাঁটাষষ্ঠী বা স্কন্দষষ্ঠী নামেও অভিহিত। অরণ্যের সঙ্গে এই দিনটি সম্পৃক্ত, সম্ভবত অরণ্য-কেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে মানুষের হারানো যোগসূত্রের সাক্ষ্য-বহনকারী একটি পার্বণ। যখন অরণ্য-মাতাই ছিলেন মানুষের বেঁচে থাকার যাবতীয় রসদদার। মানুষ যে যুগ থেকে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-ভেষজের জন্য নির্ভর করতো অরণ্যের উপর, সেই যুগের বন-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব অরণ্যষষ্ঠী। কৃষি সভ্যতার যুগেও ছিল কৃষি-বন (Agroforestry)-এর ধারণা, বহাল ছিল অরণ্যের উপর প্রতিনিয়ত নির্ভরশীলতা। তাই যুগের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যষষ্ঠীর কৃত্য ক্রমে ক্রমে বদলে গেল। নানান যুগের পলিমাটি সরিয়ে যে মূল রূপটি খুঁজে নিতে হয়, তা হল, সভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক না কেন, অরণ্য ও তার বনস্পতি, তার অপরিমেয় জৈববৈচিত্র আজও আমাদের পরম আশীর্বাদ; কৃষিমাতার সঙ্গে বনদেবী আমাদের সতত রক্ষাকর্তা। ফুলে-ফলে-পল্লবে অরণ্য ভরে থাকুক আমাদের নানান প্রয়োজনে; এ তারই কৃতজ্ঞতার উপাসনা, অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অমোচ্য-সংযোগের চিরকালীন ইতিহাস।
ষষ্ঠী সর্বদা সন্তানের মঙ্গলময়ী মাতা। কেবল আপন সন্তান নয়, আপনার কন্যার স্বামীও যে তার সন্তান, এই বোধটি প্রকটিত হয়েছে জামাইষষ্ঠী নামের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় নারী তার পুত্র-কন্যার সমগ্র পরিবারটিকে একসূত্রে গাঁথতে চান, তার প্রকাশ ঘটেছে জামাই আদরের প্রেক্ষাপটে। গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ ভারতীয় ফল পেকে ওঠে গাছের শাখায় শাখায় — আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, কলা, বুনো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙ্গা পেকে উঠেছে অজস্র। এই সুখের দিনে ছেলেমেয়ের ভরা সংসার দেখতে চান হিন্দু নারী, নাতি-নাতনীদের হৈ-হুল্লোড়, গাছে গাছে দাপাদাপি। এরপর তো শুরু হবে বর্ষা, নদীনালা জলে পূর্ণ হয়ে যাতায়াত সুখের হবে না, তাছাড়া আমন মরশুমি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। তাই ফলের মরশুমে তাদের সকলের নিমন্ত্রণ। দল বেঁধে কৃষি জমির উপান্তে জঙ্গল ঘেরা ফল বাগিচার মধ্যে কোনো এক প্রাচীন বৃক্ষের তলায় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুণ্যক্ষেত্রে পূজারিণীদের সমবেত পদচারণা।
৩.
