কবির বাড়িতে গেলেন মঈনুদ্দীন। শুনলেন, ওপরের কামরায় বুলবুলকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার ভীষণ জ্বর। মঈনুদ্দীন লিখেছেন, ‘মনের ভিতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কেন, জ্বর তো অনেকেরই হয়। এ জন্য আমার মন এমন করছে কেন?’ একটু পর নজরুলের শাশুড়ি এসে আগের দিনের ঘটনা জানতে চাইলেন। শুনে অমঙ্গল আশঙ্কায় বারবার মাথা নাড়তে লাগলেন।
এ ঘটনার দু-এক দিন পর জানা গেল, বুলবুলের বসন্ত হয়েছে। বসন্তের গুটি সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি চোখেও গুটি দেখা দিয়েছে। বুলবুলের শারীরিক অবস্থায় নজরুল মুষড়ে পড়লেন। তাঁর সাধ্যমতো চিকিৎসার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু দিন দিন বুলবুল নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগল। রোগযন্ত্রণায় ককাত শুধু। ওই সময়েও সে পিতাকে একটুও কাছছাড়া হতে দেয়নি। নজরুল তার শিয়রের কাছে বসে অনুবাদ করতে লাগলেন হাফিজের কবিতা। লিখলেন—
কী লাভ, যখন দুষ্ট ভাগ্য
হাসল নাকো মুখ ফিরিয়ে,
পেল না দিল্ সুখের সোয়াদ,
দিন কাটাল ব্যথাই নিয়ে!
যে ছিল মোর চোখের জ্যোতি,
পুত্লা আঁখির, গেছে চলে!
নয়ন-মণিই গেল যদি,
কী হবে এ নয়ন দিয়ে॥
বসন্তের গুটি বের হওয়ার এক হপ্তা পরের ঘটনা। তখন বিকেল চারটা। মঈনুদ্দীনকে দেখে ওপর থেকে ছুটে এলেন নজরুল। বললেন, ‘দেখ্, দমদমে নাকি একজন সাধু থাকেন। তিনি সর্বরোগের ধন্বন্তরী। একবার তাকে ডেকে আনতে পারিস?’
দোতলার কামরায় মঈন তখন একাই বসেছিলেন। ছোঁয়াচ লাগার আশঙ্কায় বাইরের কাউকে রোগীর কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। মঈনুদ্দীন বললেন, ‘কেন পারব না? এখনই যেতে হবে? না, কাল সকালে গেলে চলবে?’
কিন্তু কাল সকালে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না বুলবুলের। নজরুল আকুল হয়ে বললেন, ‘না, না, তোকে আজই, এখনই যেতে হবে।’
দমদম ওখান থেকে কাছের পথ নয়। ফিরতে রাত হয়ে যাবে। মঈন তাই বললেন, ‘যাচ্ছি। কিন্তু আর কাউকে কি পাওয়া যাবে না? অচেনা-অজানা জায়গা, একজন সঙ্গী হলে ভালো হতো।’
কবি এ কথার কোনো জবাব দিলেন না। আর দাঁড়ালেন না তিনি। দাঁড়ানোর মতো মনের অবস্থাও ছিল না তাঁর। তিনি ওপরে চলে গেলেন।
মঈনুদ্দীন একজন সঙ্গী নিয়ে তখনই রওনা হয়ে গেলেন সাধুজির উদ্দেশ্যে। কিন্তু কপাল খারাপ, তার দেখা পাওয়া গেল না। বিফল মঈনুদ্দীন অনেক রাতে ফিরলেন কলকাতায়। কবির বাড়িতে ঢুকতেই নজরুল ওপর থেকে ছুটে নেমে এলেন নিচে। মঈনকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আচ্ছা, বলতে পারিস, সাধু মরা দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না? বল্–বল্, তিনি কি মরা দেহে প্রাণ দিতে পারেন?’
ঘরে গিজগিজ করছে লোক। মঈনের আর বুঝতে বাকি রইল না, বুলবুল উড়ে গেছে। ছেলে ‘ভোঁ-গাড়ি’ চড়তে চাইত। নজরুল তাই বুলবুলকে গোরস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন মোটরগাড়িতে করে।
‘তোমার মৃত্যু শিয়রে বসে “বুলবুল ই সিরাজ” হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি – উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ সে কি বুলবুলিস্তান, ইরানের চেয়েও সুন্দর? জানি না তুমি কোথায়? যে লোকেই থাক, তোমার শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষদান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ ক’রো।”
কনিষ্ঠ পুত্র অরিন্দম খালেদ অর্থাৎ বুলবুল মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর তিনি শোকে অধীর হয়ে কালীর উপাসনার মাধ্যমে শান্তি খুঁজেছিলেন।
নজরুল ইসলাম যখন পুত্রশোকে কাতর — সেইসময় তিনি বরদাচরণের কাছে যান পুত্রকে আর একবার দেখার মানসিকতা নিয়ে। যোগীবর বরদাচরণের হৃদয়ের একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, যোগীবরের প্রাণপ্রতীম “কাজী ভায়া।”
নজরুলের সঙ্গে বরদাচরণের প্রথম সাক্ষাৎটি হয় মুর্শিদাবাদের নিমতিতা গ্রামের এক বিয়ের আসরে।প্রখ্যাত নজরুল গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্তের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, গৃহতান্ত্রিক বরদাচরণ আগমবাগীশের সঙ্গে বিদ্রোহী কবির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯২৪ সালে বহরমপুরে , যখন নজরুল ডা . নলীনাক্ষ সান্যালের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেখানে যান । ডা . সান্যালের বিয়ের ঠিক সাতদিন পরে নজরুলের নিজেরও বিয়ে হয় । যাই হোক, সেখানে নজরুল ছিলেন বরযাত্রী, আর বরদাচরণ ছিলেন কন্যাপক্ষের অতিথি। সেদিনের সেই প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি সম্পর্কে নজরুল লিখছেন,
“নিমতিতা গ্রামের এক বিবাহ সভায় সকলেই বর দেখিতেছে, আর আমার ক্ষুধাতুর আঁখি দেখিতেছে আমার প্রলয়সুন্দর সারথিকে। সেই বিবাহ-সভায় আমার বধূরূপিনী আত্মা তাহার চিরজীবনের সাথীকে বরণ করিল। অন্ত:পুরে মুহুর্মুহু: শঙ্খ-ধ্বনি, হুলু-ধ্বনি হইতেছে, স্রক-চন্দনের শুচি সুরভি ভাসিয়া আসিতেছে, নহবতে সানাই বাজিতেছে—এমনি শুভক্ষণে—আনন্দ বাসরে আমার সেই ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম।”
যোগীবর বরদাচরণের সান্নিধ্যে নজরুল পেয়েছিলেন শাশ্বত শান্তিপথের দিশা। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখছেন,
“তাঁহারই চরণতলে বসিয়া যিনি আমার চিরকালের ধ্যেয় তাঁহার জ্যোতি-রূপ দেখিলাম। তিনি আমার হাতে দিলেন যে অনির্বাণ দীপ-শিখা , হাতে লইয়া আজ বার বৎসর ধরিয়া পথ চলিতেছি—আর অগ্রে চলিতেছেন তিনি পার্থসারথিরূপে। আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই , তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি।”
নজরুল লিখছেন, “তিনি (বরদাচরণ মজুমদার) এই গ্রন্থ-গীতার উদগাতা”। অর্থাৎ এই যে ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত এবং অন্যান্য গানের সংকলন, তাকে তিনি বলছেন ‘গীতা’। পথহারার পথ ও দ্বাদশ বাণী’ নামে বরদাচরণ মজুমদারের একটি বই।বইয়ের মূল বিষয় যোগসাধনা। বরদাচরণ ছিলেন যোগসাধক। নজরুল তাঁর এই গুরু সম্পর্কে ‘ভক্তিগীতি মাধুরী’র ভূমিকায় লিখেছেন, “সহসা একদিন তাঁহাকে দেখিলাম।…শুভক্ষণে আনন্দবাসরে আমার সে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম।…আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই, তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি। আমার ব্রহ্ম-ক্ষুধা আজও মেটে নাই কিন্তু সে ক্ষুধা এই জীবনেই মিটিবে, সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি।” এই লেখাটি নজরুল প্রথম লিখেছিলেন ‘পথহারার পথ ও দ্বাদশ বাণী’-র প্রথম সংস্করণের ভূমিকা হিসেবে। পরে তা ব্যবহার করা হয় ‘ভক্তিগীতি মাধুর’ সংকলনে। ‘
বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন নিমতিতা গ্রামেরই ছয় মাইল দূরবর্তী কাঞ্চনতলা গ্রামের অধিবাসী। সে সময় তিনি লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। গৃহীযোগী। তার যোগ শক্তির কথা তখন জনা কয়েক অন্তরঙ্গ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার কাছে যে সব অধ্যাত্মসাধন পিপাসু ব্যক্তিরা যেতেন সবার সামনেই তিনি তাদের নির্দেশ দিতেন। বরদাচরণ মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে ভবানীপুরের মোহিনী মোহন রোডে থাকতেন। সে সময় নজরুল ও আরও অনেকে বরদাচরণের কাছে যেতেন। তেমনি বরদাচরণও গিয়েছেন কবি নজরুলের ভাড়া বাড়িতে। দুজনের মধ্যে আত্মিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে নজরুল লেখেন :
‘সারাজীবন ধরিয়া বহু সাধু সন্ন্যাসী, যোগী, ফকির, দরবেশ খুঁজিয়া বেড়াইয়া যাহাকে দেখিয়া আমার অন্তর জুড়াইয়া গেল, আলোক পাইলো, তিনি আমাদেরই মত গৃহী। এই গৃহে বসিয়াই তিনি মহাযোগী শিবস্বরূপ হইয়াছেন। এই গৃহের বাতায়ন দিয়াই আসিয়াছে তাহার মাঝে বৃক্ষ জ্যোতি।… আমার যোগসাধনার গুরু যিনি তাঁহার সম্বন্ধে বলিবার ধৃষ্টতা আমার নাই। সে সময়ও আজ আসে নাই। আমার যাহা কিছু শক্তির প্রকাশের আধার মাত্র তাহাকে জানাইবার আজ আদেশ হইয়াছে বলিয়াই জানাইলাম।’
শ্রীশ্রী যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন একজন উচ্চ স্তরের ক্রিয়া যোগী। কথিত আছে জাগতিক কোনো মানুষের কাছে তিনি কখনও দীক্ষা গ্রহণ করেননি। তাঁর গুরু ছিলেন স্বয়ং দেবাদিদেব শঙ্কর।
উল্লেখ্য যে, একবার যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে দেখা করতে চাইলে নেতাজী সব কাজ ফেলে রেখে ১৯৩৯ সালের ১২ই জুন সকালবেলা যোগীরাজের সঙ্গে কলকাতায় মোহিনীমোহন রোডের একটি বাড়িতে দেখা করেন। দীর্ঘ প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। আলোচনার বিষয় বস্তু জিজ্ঞাসায় যেগীবর বলেন,”সব কথা বলা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, সুভাষ বাবু প্রথমে আশ্চর্য হয়ে যান- জিজ্ঞাসা করেন কেমন করিয়া এই সব জানলেন? তাঁর অতীত জীবনটাই সুভাষ বাবুর নিকট তুলে ধরেছিলাম। যে কথা তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি জানেন না, তাঁর জীবনের তেমন কয়েকটি ঘটনা বলেছিলাম।”
এমনকি পরের দিনও নেতাজী নিজেই ছুটে আসেন যোগীরাজের কাছে সেই দিনও সোয়া দুই ঘণ্টা তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। দ্বিতীয় দিনের আলোচনার বিষয় বস্তু জিজ্ঞাসায় যোগীরাজ বলেন ” আজ তাঁকে যোগের বিশেষ প্রক্রিয়া বলে দিলাম। ধ্যানে বসিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ ছিলেন। “
ব্যথিত নজরুলকে যোগীবর বললেন, ছেলেকে দেখার খুবই ইচ্ছে ?
বলেই শিষ্যকে দিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিশ্রুতি, বললেন, বেশ, দেখতে তুমি পাবে। কিন্তু দেখো, কোনো কথা তাকে বোলো না।বরদাচরণের একটি কালীঘর ছিল, ঐ ঘরে তিনি নজরুলকে বসিয়ে একটি বীজমন্ত্র জপ করতে বলেন। কবি তাঁর উপাসনা ঘরে বসে একমনে গুরুপ্রদত্ত বীজমন্ত্র জপ করছেন। হঠাৎ তাঁর তন্ময়তা ভেঙে গেল। সারা রাত কেটে যাবার পর ভোর রাত্রে বুলবুল বল হাতে খেলতে খেলতে নজরুলের সামনে প্রকট হল। আবেগতাড়িত হয়ে নজরুল যেই সেই বালককে ধরতে গেছেন — অমনি পাশের ঘর থেকে বরদাচরণ বলে উঠলেন, ‘কাজী, ওটা কায়া নয় ছায়া, রূপ নয় প্রতিরূপ, সত্য নয় মায়া।’ মায়া ছেড়ে মা’কে ধরলেন কাজী। কাজী নজরুলেরও কুলকুণ্ডলিনীর ক্রিয়া শুরু হয়েছিল তারপর থেকেই।
গুরু বরদাচরণের পায়ে এসে লুটিয়ে পড়লেন নজরুল। ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, আপনার কৃপায় ছেলের দেখা আমি পেয়েছি। আমার মন এখন শান্ত।
গুরু বরদাচরণ কলকাতায় এলে নজরুল প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁর কাছে আসতেন। আলাপ-আলোচনা শেষে যোগীবর শুনতে চাইতেন তাঁর প্রিয় গান, “শ্মশানে জাগিছে শ্যামা।”
নজরুলের কয়েকটি গানে তান্ত্রিক ভাবধারার পরিচয় মেলে। যেমন – “শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ–কাঠিতে। / যত জ্বলি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে।।/ ভক্তি আমার ধূমের মতো / ঊর্দ্ধে ওঠে অবিরত, / শিব–লোকের দেব–দেউলে মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।।” তন্ত্র মতে দেহই সব রকম সাধনার আধার। কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিত হয় নিচু থেকে ওপরের দিকে। গানটিতে সেই কথাই রূপকের আকারে প্রকাশিত।
আমার শ্যামা মায়ের কোলে চ’ড়ে জপি আমি শ্যামের নাম
মা হলেন মোর মন্ত্র-গুরু ঠাকুর হলেন রাধা-শ্যাম॥
ডুবে শ্যামা-যমুনাতে মা খেলবো খেলা শ্যামের সাথে
শ্যাম যবে মোরে হানবে হেলা মা ফুরাবেন মনস্কাম॥
আমার মনের দোতারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার,
সেই দোতারায় ঝঙ্কার দেয় ওঙ্কার রব অনিবার।
মহামায়া মায়ার ডোরে আনবে বেঁধে শ্যাম-কিশোএ2রে
আমি কৈলাসে তাই মাকে ডাকি দেখবো সেথা ব্রজধাম।।
ক্রমে বার্ধক্য জনিত কারণে যোগীবর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে এলেন কলকাতায়। বেশ কিছুদিন এসময়ে নজরুল গুরু সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। এরপর যোগীরাজ লালগোলা ফিরে যান। কিন্তু সেই বছরই গুরুদেব পুনশ্চ অসুস্থ হয়ে কলকাতা আসেন। এবার যেন ডাক এসেছে , গুরু ঘোলা চোখে তাকিয়ে শিষ্যদের বললেন , ” ওরে তোরা যদি আর বাইশ দিন আমাকে ধরে রাখতে পারিস তবে আমি তোদের মাঝে থেকে যাব। তবে আমার যে ডাক এসেছে….”। যোগীমহারাজের এহেন খবর শুনে নজরুল ছুটে এলেন তাঁর কাছে। সেটা ছিল বিশতম দিন। সারারাত নজরুল মহারাজের কাছে বসে ধ্যান করলেন। একুশতম দিনে গুরু নজরুলকে বললেন , ” আজ শেষবারের জন্য শ্মশানে জাগিছে শ্মশানে জাগিছে শ্যামা গা দেখি….। ” সেদিন প্রবল কষ্টে , চরম স্নায়ুবিক যন্ত্রনা নিয়ে কবি গেয়েছিলেন সেই গান। পরের দিন পয়লা অগ্রহায়ণ নজরুলের গুরুদশা শুরু হল। তিনি সকল নিয়ম মেনে গুরুদশা পালন করেছিলেন।
