১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জেতার পরে ব্রিটিশশক্তি ভারতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা তৎকালীন ভারতের অন্যতম বৃহত্তম প্রদেশ বাংলার অবিসংবাদিত শাসক হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে সেই সময়ের বাংলা প্রদেশ ছিলো বর্তমান বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ এবং আসাম নিয়ে গঠিত। বানিজ্যিক সুবিধার জন্য একসময় তারা সমৃদ্ধশালী বন্দর চট্টগ্রামকেও এর সাথে যুক্ত করে নেয়। ফলে লুসাই, চাকমা এবং কুমিদের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি উপজাতিরা ব্রিটিশ ভারতের সংস্পর্শে চলে আসে। এইসব আদিবাসীরা মাঝে মাঝে প্রতিবেশী উপজাতিদের থেকে ট্যাক্স সংগ্রহের জন্য‚ এমনকি কেউ ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করলে তার মাথা কেটে নেওয়ার জন্য অভিযান চালাত।
তাদের এই মাথা কেটে নিয়ে যাওয়ার অভ্যাসের পেছনে একটা কারণও ছিলো। আগে যখন তারা শত্রু অঞ্চলে অভিযান চালাত তখন কেবল লুটের মাল নিয়ে বাড়ি ফিরলে তাদের হাতে নিহত শত্রুদের কাহিনী বাড়ির কেউ বিশ্বাস করত না। তাই তারা বিশ্বাস করানোর জন্য তাদের হাতে নিহতদের শরীরের কিছু কিছু অংশ বা তাদের অস্ত্রশস্ত্র প্রমাণ হিসাবে নিয়ে যেতে শুরু করে। তবে কালক্রমে তাদের বীরত্বের সবচেয়ে খাঁটি প্রমাণ হিসাবে হতভাগ্য শত্রুর মাথাই জায়গা করে নেয়। তবে শুধু এদের মধ্যেই না‚ সারা পৃথিবীতেই বিশেষত আব্রাহামিকদের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত ছিলো। এই কিছু বছর আগেও‚ ১৯৯৯ এর কার্গিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের মুসলিম সৈন্যরা আমাদের অনেক সৈন্যের মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছিল কাফের হত্যার স্মারক হিসাবে।
ব্রিটিশরা আসার পর স্থানীয়রা লুসাইদের পরিবর্তে ব্রিটিশদের কর দিতে শুরু করে। ফলে লুসাইদের ভাণ্ডারে টান পড়ে আর তারা
ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষের পথ নেয়। ব্রিটিশরা এদের নাম দিয়েছিল মস্তক শিকারী। তবে এদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্রিটিশরা প্রথমে হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই সবকিছু বদলে যায়।
ব্রিটিশরা দক্ষিণ আসামের কাছাড় পাহাড় দখল করে। বর্তমানে শিলচর শহরের সংলগ্ন এলাকা) ব্রিটিশরা এই এলাকায় চা বাগান স্থাপন করে, আর তা অত্যন্ত লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়। ফলে খুব শিগগিরই চা চাষ নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয় আর বিনিয়োগকারীরা সেই অঞ্চলে ক্রমাগত নতুন চা বাগান তৈরী করতে বা আগের চা বাগানের আয়তন বৃদ্ধি করতে শুরু করে। আর এইভাবেই লুসাইদের এলাকা দখল করা শুরু হয়। এমনই একটা চা বাগান ছিলো শিলচরের কাছে আলেকজান্দ্রাপুরে‚ যার মালিক ছিলেন জর্জ সেলার নামে এক ব্যক্তি। ১৮৭০ সালে সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেমস উইনচেস্টার এবং তার ৬ বছর বয়সী মেয়ে মেরি উইনচেস্টারকে আমন্ত্রণ জানায়। জেমস তখন আরও পড়াশোনার জন্য ব্রিটেনে যাচ্ছিল। মেরি ছিল জেমস এবং তার মেইতি (মণিপুরি) কর্মীর অবৈধ সন্তান। মেয়েটির মা সন্তানের জন্মের পরপরই মারা গিয়েছিল।
ব্রিটিশদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ লুসাইরা তখন প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছিলো। সুযোগ পেয়ে তারা ভোর হওয়ার আগেই চা বাগানে আক্রমণ করে। সংঘর্ষের সময়, জেমস সহ কয়েকজন নিহত হলেও সেলার শেষপর্যন্ত পালিয়ে যায়। মেরিকে অপহরণ করে লুসাইদের রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনা লন্ডনের মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করে দেয়। মেরিকে অবশ্য আদিবাসী নারীরা নিজেদের একজন বলেই মেনে নিয়েছিল আর তেমনই ব্যবহার করত। বন্দিত্বের এক বছরের মধ্যেই সে মিজো লাইফস্টাইলে সম্পূর্ণ অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং ইংরেজি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায়।
এরপর এক বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ১৮৭১ সালের ৮ই অক্টোবর মাসে ব্রিটিশরা লুসাই গ্রামে আক্রমণ করে এবং প্রতিরোধ করতে আসা সবাইকে হত্যা করে। মেরিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যরা তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাকে স্কটল্যান্ডে তার ঠাকুরদা ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তবে অসহায় লুসাই বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য উপজাতিদের জন্য গল্পটা এখানেই শেষ হয় না। মিশনারিরা সুযোগ পেলেই তাদের অপহরণকারী আর মস্তক শিকারী ও বর্বর বলে অপমান করত। অথচ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে এই ব্রিটিশরাই অনেক বেশি পরিমাণে উপজাতিকে হত্যা করেছিল। ইনকুইজিশনের নামেও তারা একই বর্বরতা দেখিয়েছিল। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশরা নরক নামিয়ে আনে। ১৯৯৮ সালের মধ্যে, ব্রিটিশরা পুরো লুসাই অঞ্চল দখল করে নেয় এবং মিশনারিরা পুরোদমে কাজ শুরু করে। আর্থিংটন মিশন এবং ওয়েলশ প্রেসবিটেরিয়ান মিশনারিরা ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে সবথেকে বেশী এগিয়ে ছিল। এক দশকের মধ্যে তারা ১ লাখেরও বেশি আদিবাসীকে ধর্মান্তরিত করেছিল।
লুসাইদের বশে রাখার জন্য গল্প ছড়ানো হয় যে উপজাতিরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে একবার সম্মোহিত হয়ে পড়ে এবং তারা দুটি উজ্জ্বল আলো দেখতে পায়। একটি উত্তরে এবং অন্যটি দক্ষিণে মাটির উপর জ্বলত।
চা বাগানে জেমসের একটি সমাধিফলক তৈরি করা হয় এবং লুসাইদের প্রতিবছর একটি বার্ষিক যাত্রার মাধ্যমে আলেকজান্ডারপুরে নিয়ে যাওয়া হত যাতে তাদের বর্বর অতীতের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায় এবং তাদের মনে করিয়ে দেওয়া
যায় যে কিভাবে তারা এখন সভ্য মানুষ আর
ঈশ্বরের সন্তান হয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষের নিয়ে লজ্জা দিয়ে ধর্মান্তরণের শিকড় আরও দৃঢ় করতে চেয়েছিল তারা। বলা হত যে তারা এখন মস্তক শিকারীরা থেকে আত্মা শিকারী আর গীর্জার প্রতিষ্ঠাতাতে পরিণত হয়েছে।
এটাই হল মিশনারিদের আদর্শ সিস্টেম আর সারা সারা পৃথিবীতে তারা এইভাবেই মানুষের ধর্মান্তরিত করার কাজ চালায়। তাদের এই ক্রমাগত চিটিংবাজি আর ধর্মান্তকরণের ফলে
মিজোরাম এখন ৮৭% খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতা যুক্ত রাজ্য। মেরীকে খ্রিস্টান মশীহা হিসাবে প্রচার করা হয়। যীশুর সাথে তার ছবি এখন সব মিজো খ্রিস্টান পরিবারেই আছে। ওদের বোঝানো হয় যে এই ঘটনা
ইশাইয়া 60:22 এর মতো খ্রিস্টান গ্রন্থে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যা বলেছিল, “ছোটো একজন এক হাজার এবং একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হবে।”
বলাই বাহুল্য মেরিকেই এখানে ছোটো একজন বলে সাজানো হয়েছে।
অমিত আগরওয়াল
ভাষান্তরে সৌভিক দত্ত
https://bharatvoice.in/history/conversion-of-mizoram-to-christianity.html