Rabindra Sarobar: রোয়িং ক্লাবের দুর্ঘটনায় এক গুচ্ছ প্রশ্ন, উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন

শনিবার বিকালে রবীন্দ্র সরোবরে দুর্ঘটনায় দুই কিশোরের মৃত্যু একাধিক প্রশ্ন তুলে দিল। দুর্ঘটনার দায় কার, তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের নানা মন্তব্য শোনা গিয়েছে ইতিমধ্যেই। তবু স্বপ্ন দেখা দুই কিশোরের এই পরিণতি কি কোনও ভাবেই এড়ানো যেত না?

সব থেকে বড় প্রশ্ন যেটা উঠে এসেছে, তা হল রবীন্দ্র সরোবরে কেন উদ্ধারকারী বোট ছিল না? কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সরাসরি দায়ী করেছেন পরিবেশবিদদের। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের সচিব চন্দন রায় চৌধুরীর অভিযোগের তিরও পরিবেশবিদদের দিকেই। চন্দনবাবু আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘বিশ্বের সর্বত্র, ভারতেও সব জায়গায় রোয়িং বা রেগাটা করার সময় সঙ্গে উদ্ধারকারী বা অনুসরণকারী বোট থাকে। কোনও বিপদ ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি সামলাতে পারে উদ্ধারকারী দল। কিন্তু, রবীন্দ্র সরোবরে আমাদের তা রাখতে দেওয়া হয় না। উদ্ধারকারী বোট থাকলে না কি মাছ এবং পাখিদের অসুবিধা হয়। মাছ মরে যায়। ঠিক করতে হবে, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। হয় আমাদের উদ্ধারকারী বোট রাখতে দেওয়া হোক। না হলে রোয়িং বন্ধ করে দেওয়া হোক।’’

কিন্তু কী ভাবে ঘটল এই দুর্ঘটনা? কেন বাঁচানো গেল না দুই কিশোরকে। চন্দনবাবুর বক্তব্য, ‘‘সে সময় ঠিক কী ঘটেছিল, তা কারোর পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এরকম শক্তিশালী ঝড় হলে বোট উল্টে যেতেই পারে। বোট উল্টোনোটা রোয়িংয়ে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বোট উল্টে গেলেও তা জলে ভাসে। ফাইবার গ্লাস দিয়ে তৈরি হওয়ায় বোট ডুবে যায় না। এমন ক্ষেত্রে রোয়াররা সেই বোট ধরেই নিজেদের বাঁচায়। শনিবার ওই বোটে পাঁচ জন ছিল। সম্ভবত তিন জন বোট ধরতে পারলেও বাকি দু’জন তা পারেনি। দুর্যোগের মধ্যে জলে ডুবে যাওয়াতেই এই ঘটনা ঘটেছে।’’

কিন্তু জলে ডুবে যাওযার তত্ত্বই বা কতটা গ্রহণযোগ্য? কারণ, রোয়িং যাঁরা করেন তাঁরা সাধারণত ভাল সাঁতার জানে। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের সচিব বললেন, ‘‘ওরা কেউই আমাদের ক্লাবের সদস্য নয়। আমাদের ক্লাবে স্কুল পর্যায়ের একটা রেগাটা প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। ওরা তাতে অংশ নেয়। যতদূর জানি, দু’জনেই ভাল সাঁতার জানত। কিন্তু দুর্ঘটনার সেই মুহূর্তে ঠিক কী হয়েছিল বলা সম্ভব নয়। ক্লাবের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এই প্রথম। দেখুন জলের তলায় কাদা, মাটি থাকবেই। হতে পারে ওদের পা বা শরীরের কোনও অংশ কাদায় আটকে গিয়েছিল। জলের নিচে থেকে আর উপরে উঠে আসতে পারেনি।’’