স্ত্রীর শারীরিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিনি কোথায় না গেছেন? বিভিন্ন মন্দির থেকে দৈব্ ওষুধ নিয়ে আসতেন। সেই কারণে একবার তিনি বিশিষ্ট কথা-সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তারাশঙ্করও ছিলেন তন্ত্রসাধক) কাছে গিয়েও ওষুধ নিয়ে আসেন। তারাশঙ্করের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় ফুল্লরায়। তাঁরা বীরভূমের ফুল্লরা মহাপীঠে গিয়েও জপ, ধ্যান ও তন্ত্র সাধনা করতেন। তারাশঙ্করের জন্মভিটে লাভপুরের কাছেই ফুল্লরা। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি , এনারা কুম্ভক যোগ করতে জানতেন। খুব উচ্চমার্গের সাধক না হলে এ যোগ কেউ করতে পারেন না।
যখন কবি কলকাতার শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন , তখন প্রায়শই শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর ঠাকুরঘরের কোণে বসে দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন । কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পরে দাহকার্য সেরে এসে একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানতে পারেন যে সেদিনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে নজরুল এবং দাদাঠাকুরের সাগরেদ নলিনীকান্ত সরকার আসছেন তাঁর বাড়িতে । সেইদিন রাত নটার পরে দু’জনেই এসে পৌঁছন লাভপুরে । পরের দিন দেবী ফুল্লরার পীঠে নাটমন্দিরে বসে নজরুল প্রাণায়াম শুরু করেন এবং তাঁর সারা শরীর ঘেমে ওঠে । চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল । সেই অবস্থায় বসে চেতনা সম্পূর্ণ ফিরে আসার আগেই তিনি গান লিখে তাতে সুর দেন । এরপর শুরু করেন সংগীত পরিবেশন । মধ্যরাত্রে গেয়ে ওঠেন তাঁরই রচিত শ্যামাসংগীত । সদ্য পুত্রশোকে জর্জরিত তারাশঙ্করের মনে প্রশান্তি ফিরে আসে সেই মাতৃ আরাধনা শুনে । এসব ঘটনার কথা পরবর্তীকালে তারাশঙ্কর অনেককে বলেছিলেন।
নজরুল শুধুমাত্র নিজের মনের শান্তি লাভ করার জন্যই এই পথের নিকটে যাননি৷ তাঁর এই আধ্যাত্মিকতা দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ সম্ভবত পুত্রের মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া। তিনি হাসির গান লিখতে গিয়ে একা একা বসে কাঁদতেন এও তার বন্ধুরা দেখেছিল৷ সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে নজরুলের শ্যামা সংগীত লেখার পিছনে কারণ কী ছিল ৷