এদিন ব্রতচারিণী হিন্দু রমণী তালপাতার এক পাখা বা ব্যজন, সঙ্গে দেবীপূজার নানান উপকরণ নিয়ে বনে প্রবেশ করেন। সেখানে বৃক্ষতলে অধিষ্ঠিত বিন্ধ্যবাসিনী অরণ্যষষ্ঠী দেবীকে আন্তরিক ভক্তিশ্রদ্ধায় পুজো করেন, সমবেতভাবে দেবীর উপাখ্যান শোনেন, তারপর নানাবিধ মরশুমি ফলমূল পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে বিতরণ করে নিজেরাও গ্রহণ করেন। সন্তানসন্ততির পরম কল্যাণ কামনাই এই ব্রতের মূলকথা। বৃহত্তর অর্থে মনুষ্য সমাজ সবাই যে অরণ্যের সন্তান। কামনা এই — দেবী অরণ্য, তুমি যাবতীয় সম্পদ ভরিয়ে দিয়ে আমাদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলো। অরণ্যের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে আমরা পরিপুষ্ট হই এবং সুসন্তান লাভ করি, তোমাকে দোহন করেই আমরা সন্তানেরা দীর্ঘায়ূ হই, ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক জনপদ। তাই অরণ্যষষ্ঠী অরণ্যের উপান্তে গড়ে ওঠা জানপদিক লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সাধনা। অরণ্যেই ছড়িয়ে পড়ত গৃহীত ফলের বীজের প্রাচুর্য; তারপরেই আসতো বর্ষার ধারা, বীজের সুপ্তি কেটে চারাগাছ বেড়ে উঠতো আপন মনেই। অরণ্যের মাঝে ফলাহারের এ এক দারুণ উৎসব, অরণ্যকেই বর্ধিষ্ণু করে তুলতো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের জঙ্গলবন্ধু যুগলপ্রসাদকে দেখি জঙ্গলের মধ্যেই সে বনস্পতির চারা লাগান, জঙ্গলেই বনসৃজন করেন। এ যে তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়! জঙ্গল কেটে ক্রমাগত বসতি স্থাপন করে, চাষাবাদ করে আমরা বনের রুখাশুখা মাটিকে নগ্ন করে দিয়েছি। বাদাবন কেটে ঝড়-ঝঞ্ঝার অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছি। অরণ্য যে কেবল কেটে নেবার জিনিস নয়, লুঠপাটের ক্ষেত্র নয়, তা ভারতীয় জীবনবোধ চিরকালই দেখিয়ে এসেছে, বিদেশি কলোনিয়াল ও অন্যান্য লুঠেরা শক্তিই ভারতবাসীকে অরণ্য লুঠপাট করতে শিখিয়েছে। অথচ প্রাচীন সাহিত্যে অরণ্যকে বলা হয়েছে ‘দেবতার কাব্য’।
দেবীর রূপকল্পনা কেমন? দেবী মানবীর মতই দ্বিভূজা, বাম কোলে একটি শিশু, দেবীর বাহন একটি কালো বেড়াল। বাহন কল্পনার মধ্যে ফার্টিলিটি-কাল্ট বা প্রজনন-সংস্কৃতিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। বেড়ালের বংশবিস্তার সম্পর্কে মানুষ সচেতন। এই দিন বেড়ালকে ভালোমন্দ খেতে দেবার মধ্যে জীবসেবার আদর্শকে ব্রতের আঙ্গিকে প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে।
৪.
কীভাবে হয় অরণ্যষষ্ঠীর পূজা? ব্রতের শ্রেণিবিভাগের দিক থেকে একে অধুনা শাস্ত্রীয় ব্রত বলা হলেও তারমধ্যে লৌকিক ধারাটিও লুকিয়ে আছে। এটি নারীব্রত; বিবাহিত মেয়েরা এই ব্রত পালন করলেও কুমারী মেয়েরা মায়ের সঙ্গে গিয়ে বিবাহের আগে থেকেই পরিচিতি লাভ করে। অরণ্যষষ্ঠী কে শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় উভয় অনুষ্ঠানের যুগলমূর্তি বলা যেতে পারে। শাস্ত্রীয় এ কারণেই — এই ব্রতের আঙ্গিকে বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা ও সজীবতা — আচমন, স্বস্তিবাচন, ‘সূর্যঃ সোমো’ মন্ত্রপাঠ, কর্মারম্ভ সঙ্কল্প, ঘটস্থাপন, আসনশুদ্ধি, ভূতশুদ্ধি, মাতৃকান্যাস, বিশেষার্ঘ্য স্থাপন, গণেশ ইত্যাদি দেবতার পূজা, অঙ্গন্যাস, করন্যাস, ষষ্ঠীর ধ্যান করে তাঁর পূজা, পূজান্তে ব্রাহ্মণকে দান-দক্ষিণা ইত্যাদি।
ভবিষ্যপুরাণে অরণ্যষষ্ঠীর ধ্যান ও প্রণামমন্ত্র পাওয়া যায়।
ষষ্ঠীধ্যান:
ওঁ দ্বিভুজাং যুবতীং ষষ্ঠীং বরাভয়যুতাং স্মরেৎ।
গৌরবর্ণাং মহাদেবীং নানালঙ্কারভূষিতাম্।।
দিব্যবস্ত্রপরীধানাং বামক্রোড়ে সুপুত্রিকাম্।
প্রসন্ন-বদনাং নিত্যং জগদ্ধাত্রীং সুখপ্রদাম।।
সর্বলক্ষণসম্পন্নাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।
এবং ধ্যায়েৎ স্কন্দষষ্ঠীং সর্বদা বিন্ধ্যবাসিনীম্।।
দেবীর প্রণামমন্ত্র:
জয় দেবি জগন্মাতর্জগদানন্দকারিণি।
প্রসীদ মম কল্যাণি নমস্তে ষষ্ঠী দেবতে।।
৫.
