সেদিনটা ছিলো ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮। নয়াদিল্লির এক প্রাসাদপম বাড়িতে ছিলেন জাতির জনক। গৃহস্বামী ঘনশ্যামদাস বিড়লা তার এক ভক্ত এবং অনুগৃহীত তো বটেই। ঠিক বিকেল পাঁচটায় তিনি শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। রোজকার মতন দুপাশে মনু ও আভাকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনে লনের দিকে। চারদিকে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গার খবর শুনে বিষন্ন ছিলেন বাপু।

সিঁড়ির মুখে কিছু মানুষের জটলা। উনি নামতেই একজন এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। বিরক্ত মনু বলে ওঠে, হট যাইয়ে না… উনকো প্রার্থনামে দের হো রহা হ্যায়! প্রত্যুত্তরে সুদর্শন যুবক প্রথমে হাতজোড় করে নমস্কার করে, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই পকেট থেকে একটা বেরেটা M1934 সেমি অটোমেটিক পিস্তল বের করে পুরো চেম্বারটাই খালি করে দেয়। পাঁচ পাঁচটি গুলির আঘাত নিয়ে চোখ বুঝলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আততায়ীরা ছিল দুজন, তারা কিন্তু একবারও পালানোর চেষ্টা করেনি।

আদালতে শুরু হল বিচার…..
দীর্ঘদিন ধরে চলা এই বিচার পর্বে মূল অভিযুক্ত ব্যাখা করেছিলেন, কেন তিনি গান্ধী কে মেরেছেন। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার অবশ্য এই সমস্ত কারণগুলি প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। কিন্তু অভিযুক্তর ছোটভাইয়ের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে মাত্র 27শে ডিসেম্বর 2015 সালে ঐ বক্তব্য গুলো পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়। “Why I killed Gandhi” বইতে আততায়ী একটা নয় দুটো নয় বরং দেখিয়েছেন দেড়শোটি কারণ। একবার দেখে নেয়া যাক, আদালতে সেদিন হত্যার সমর্থনে কি কি কারণ দেখিয়েছিলেন হত্যাকারী…….

  1. 1919 সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল পান্ডা জেনারেল ডায়ারের গোটা দেশ শাস্তি চেয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজী সেই দাবি খারিজ করে দেন।
  2. ভারতবাসী চেয়েছিল যে বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং সুখদেবের ফাঁসি আটকানোর জন্য গান্ধীজী কিছু পদক্ষেপ নিক। কিন্তু এই সব কিছু তিনি করেননি। উল্টে বলেন, এরা সব পথভ্রষ্ট বিপ্লবী। এরা যে পথে হাঁটছিল সেগুলি সন্ত্রাসের পথ।
  3. 1946 সালে যখন দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে সেই সময় গান্ধীজি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেন তারা যেন মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে না লড়াই করে। অথচ সেই সময় লীগের লোকেরা কেরালায় প্রায় 1500 হিন্দুকে হত্যা করেছিল। এছাড়া আরও 2000 হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়।
  4. রাজা হরি সিংকে কাশ্মীর ছেড়ে দিতে বলেন গান্ধী। কারণ কাশ্মীরে জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলিমরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ।
  5. অনেকবার শিবাজী , রানা প্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিং কে পথ ভ্রষ্ট ভারতীয় বলেছিলেন গান্ধী।
  6. ত্রিপুরি কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু গান্ধী নিজের ক্ষমতা বলে অনুগত পট্টভি সিতারামাইয়াকে কংগ্রেসের সভাপতি পদে নিযুক্ত করেন।
  7. 1947 সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের এক উচ্চ পর্যায়ের মিটিং এ ঠিক হয় তারা ভারত বিভাজনের বিরোধীতা করবে। গান্ধীজী একদম শেষ সময়ে আসেন এবং দেশভাগের বিষয়টিকে সমর্থন করেন। এর আগে গান্ধীজী নিজেই বলেছিলেন দেশ ভাগ তার নিজের লাশের উপর দিয়ে হবে, যদিও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি।
  8. ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সর্দার প্যাটেল প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজীর নির্দেশে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়।
  9. নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে ভারত সরকার সোমনাথ মন্দির আবার নির্মাণ করবেন, কিন্তু সেই সময় গান্ধী ঐ সিদ্ধান্ত বাতিল করান। আবার ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ 1948 সালের 13 জানুয়ারি তিনি দিল্লির জুম্মা মসজিদ যাতে সরকারি টাকায় নির্মাণ করা হয় তার জন্য অনশনে বসেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার দাবি মানতে বাধ্য করান সরকারকে।
  10. 1947 সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা করলে গান্ধীজী আবার ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই অনশনে বসেন। এর ফলস্বরূপ ভারত সরকার পাকিস্তানকে 55 কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। এই পদক্ষেপ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় কাদের তিনি খুশি করতে চেয়েছিলেন। আদালতে বহু সময় অভিযুক্ত আসামি গান্ধীজীকে “পাকিস্তানের পিতা” বলে উল্লেখ করেছেন।

বিচারে মূল অভিযুক্ত এবং তার সঙ্গী নারায়ণ আপ্তের 1949 সালের 15ই নভেম্বর আম্বালা জেলে ফাঁসি হয়ে যায় ।
১৯১০ সালে আজকের দিনে জন্ম নেয়া এই মারাঠি পুরুষ, গান্ধীজির সাথে সাথে ঠাঁই করে নিলেন ইতিহাসের পাতায়…… #নাথুরাম_গডসে ‌????

✍স্বপন সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.