কালীভক্ত এবং সাধক হওয়ার জন্য নজরুল বামাক্ষ্যাপার কাছেও গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি বক্রেশ্বরে বহু অঘোরী সাধুর সঙ্গ করতেন। তারাপীঠে তিনি তারাখ্যাপা নামে পরিচিত ছিলেন। অবশ্য বামদেবের প্রিয় শিষ্য এবং যোগ্য উত্তরসূরীর নামও ছিল তারাক্ষ্যাপা।তারাপীঠ শ্মশানে বসে ধ্যানমগ্ন থাকতেন মাতৃসাধক নজরুল। কখনো বা কুম্ভক যোগে তারা মায়ের উপাসনা করতেন।
তবে শ্যামা মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও নির্ভরশীলতা না থাকলে কিন্তু শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনার প্রভাবে এমন আত্মনিবেদনের গান লেখা সহজ নয়। শ্যামাসংগীতের যে দর্শন, তা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধী করেছিলেন। শুধু গান লিখেই থেমে থাকেননি। সেই সব গানে সুরারোপও করেছেন। ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গানটিতে কাজী সাহেব মালকোষ রাগাশ্রীত সুর করেছিলেন। কী অদ্ভুত দর্শন গানের প্রতিটি ছত্রে। ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়, তাহারে ডাকিছে মা কোলে আয়, কোলে আয়, জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে, কোলে তুলে নেয় মা মরণেরও ছলে।’
নজরুল একসময় থাকতেন উত্তর কলকাতার হরি ঘোষ স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়িতে। সেই বাড়ির এক তলায় তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ভাস্কর গোষ্ঠ পালকে দিয়ে একটি সুন্দর কালীমূর্তি তৈরি করান। প্রায় সারা রাত ধরে রাশি রাশি জবা ফুল দিয়ে তিনি এই মা কালীর পুজো করতেন। কখনও বা ১০৮ রুদ্রাক্ষ মালা জপতে জপতে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন তিনি।
একবার চট্টগ্রামের স্বনামধন্য সাধু তারাচরণ গিয়েছেন কলকাতায়। তার শিষ্য মতিলাল রায় একদিন নজরুলের কাছে গিয়ে গুরুর আহ্বান নিবেদন করেন। সময় সুযোগ বুঝে কবি তাকে একটি দিন দেন। সে অনুযায়ী মাতিলাল এসে কবিকে নিয়ে গেলেন বালিগঞ্জের একটি বাড়িতে। নজরুলকে দেখা মাত্র তারাচরণ দাঁড়িয়ে নজরুলকে অভ্যর্থনা জানান। দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন সাধু নজরুলের ভেতরে কিসের আলো দেখেছিলেন তা তিনিই জানেন।
১৯৩৮-৩৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানিতে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে কবির স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে তখন তিনি শুরু করেন আধ্যাত্মিক যোগ সাধনা, তন্ত্র-মন্ত্রের অলৌকিক জগতে বিচরণ। একদিন কলকাতার বরাহ নগরের যোগেন্দ্র বসাক রোড থেকে একজন ভদ্রলোক গিয়ে নজরুলকে অনুরোধ করলেন তার গুরুর কাছে যাবার জন্যে। গুরুর নাম নিরালম্ব স্বামী। নজরুল তার সাথে দেখা করতে যান। প্রণাম করেন। স্বামীজী পরম স্নেহভবে নজরুলকে গ্রহণ করলেন। তার অনুরোধে কবি অনেকগুলো গান পরিবেশন করেন। স্বামীজীর আশীর্বাদ ও গৃহস্থের আপ্যায়নে পরিতৃপ্ত হয়ে কবি সেদিন ঘরে ফেরেন।
অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কাজী নজরুল ইসলাম জানতেন, নদী, গাছ আর প্রকৃত সাধুর স্বভাব একই রকম। সাধুর বচনে আর দেখানো সত্যে অনেকেই উপকৃত হন। কলকাতার ঝামা পুকুরে এক শিষ্যবাড়িতে অবস্থান করছিলেন সাধু নৃপেন্দ্রনাথ। তিনি স্মরণ করলেন নজরুলকে। একজন ভক্ত এসে কবিকে নিয়ে গেলেন তার কাছে। নজরুল গিয়ে দেখলেন প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন ঘর। মেঝের উপর বসে আছে ভক্তের দল। ঘরের এক কোণায় একটি কার্পেটের আসনে বসে আছেন নৃপেন্দ্রনাথ। পরম সমাদরে তিনি নজরুলকে স্বাগত জানান। ভক্তকে আদেশ করলেন নজরুলের জন্যে একখানি স্বতন্ত্র আসন দেয়ার। নৃপেন্দ্রনাথের স্নেহে, সমাদরে ও সদালাপে তৃপ্ত হয়ে নজরুল বিদায় নেন।
আরও কয়েকজন সাধুসন্তের সঙ্গলাভ করেছেন নজরুল। সাধুমনস্ক নজরুল নিজেই বলেছেন : ‘যিনি আমায় চালাইতেছিলেন সেই অদৃশ্য সারথি আমায় চলিতে দিলেন না। লেখার মাঝে, বলার মাঝে সহসা প্রকাশিত হইয়া পড়িত সেই অদৃশ্য সারথির কথা। নিজেই বিস্মিত হইয়া ভাবিতাম। মনে হইত তাঁহাকে আমিও দেখি নাই ; কিন্তু দেখিলে চিনিতে পারিব। এই কথা বহুবার লিখিয়াছি ও বহু সভায় বলিয়াছি।’
তাঁর সৃষ্টিতে তিনি দেবী কালীকাকে তিনরকমভাবে দেখেছিলেন। কন্যারূপে, মাতৃরূপে এবং অশুভনাশিনীরূপে। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ গানটিতে শ্যামার কন্যারূপকেই প্রত্যয় করা যাবে। এই গানেরও একটি লাইনের উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে। ‘পাগলী মেয়ে এলোকেশী নীশিথিনির দুলিয়ে কেশ, নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার যে তার নাইকো শেষ। / সিন্ধুতে মার বিন্দুখানিক ঠিখরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরেনা, মা আমার তাই দিগবসন’। এই গানে কাজী সাহেব শ্যামা মায়ের কন্যা এবং মাতৃরূপকেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর চেতনায় মাকে শুধুমাত্র দর্শন আর তত্ত্বের মধ্যে আটকে না রেখে করে তুলেছেন ঘরের মেয়ে। পারবারিক প্রতিবন্ধকতা আর অপার কালীভক্তি যে বিদ্রোহীকবিকে কখন কালীসাধকে পরিণত করেছিল তা বোধহয় তিনি নিজেও জানতে পারেননি। তিনি যে একাধিক বৈষ্ণবকীর্তণ, গজল, শ্যামাসংগীত যে রচনা করেছিলেন তা নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়। সেই সব শ্যামাসংগীত যে অত্যন্ত উঁচু দরের এবং উৎকৃষ্ট সে বিষয়ও কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
বল রে জবা বল
বল, কোন সাধনায় পেলি
শ্যামা মায়ের চরণতল ?
জবা কোন সাধনায় পেলি
শ্যামা মায়ের চরণতল ?
বল রে জবা বল।
মায়া তরুর বাঁধন টুটে,
মায়ের পায়ে পড়লি লুটে
মুক্তি পেলি, উঠলি ফুটে
আনন্দ বিহ্বল
তোর সাধনা আমায় শেখা
জবা তোর সাধনা আমায় শেখা
জীবন হোক সফল।
বল রে জবা বল।
কোটি গন্ধে কুসুম ফুটে
বনে মনোলোভা
কেমনে মার চরণ পেলি
তুই তামসিক জবা !
তোর মত মার পায়ে রাতুল
হ’ব কবে প্রসাদী ফুল ?
তোর মত মার পায়ে রাতুল
জবা, তোর মত মার পায়ে রাতুল
হ’ব কবে প্রসাদী ফুল ?