অরণ্যষষ্ঠীর ব্রতকথার মূল বিষয় হল, মা এবং পরিবার যে মানুষের কাছে স্বর্গসুখের চাইতে অধিক কাম্য, তার প্রকাশ। জননীকে হতে হয় সংযমশীলা, নির্লোভা, ভক্তিপরায়ণা — তাও দেখানো হয়েছে ব্রতকথায়।
এক গৃহস্থ রমণী লোভের বশবর্তী হয়ে নিত্যদিন ভাঁড়ারের নানান খাদ্যবস্তু চুরি করে খেতো, প্রশ্ন উঠলে বিড়ালের নামে অপবাদ দিত এবং এইভাবে ভোজনলালসার পরে আত্মরক্ষা করতো। এদিকে বিড়াল দেবী ষষ্ঠীর বাহন। তাই দেবীর কোপে পড়ে সেই রমণীর একাদিক্রমে ছয় পুত্র জন্মানোর অব্যবহিত পরেই মৃত্যু মুখে পতিত হল৷ এই ছয় পুত্র ছিল প্রকৃতপক্ষে শাপভ্রষ্ট বিদ্যাধর। ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শ্বশুরবাড়িতে এবং সমাজে রমণীর প্রবল বদনাম হল। তারা তাকে সন্তানভোজী রাক্ষসী ঠাওর করলো৷ বুঝি নিজের সন্তান নিজেই ধরে খায় বধূটি! আত্মগ্লানিতে ওই রমণী গৃহ পরিত্যাগ করে বনে চলে গেল। বনে অজান্তে দেবীর থানে এক বৃক্ষতলে আশ্রয় নিলো সে। এদিকে গৃহে তার শাশুড়ী-মা ষষ্ঠীর আরাধনায় রত হলেন। বনে জন্ম নিলো বধূর সপ্তম সন্তান। জন্মাতেই পূর্বের বিদ্যাধর ভ্রাতারা নবজাতককে এসে ডাক দিল, শিশুটিকে স্বর্গের যাবতীয় সুখের হাতছানি দিয়ে ডাকলো তারা। নবজাতক তার মা-কে জড়িয়ে ধরে বললে, মা কিংবা বোনকে ছেড়ে যাওয়া মোটেই সমীচীন নয়, যতই স্বর্গের ভোগ ও সুখ ডাক দিক না কেন! নবজাতক সেই ডাকে সাড়া দিলো না। মায়ের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডাকলো সেই সন্তান। সন্তানকে কোলে জড়িয়ে মা কেঁদে ফেললো; দেবী ষষ্ঠীকে একমনে ডাকতেও লাগলো। করুণাময়ী দেবীর সেই থান, দেবী আবির্ভূতা হলেন অনতিবিলম্বে; বললেন, বিড়ালের নামে অপবাদ দেওয়ার অপরাধে তিনি তার সকল সন্তানকে লুকিয়ে রেখেছেন, তার প্রতিটি সন্তানই দেবতুল্য। বধূ দেবীর চরণ প্রার্থনা করলে, তিনি এক মরা পচা বিড়ালের উপর দই ফেলে জিভ দিয়ে চেটে তা তুলে আনতে নির্দেশ দিলেন। বধূ সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে দেবীর কৃপায় বিড়াল সহ হারানো ছয়পুত্র ফিরে পেলো। সবাহন দেবীকে পুজো করে, সে সপুত্র গৃহে ফিরে এলে গৃহস্থ পরিবারে খুশির ঢল নামলো।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী