পশ্চিমবঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পরীক্ষা কী অনলাইন না অফলাইনে নেওয়া হবে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছে৷
অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন৷ আর কলেজ অধ্যক্ষদের একটা বড় অংশ অবশ্য অফলাইনেই পরীক্ষা নিতে চান৷
কোভিড অতিমারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত পদ্ধতিকে বদলে দিয়েছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন ও পরীক্ষার চিরাচরিত ধারণা বদলে গিয়েছে এই সময়ে৷
গত দু’বছরের অধিকাংশ সময়ই স্কুল থেকে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় তালাবন্ধ ছিল৷ মাসের পর মাস বেঞ্চে ধুলো পড়েছে, ব্ল্যাকবোর্ড রয়ে গিয়েছে ফাঁকা৷ মোবাইল বা কম্পিউটার নির্ভর অনলাইন পঠনপাঠন শুরু হয়েছে জোরকদমে৷ কোভিডের কামড় কিছুটা কমার পর ধীরে ধীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা খুললেও এখনো পুরোনো ছন্দ ফিরে আসেনি৷ ক্লাশ অনলাইনেই অব্যাহত থাকবে কি না এ নিয়ে যেমন বিতর্ক ছিল তেমনি পরীক্ষা কীভাবে হবে তা নিয়ে বিতণ্ডা চলছে বেশ কিছু দিন ধরে৷
রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে পরীক্ষার সময় এগিয়ে আসছে৷ পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে নামজাদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পড়ুয়ারা পথে নেমেছেন অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের সামনে শুক্রবার বিক্ষোভ দেখান শত শত ছাত্রছাত্রী৷
তাঁদের দাবি, পরীক্ষা নিতে হবে অনলাইনে৷ ব্যস্ত বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তাঁরা৷ বিক্ষোভে সামিল ইতিহাস বিভাগের অনার্সের ছাত্রী শ্যামলী বিশ্বাস বলেন, ‘‘হঠাৎ করে আমাদের অফলাইনে পরীক্ষা দিতে বলা হচ্ছে৷ অথচ আমরা কলেজে গিয়ে ক্লাস কমই করেছি৷ এই পরিস্থিতিতে হলে বসে পরীক্ষা দিতে বললে কী করে হবে?’’
পরীক্ষা কীভাবে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট শুক্রবার বৈঠকে বসে৷ প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫৫টি কলেজ রয়েছে৷ কলেজের অধ্যক্ষদের মত জানতে সিন্ডিকেট বৈঠকে তাঁদের ডাকা হয়৷ সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের বাইরে বিক্ষোভ করতে থাকেন পরীক্ষার্থীরা৷
সূত্রের খবর, অধ্যক্ষদের অধিকাংশই অফলাইন অর্থাৎ হলে বসে পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন৷
আর পড়ুয়ারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিলেন৷ উপাচার্য তাঁদের কাছ থেকে লিখিত আকারে দাবিপত্র চেয়েছেন৷
ইতিমধ্যেই যাদবপুর ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে যে, তারা পরীক্ষা নেবে অফলাইনে৷
বিক্ষোভ উপেক্ষা করে যাদবপুরে হলে বসে পরীক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে৷ আর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য অনলাইনে পরীক্ষা নিতে চায়৷
সূত্রের খবর, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর চাইছে পুরোনো পদ্ধতিতে কেন্দ্রে এসেই পরীক্ষা দিক ছাত্রছাত্রীরা৷ এ ব্যাপারে রাজ্যের মত জানতে কয়েকজন উপাচার্য দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন৷ বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ ব্যাপারে তাদের উপরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিয়েছে রাজ্য৷
তবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মত, অফলাইনেই পরীক্ষা হওয়া উচিত৷ এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি রয়েছে বলে সূত্রের খবর৷ উচ্চশিক্ষা দপ্তর মনে করছে, আগের থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে৷ তাই কেন্দ্রে এসে পরীক্ষা দেওয়াই বাঞ্ছনীয়৷
শিক্ষাবিদদের অধিকাংশই অবশ্য অনলাইন পরীক্ষাকে খারিজ করে দিচ্ছেন৷ তাঁদের মতে, এটা আপৎকালীন ব্যবস্থা ছিল৷ এখন পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া ভাল৷
প্রাক্তন উপাচার্য শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনলাইনে পরীক্ষা কাম্য নয়৷ এটা টোকাটুকির ছাড়পত্র চাওয়া৷ প্রকাশ্যে টোকাটুকি করা সম্ভব নয় বলে আড়ালে, অনলাইনে সেটা করার চেষ্টা৷ এভাবে সঠিক মূল্যায়ন কখনোই সম্ভব নয়৷’’
শিক্ষামহলের একাংশের মতে, অনলাইন পরীক্ষায় স্বচ্ছতা থাকা সম্ভব নয়৷ অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, কোচিং সেন্টারের নোটস হুবহু উত্তরপত্রে তুলে ধরা হচ্ছে৷ একই ক্লাসের অনেক পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র বহুলাংশে এক৷
এই পরিস্থিতিতে মূল্যায়ন কীভাবে সম্ভব? যদিও আরেক অংশের বক্তব্য, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষায় যে প্রশ্ন আসে, তার উত্তর যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া দেওয়া সম্ভব নয়৷ বই নিয়ে পরীক্ষা দিতে বসলেও উত্তর লেখা যাবে না৷ তাই অনলাইনে হলেই টোকাটুকি করে কেউ দারুণ ফল করবে, এই ভাবনা বাস্তবসম্মত নয়৷
হলে বসে পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন অনীহা ছাত্রছাত্রীদের? পদার্থবিদ্যার অনার্স স্তরের পড়ুয়া শমীক ঘোষাল বলেন, ‘‘আমাদের ক্লাস ঠিকঠাক হয়নি৷ আজ হঠাৎ পরীক্ষায় বসিয়ে দিলে কীভাবে হবে৷ আমরা অফলাইন পরীক্ষায় রাজি৷ তবে তার আগে মাস দু-তিনেক ক্লাস হোক৷ তারপর পরীক্ষা নেওয়া হোক৷’’
শিক্ষার্থীদের এ দাবি প্রসঙ্গে পবিত্র সরকারের বক্তব্য, ‘‘এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখুক যে, ছাত্রছাত্রীরা কতটা পড়াশোনা করতে পেরেছে৷ কতটা সিলেবাসের উপর তাঁরা পরীক্ষা দিতে পারবে৷ শিক্ষকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কথা বলুন৷ কিন্তু পরীক্ষা হোক হলে বসেই, অনলাইনে নয়৷’’