১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর আদর্শে বিপিনচন্দ্র পাল (৭ নভেম্বর, ১৮৫৮ — ২০ মে, ১৯৩২) হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে হলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে তিনি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড গেলেন (১৮৮৯)। বাগ্মীতার জন্যই সেখান থেকে অন্য একটি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা। দুর্দান্ত সেই বক্তৃতা, শুনে মোহিত হয়ে যেতেন মানুষ; তখনও স্বামীজি আমেরিকায় পৌঁছান নি। কিন্তু প্রবল ধাক্কা খেলেন আমেরিকার এক শ্রোতার কাছ থেকে; তিনি এক অতি সত্য অথচ তেতো-কথা শোনালেন বিপিনকে, বললেন একজন পরাধীন দেশের মানুষের কাছ থেকে কোনো কথাই তারা শুনবেন না, শুনলেও তা গ্রহণ করবেন না। কথাটি দারুণ বাজলো বিপিনের। শপথ নিলেন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতেই হবে, তারজন্য অগ্রণী ভূমিকা নেবেনই তিনি। ফিরলেন দেশে, সুযোগ পেলেন কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ন্যাশানাল লাইব্রেরি) গ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করার, পড়লেন অসংখ্য বই। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের দীক্ষায় দেশের সনাতনী ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতিও আগ্রহ বাড়লো। সেইসময় দেশপ্রেম আর হিন্দুত্বের প্রতি আগ্রহকে সমার্থক বলে বিবেচিত হত। ঊনিশ শতকের শেষ দশকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে নিলেন বৈষ্ণব মতে দীক্ষা (তখনই বৈষ্ণব সাধনায় অনুরাগের শুরু। তাঁর লেখা ‘কৃষ্ণতত্ত্ব’ নিয়ে গ্রন্থও রয়েছে।) এরপরই শুরু হল রাজনৈতিক সক্রিয়তা — অনলবর্ষী বক্তৃতা আর সেই সঙ্গে নির্ভীক কলম। ১৯০১ সালে সম্পাদনা করলেন ইংরাজি সাপ্তাহিক ‘নিউইণ্ডিয়া’; তাতে চললো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার। বুঝলেন দেশের কাজের জন্য বলিষ্ট মানুষ চাই। যোগ্য মানুষ তৈরির জন্য তাই দেশবাসীকে বারেবারে উদ্বুদ্ধ করলেন। সেইসময় বাঙ্গলার রাজনৈতিক আন্দোলনকে শেষ করে দেবার জন্য বাঙ্গলাকে ভাগ করলো ইংরেজ। ১৯০৫ -এ শুরু হল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তার রাশ নিজের হাতে নিলেন বিপিনচন্দ্র। ১৯০৬-এর আগষ্টে প্রকাশ করলেন ইংরাজি দৈনিক ‘বন্দেমাতরম’, তাতে সামিল করলেন অরবিন্দ ঘোষকে। ব্যাস, আগুনে রাঙ্গা হল বাংলার বিপ্লববাদের দাবানল। অর্থাৎ অখণ্ডতার সাধনা দিয়েই অরবিন্দের জাতীয়তাবাদ শুরু হল। অখণ্ড বাঙ্গলার জন্য আন্দোলন। বঙ্গজননী আর ভারতমাতা অরবিন্দের কাছে ছিল অভিন্ন। বাঙ্গলাকে ভাগ করতে দেওয়া যায় না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সামিল হয়ে দেশমাতৃকার ঋণ শোধ করতে উদ্যত হলেন অরবিন্দ।
১৯০৫-০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বরাজের বহুতর মাত্রা ফুটে উঠলো, তার একটি ধারা শিক্ষা-স্বরাজ। আর এই স্বরাজেরই ফলশ্রুতিতে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর শুভ-স্থাপনা। এই মঞ্চেই শুভ আবির্ভাব অরবিন্দের; তার আগে তিনি বাঙ্গলায় রীতিমতো অপরিচিত, কাজ করছেন বরোদা রাজের রাজকর্মচারী রূপে। ডন সোসাইটি ও তার মধ্যমণি সতীশচন্দ্রের মূল্যবান আবিষ্কার অরবিন্দ ঘোষ, হয়তো তাতে সিস্টার নিবেদিতার যথেষ্ট ভূমিকা থেকে থাকবে। এই সতীশ-মণ্ডলীই বোধহয় বলতে পারতেন, “আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে/পরিচিত জনতার সরণীতে।” সে সময় বাঙ্গালার/ভারতের রাজনীতিতে সুরেন্দ্রনাথ অনেকটাই মলিন, কারণ তার নরম (মডারেট) মনোভাব। বঙ্গভঙ্গের উত্তাল মুহূর্তে তিনি বলতে পারেন নি ষোলোআনা স্বরাজ চাই, বলতে পারেন নি রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা — সর্বত্রই ষোলোআনা স্বরাজ আনতে হবে। কে বললেন? রাশভারী গলার দূরদর্শী দার্শনিক নেতা বিপিনচন্দ্র পাল।
অনেকের মতে ১৯০৫-০৮ সালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল মুখ বিপিনচন্দ্র — যেমন তার বিদ্যা, রাষ্ট্রীয় জ্ঞান, বিপ্লবের সঙ্গে সান্নিধ্য, তেমনই কর্তব্য নিষ্ঠা। আর তিনিই বাঙ্গালিকে সেই মননে উদ্দীপিত করলেন। তারই যথার্থ সঙ্গত দিলেন অরবিন্দ ঘোষ। কাজেই এ ছিল বিপিন – অরবিন্দের যৌথ উদ্যোগ।
ড. . কল্যাণ চক্রবর্তী