রাজস্থানের খেতড়ীর রাজার আমন্ত্রণে একদিন তার রাজসভায় উপস্থিত হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
রাজসভায় যাবতীয় আতিথেয়তা শেষ হলো, ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দকেও দেওয়া হলো রাজকীয় সংবর্ধনা ও সম্মাননা। সবশেষ খেতড়ী রাজসভায় বসেছে মজলিশ এবং শেষ অনুষ্ঠান বাঈগান।
সব জেনে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের এই আয়োজনে আপত্তি এবং তিনি সভা ছেড়ে বেরুতে চাইলেন। খেতড়ীর রাজার অনুরোধ ও সুরদাসের ভজন শুনে স্বামী বিবেকানন্দ থেকে গেলেন আরও কিছুক্ষণ। স্বামী বিবেকানন্দ হয়তো ভাবেনও নি যা ঘটলো পরবর্তী কয়েক মুহূর্তে।
বাঈজি গান ধরলেন,
প্রভু মেরে অবগুণ চিত্ না ধর।
সমদরশি হ্যায় নাম তুমহারও, চাহে তো প্যার করো…।’
স্থিরচিত্তে চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ আর চোখ বেয়ে পড়ছে জলের ধারা। এ যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এই ঘটনা বিবেকানন্দের জীবনে গভীর রেখাপাত করে। পরবর্তীকালে বিবেকানন্দ যত বার খেতড়ী গিয়েছেন, ততবারই তিনি বলেছেন,
“আমার মা-কে ডাকো। আমি তাঁর গান শুনব।”
দীর্ঘদিন পার হয়ে যায় তারপর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এক সন্ন্যাসী পরবর্তী ঘটনার অনুসন্ধান করতে করতে রাজস্থানের খেতড়ী চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন সেই বাঈজির নাম ময়নাবাঈ। রাজস্থানের বহু রাজা তাঁর গান শোনার জন্য সে সময় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। কিন্তু অজানা কারণে সেই সে দিনের পর থেকে তাঁকে আর কেউ দেখতে পাননি।
মিশনের সেই সন্ন্যাসীর অনুসন্ধানে তার অবস্থান নিশ্চিত করা যায়। সেই বাঈজী তখন খেতড়ী থেকে বহু দূরে রাজপুতানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করছেন একদম একাকী এক ছোট্ট কুটিরে। ততদিনে তিনি বয়সের ভাড়ে যথেষ্টই শীর্ণ ও বৃদ্ধ। তাঁর সঙ্গে থাকেন তাঁর সারা জীবনের আরাধ্য দেবতা গিরিধারী শ্রীকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ। পটে আঁকা ছবির সামনে তিনি গান শোনান ও পূজা করেন। নিজের সন্তানের মতো খাওয়ান আবার ঘুম পাড়ান।
রামকৃষ্ণ মিশনের সেই সন্ন্যাসী ময়না বাঈয়ের কাছে জানতে চান সবকিছু। ময়নাবাঈ বলেছিলেন,
“আমি সে দিন আমার জীবন্ত গোপালকে গান শুনিয়েছিলাম। সেই গান তার পর আর কাউকে শোনাইনি। আমি সব ছেড়ে চলে এসেছি এই গ্রামে। আমার দেবতাদের নিয়েই আমার জীবন কাটিয়ে দেবার জন্যে। আমি সাক্ষাৎ ভগবানকে দেখেছি, তিনি আমার গান শুনেছেন, আমার জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছে।”
পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় গানেরও একটি তালিকা করা হয় যেখানে জায়গা পায় ময়না বাঈয়ের হৃদয়স্পর্শী সেই ভজন। গিরিধারী শ্রীকৃষ্ণের আরেক ভক্ত ছিলেন মীরাবাঈ যিনি গানেই খুঁজেছিলেন ভক্তি ও ভগবানকে৷ আর এদিকে ময়নাবাঈ গানে খুঁজে পেলেন ভক্তি ও বিবেকানন্দকে আর বিবেকানন্দে খুঁজে পেলেন স্বয়ং ভগবান গিরিধারী শ্রীকৃষ্ণকে।
যৌনকর্মীদের নিয়েও সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। রামকৃষ্ণানন্দ (শশী মহারাজ) কে ২৩ অগস্ট ১৮৯৬ সালে সুইজারল্যান্ডের লেক লুসান থেকে একটি চিঠি লিখেন স্বামী বিবেকানন্দ। চিঠিতে তিনি লেখেন,
“বেশ্যারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মতো মহাতীর্থে যেতে না পারে, তবে যাবে কোথায়? পাপীদের জন্য স্রষ্টার যত প্রকাশ, পূণ্যবানদের জন্য কিন্তু ততটা নয়। হ্যাঁ, ভেদাভেদ সংসারে আছে, থাকবে, থাকুক না। কিন্তু তীর্থতে ও যদি এ রকম ভেদাভেদ হয়, তবে তীর্থ আর নরকে ভেদ কী?”
তথ্য সূত্র: বেশ্যা সঙ্গীত বাঈজি সঙ্গীত, দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়; স্বামী বিবেকানন্দ এবং ধর্মের নতুন সংজ্ঞা, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, উদ্বোধন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২১, ২০১৬।
প্রচারেঃ SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
শ্রী অনিক কুমার সাহা