ক্লাব কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত নন মৃত পুষ্পেন সাধুখাঁর পরিজনরা। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রের বাবা পীযূষ সাধুখাঁ উল্টোডাঙা ট্রাফিক গার্ডের অ্যাডিশনাল ওসি। তিনি পুত্র শোকে কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। তাঁদের এক পারিবারিক বন্ধুর প্রশ্ন, ‘‘ছোটরা না বুঝতেই পারে। কিন্তু ওদের অনুশীলনের সময় কোনও প্রশিক্ষক তো নিশ্চয় ছিলেন। আবহাওয়া প্রতিকূল হতে পারে জেনেও তিনি কেন ওদের আটকাননি! আবহাওয়ার পূর্বাভাস তো এখন সকলে আগেই জানতে পারেন। সাধারণ মানুষও জানতে পারেন। সেই মতো সাবধানতা অবলম্বন করেন। ক্লাব কর্তৃপক্ষ কি ঝ়ড়ের পূর্বাভাস জানত না। আকাশ দেখেও কি ওঁরা কিছু বুঝতে পারেননি! তাঁরাই বা কী করছিলেন।’’ ধরা গলায় তিনিও আরও বললেন, ‘‘প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে জেতার পর চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েছিল ওরা। স্কুলকে পদক দিতে চেয়েছিল। সেই চাওয়াই কাল হল।’’

পুষ্পেন সাধুখাঁ এবং সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায় দুই কিশোরই সম্প্রতি লেক ক্লাবের সদস্য হয়েছিল। সেই ক্লাবের যুগ্ম সচিব দেবু দত্তের বক্তব্য, ‘‘যা ঘটেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক। এখন অনেকেই অনেক কথা বলবেন। আমাদের শুনতে হবে। কিন্তু ছেলেরা যখন অনুশীলন করছিল, সে সময় ট্রেনার, অভিভাবক, ওদের স্কুলের লোকজন সকলেই ছিলেন সেখানে। আবহাওয়া অতটা খারাপ হবে কেউই বুঝতে পারেননি। ওরা যখন বোট নিয়ে যায় তখন আকাশ এক দম পরিস্কার ছিল। বুঝতে পারলে কি কেউ পাঠায়? আবহাওয়া অফিস জানিয়েছিল ৫০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হবে। কিন্তু হয়েছে প্রায় ৯০ কিলোমিটার বেগে। আমার ৫২ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। হতে পারে দুর্যোগের সময় ছেলেদের উপস্থিত বুদ্ধি কাজ করেনি। বয়স কম, অভিজ্ঞতাও কম। তিন জন বোট ধরেই দাঁড়িয়ে ছিল যেমন থাকার কথা। ওরা সকলেই ভাল সাঁতার জানত। দু’জন হয়তো ভেবেছিল সাঁতরে উঠে আসবে। কিন্তু সরোবর সাঁতার কাটার জন্য উপযুক্ত নয়, সেটা হয়তো ওদের জানা ছিল না।’’

স্পিড বোট না থাকার জন্য তিনিও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন পরিবেশবিদদের দিকেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দিন কয়েক আগে যখন রাজ্য গেমস হল, তখন রোয়িংয়ের জন্য একটা স্পিড বোট রাখা হয়েছিল সরোবরে। সে জন্য কেএমডিএ ক্লাবগুলোকে শো-কজ করে। নিরাপত্তার জন্য স্পিড বোট সর্বত্রই থাকে, যেখানে যেখানে রোয়িং বা রেগাটা হয়। কিন্তু আমাদের সরোবরে বোট রাখতে দেওয়া হয় না।’’ তাঁরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবার স্পিড বোট রাখার আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘স্পিড বোট ছাড়া নিরাপত্তার সব কিছুই রয়েছে আমাদের কাছে। সেটা থাকলে দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। বলছি না সেটা থাকলেই ওদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু আরও দ্রুত চেষ্টাটা অন্তত শুরু করা যেত।’’

মৃত দুই পড়ুয়ার বাড়িতে শোকের ছায়া। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই পরিজনরা। পুষ্পেন ভাল সাঁতার কাটত। গান গাইত। গিটার বাজাত। আগামী ১৪ জুন তার ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই এই দুর্ঘটনা। এক মাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর তার বাবা-মা। এসএসকেএম-এ ময়নাতদন্তের পর দেহ তুলে দেওয়া হয়েছে পরিবারের হাতে।

দু’টি তরতাজা প্রাণ চলে যাওয়ার পর কি হুঁশ ফিরবে সংশ্লিষ্টদের? প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে? না কি স্রেফ সময়ের নিয়মে সবাই সব ভুলে যাবেন নানা দোহাই দিয়ে? পুষ্পেন, সৌরদীপদের মতো আরও অনেককে জীবন বাজি রেখেই কি রোয়িং করতে হবে? খেলাধুলো নিয়ে অযত্ন, অসচেতনতা, দায়সারা মনোভাবের বলি হবে আরও তরুণ তরতাজা পদকের স্বপ্ন দেখা প্রাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.