বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে সুপরিচিত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেন । বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধুরীলতার বিবাহ সম্বন্ধ প্রস্তাব করেছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রতিবেশী প্রিয়নাথ সেন মহাশয় । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্র শরৎকুমার তখন বিহারের মজঃফরপুর কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেছেন ।
আশা নিরাশার দোলাচলে বিবাহটি শেষপর্যন্ত স্থীরিকৃত হয়েও থমকে দাঁড়ায় বিশ হাজার টাকা পণের দুয়ারে । পণ কষাকষির সুবিধার জন্য প্রিয়নাথবাবু কবি রবীন্দ্রনাথকে কলিকাতায় এসে কথা বলতে অনুরোধ জানান । প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করেও শেষতক রাজি হয়ে যান কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রিয়নাথ সেন মহাশয়কে তিনি জানান, তোমারই জিত হলো, কলিকাতায় চল্লুম । পৌঁছব শনিবার বিকেলে, রবিবার সকালে তোমার সাথে দেখা হবে জোড়াসাঁকোয় নববর্ষের উপাসনা অনুষ্ঠানে ।
শেষপর্যন্ত পাত্রপক্ষ বিশ হাজার থেকে নামলেন দশ হাজারে । কিন্তু বিয়ের অন্তত তিন দিন আগে পণের টাকা মিটিয়ে দিতে হবে । ধনুক ভাঙা পণ পাত্রপক্ষের । দুঃখজনক হলেও মহর্ষি পরিবারে কন্যাদের বিবাহে এ পর্যন্ত প্রায় সব জামাতাকেই অল্পবিস্তর পণ দিতে হয়েছে । কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই পণ; যৌতুক হিসেবে দান করেছেন আশীর্বাদস্বরূপ স্বয়ং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিবাহ অনুষ্ঠানে । মহর্ষি পরিবারের পক্ষে শর্তটি অপমানজনক হলেও তিন তিনটি কন্যার পিতা রবীন্দ্রনাথকে এক্ষেত্রে রাজি হতে হয় । যদিও তাঁর পক্ষে সে সময় এই বিপুল পরিমাণ টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না ।
উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গিয়েছে বিধায় প্রিয়নাথ সেন মহাশয় উপযাচক হয়ে অন্য কোথাও থেকে ধার করে এনে টাকা মিটিয়ে দেবার আশ্বাস দেন রবীন্দ্রনাথকে । সেন মহাশয় দ্বারা বিষয়টি সহনীয় করে দেবার আশ্বাস পেয়ে কবি তাঁকে বিষয়টি বিশেষভাবে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানাতে নিষেধ করেন । কিন্তু কবির পক্ষে পিতার কাছে বিষয়টি গোপন করা সম্ভব হয় নি । স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি জেনে মহর্ষি অপমানিত বোধ করেন । বলেন, বরকন্যাকে আশীর্বাদ স্বরূপেই যৌতুক দিতে হয়―কিন্তু বিবাহের তিন দিন পূর্বে যৌতুক চাহিবার কারণ কী ? আমার প্রতি কী অবিশ্বাস ?
তিক্ত এই অভিজ্ঞতার বিষয়টি কবি তখন হবু জামাতার কাছে ব্যক্ত করতে বাধ্য হলেন । মনে তাঁর ক্ষীণ আশা, শরৎকুমার যদি তাঁকে এই জটিলতা থেকে উদ্ধার করেন ! শরৎকুমারকে তিনি স্পষ্ট লিখলেন, “তোমার গুরুজনদের প্রতি বিদ্রোহাচরণ করিয়া যে তুমি বিবাহে সম্মতি দিবে এরূপ ইচ্ছা আমার নাই― তাঁহাদের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা ও নির্ভর দেখিয়া তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বাড়িয়াছে ।”
অপরদিকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা হবার সৌভাগ্য অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বিহারীলাল পুত্র শরৎকুমারের । হয়তো মাধুরীলতার ছবিও তিনি কোথাও দেখে থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি মায়ের অনুমতিসাপেক্ষে এই বিবাহে সম্মতি দিয়েছিলেন । যবনিকার অন্তরালে আসলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ও বিহারীলালের প্রিয়বন্ধু কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্য মহোদয়দ্বয় । যাহারা জামিনদার হয়ে এই সংকটের নিরসন করেন ।
বিবাহের মূল ঘটক প্রিয়নাথ সেন । তাঁর কাছে একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আর্জি নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছিল― “….. শরৎ ভাইদের মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে চায় না এবং বাবামশায়ও বিবাহের পূর্বে যৌতুক দিবেন না স্থিরপ্রতিজ্ঞ― অতএব তুমি এই সঙ্কটের যদি কোন সুপথ থাকে অবলম্বন করিয়ো―আমাদের পক্ষ হইতে আমি ত কোন সুযোগ ভাবিয়া পাই না”।
মাধুরীলতার ডাকনাম ছিলো বেলা । হতে পারে সেটা কালের বেলা কিংবা সমুদ্রতট । বিয়ের কিছুদিন পরই বেলার হলো প্রাণঘাতী যক্ষা । বলে রাখা প্রয়োজন, বেলাপতি শরৎ এর সঙ্গে শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের খুব ভালো বনিবনা ছিল না । জামাই যখন প্রাকটিস করতে চলে যেত হাইকোর্টে, তখন রবীন্দ্রনাথ পালকি গাড়িতে চড়ে মেয়ের বাড়িতে যেতেন, যাতে পাড়ার লোকে তাঁকে দেখতে না পায় ! দুপুরবেলা বসে গায়ে পাখা করতেন, আর মেয়ের সঙ্গে নানারকম গালগল্প করতেন । বেলা গল্প শুনতে খুব ভালোবাসত । ১৯১৮ সালের ১৬ই মে এমনই একদিন ভরদুপুরে বেলা’র দরজায় গাড়ি এসে দাঁড়াতেই চিৎকার কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পেলেন পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । বুঝে গেলেন, বেলা চলে গেছে, গাড়ি থেকে নামেন নি ঠাকুর । গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি চলে এলেন । সেদিন বিকেলে বিচিত্রা নামক তাঁদের ক্লাবে যথারীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত হলেন । নিতান্ত আপন দু’কজন মাত্র জানত যে, বেলা আজ সকালবেলা গত হয়েছে । এবছরের জুন মাসেই শান্তিনিকেতনে চালু হলো ‘মাধবীলতা বৃত্তি’।
হায় ভারতবর্ষ, তোমারই সৃষ্টি রামায়ন কিংবা মহাভারতে পঞ্চনারী অহল্যা, কুন্তী, দ্রৌপদী, তারা ও মন্দোদরী । স্বামী বিবেকানন্দের চোখে নারী জাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী । বুদ্ধদেবের জীবন রক্ষায় সুজাতা । সুলতান যুগের সুলতানা রাজিয়া কিংবা ঝাঁসীর রানী মহাবিদ্রোহী লক্ষ্মীবাই । বৈদিক যুগের সপ্তর্ষির পাশাপাশি অপালা, লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রেয়ীদের কথা নাইবা বললাম ।