কবে উঠবে রেঙে
ওরে মায়ের পায়ে ছোঁয়া লেগে
উঠবে রেঙে
কবে মায়ের পায়ে ছোঁয়া লেগে
উঠবে রেঙে
কবে তোরই মত রাঙবে রে মোর
মলিন চিত্তদল।
সুনিবিড় ঈশ্বর ভাবনায় তিনি মিশে থাকতেন। তিনি প্রায় ৪০০০ গান রচনা করেছিলেন এবং অধিকাংশের সুর নিজেই করেছিলেন৷ যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা ‘নজরুল গীতি’ নামে পরিচিত। যার বড় একটি অংশই শ্যামা সঙ্গীত। সঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘রাঙা-জবা’। ১৯৬৬ সালে ১০০টি শ্যামা সঙ্গীতে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তখন মূল্য ছিল মাত্র তিন টাকা। শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণব মার্গের পাশাপাশি শাক্ত মার্গও বঙ্গের জীবন দর্শনকেন সমৃদ্ধ করছিল এবং শাক্ত পদাবলী , গান চর্চার সুন্দর একটি ধারাও প্রচলিত ছিল। এই সময় বঙ্গদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শ্যামা সঙ্গীতের ধারাটি বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্ত পদাবলি বা শ্যামা সঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামা সঙ্গীতকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।তিনি এই সঙ্গীতকে একটি নির্দিষ্ট স্থান প্রদান করেছিলেন।তাঁর লেখা সঙ্গীতের মধ্যে যে ঈশ্বর ভাবনা ,চেতনা ছিল তাতে আপামর বাঙ্গালী ডুবে থাকত সেই সাধনায়৷
সাহিত্য চর্চার জন্য সামান্য কিছু সময় পেয়েছিলেন নজরুল। কিন্তু জীবনের এই অল্প সময়েই তিনি রেখে যান বাংলার জন্য এক সুর ভাণ্ডার। তাঁর শ্যামাসঙ্গীতের রচনা কৌশল আর ভক্তির গভীরতা বোঝা যায় নির্দ্বিধায়।
স্বাধীনতা সংগ্রামী নজরুলের কাছে শ্যামা মা হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং দেশমাতৃকা। শক্তি আরাধনার প্রভাব তাঁর কবিতাতেও পড়েছে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতায় লিখেছিলেন, “অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, / আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। / দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা/ দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।” এটি লেখার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কারাবন্দি করে।
নজরুলের এই সমন্বয়পন্থী উদ্যোগকে মৌলবাদীরা আঘাত করেছে বারবার। পূর্ববঙ্গের রেডিওতেও এক সময়ে নজরুলের শ্যামাসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ হয়েছিল। এত কিছুর পরেও নজরুলের ভাবাদর্শকে ধ্বংস করা যায়নি।
একবার সুরকার কমল দাশগুপ্ত কবিকে বলেন আজকেই দুটো শ্যামাসংগীত লিখে দিতে হবে । উত্তরে কবি বলেছিলেন কিছু খাবার আনতে , কারণ তাঁর খিদে পেয়েছিল । খাবার এল কিন্তু তখন নজরুল বিচরণ করছেন এক অন্য জগতে । সাদা খাতার ওপরে খস খস করে লিখেই চলেছেন । খাবার ঠান্ডা হয়ে গেল , কিছুরণ পরে কমল দাশগুপ্তকে ডেকে তাঁর হাতে কবি তুলে দিলেন দুটো শ্যামাসংগীত । কবির লেখা কিন্তু যেমন চলছিল , তেমনই চলছে তখনও । এরপর চা এল , সেই কথা তাঁকে বলাতে তিনি কোনওরকমে চা খেয়ে নিয়ে আবার মন দিলেন লেখায় । দিনের শেষে দেখা গেল যে সেদিন কাজী সাহেব মোট বারোখানি শ্যামাসংগীত লিখেছেন । পরবর্তীকালে কমলবাবু তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে দু’খানি গানে সুরারোপ করে সংগীতশিল্পী মৃণালকান্তি ঘোষকে দিয়ে রেকর্ড করান ।
সে সব ভক্তিগীতির মধ্যেও ছিল ধূমকেতুর ন্যায় অন্তরজ্বলা আর চির বিদ্রোহের বাণী। আজও ভারতবর্ষে শ্যামা সঙ্গীত বিষয়ে আলোচনা উঠলে রামপ্রসাদ , কমলাকান্ত প্রমুখের সঙ্গে নজরুলের সৃষ্টি দিয়েও শুরু করতে হয়। শ্যামা সঙ্গীতের নান্দনিক প্রভাব এই দেশে মরমী ও ভক্তিগীতি, এমনকি দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে আজও প্রবহমান।
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ
১. গীতরঙ্গ: শাক্ত সাধনা ও শ্যামা সঙ্গীতে নজরুল : পারমিতা চক্রবর্ত্তী
২.নজরুলের কাছে শ্যামা মা হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং দেশমাতৃকা
৩. প্রখ্যাত নজরুল গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্তের বক্তব্য
৪. কাজী নজরুলের কালী সাধনা : ডক্টর শঙ্কর ঘোষ