‘জ্ঞানবাপী’ শব্দের অর্থ জ্ঞানের কূপ। ক’দিন আগে সেই জ্ঞানের কূপেই পাওয়া গেলো মহাবিশ্বের সকল জ্ঞানের আধার কাশী বিশ্বনাথের শিবলিঙ্গ (জ্যোতির্লিঙ্গ)। জ্ঞানবাপীর দিকে মুখ করে ৩৫০ বছর ধরে বিশ্বনাথের অপেক্ষায়ই একা দাঁড়িয়ে ছিলো নন্দী মহারাজ।
১৬৬৯ সালে কট্টর হিন্দুবিদ্বেষী সম্রাট আওরাঙ্গজেবের নির্দেশে তার বর্বর সেনাবাহিনী যখন কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে আক্রমণ চালায় তখন চরম প্রতিরোধ গড়ে তুলে নাগা সন্ন্যাসীরা। নাগা সন্ন্যাসীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী। পুনরায় শক্তি সঞ্চয় ও সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে অতর্কিত হামলা চালায় আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী। এবার শেষ রক্ষা হয় নি, হাজার হাজার নাগা সন্নাসী জীবন দিয়েও প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। পরাজয় যখন একেবারে সন্নিকটে তখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত যবনদের স্পর্শে জ্যোতির্লিঙ্গ যেন অপবিত্র না হয় সেজন্য শিবলিঙ্গসহ কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এই সে জ্ঞানবাপী কূপ, আজ সে কুয়োতেই পাওয়া গেলো শিবলিঙ্গ। বিশ্বনাথ আবার জেগে উঠলেন।
সেদিন আওরঙ্গজেবের বাহিনী কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে গুড়িয়ে দিলেও নন্দী মহারাজের বিগ্রহটি ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলো যা আজও দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞানবাপীর দিকে মুখ করে।
আওরঙ্গজেব সেই জ্ঞানবাপী কূপের উপরই নির্মাণ করেছিলো জ্ঞানবাপী মসজিদ। আর সেই কূপকে (জ্ঞানের কূপ) বানানো হলো অজুখানা যেখানে জলের নিচে ৩৫০ বছর ধরে রয়েছে কাশীর বিশ্বনাথ। সম্প্রতি ভারতের আদলতের নির্দেশে সার্ভে ও ভিডিওগ্রাফি করতে গিয়ে সেই কূপ থেকেই বেড়িয়ে এলো শিবলিঙ্গ।
১৭৮০ সালে মারাঠা রানি অহল্যা বাই হোলকার কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন। নবনির্মিত মন্দিরটি মসজিদের পাশেই নির্মিত হয়। সনাতন সংস্কৃতি মেনে সেদিন কিন্তু মসজিদ ধ্বংস করা হয় নি বরং অন্যের উপাসনালয়ে আঘাত না করে অন্যপাশে নির্মিত হয়েছিলো মন্দির। ১৮৩৫ সালে পাঞ্জাবের শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের চূড়াটি ১,০০০ কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।
কিন্তু মূল মন্দির ও প্রকৃত জ্যোতির্লিঙ্গ ইতিহাসের আড়ালে চলে গিয়েছিল। ইতিহাস থেকে মুছে গেলেও নন্দী মহারাজের বিগ্রহটি যেন চিৎকার করে সাক্ষ্য দিচ্ছিলো যে বিশ্বনাথ বসে আছেন জ্ঞানবাপীতেই। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী নন্দী মহারাজ সবসময় মহাদেবের দিকে মুখ করেই থাকেন এবং প্রাচীন কোন শিবমন্দিরে এটার বিপরীত দেখা যায় না। কিন্তু কাশীতে নন্দী মহারাজ বর্তমান মন্দির নয় বরং জ্ঞানবাপীর দিকে মুখ করে বসে আছেন।
জ্ঞানবাপী কূপ, নন্দী মহারাজ ও আদি শিবমন্দিরটি সম্ভবত একই সরলরেখায় ছিলো অর্থাৎ জ্ঞানবাপী মসজিদের দিকেই ছিলো। এই সম্পর্কে চতুর্দশ শতকের একটি গ্রন্থ ‘গুরুচরিত’তে পাওয়া যায়,
“জ্ঞানবাপী করী স্নান।
নন্দিকেশ্বর অর্চান।
তারকেশ্বর পূজোন।”
অর্থাৎ প্রথমে জ্ঞানবাপী কূপে স্নান করে তারপর নন্দিকেশ্বরকে পূজা করবে। তারপর তারকেশ্বরকে পূজা করবে।
কাশীর জীবন্ত শিব ত্রৈলঙ্গ গোস্বামীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কাশীর বর্তমান শিবলিঙ্গ মূল জ্যোতির্লিঙ্গ কিনা! তিনি বলেছিলেন সমতুল্য। অর্থাৎ উনার এই বক্তব্যে স্পষ্ট ইংগিত ছিলো এটা মূলটা নয়।
১৬৬৯ সালেই প্রথম নয় বরং ১১৯৪ সালে মহাম্মদ ঘোরী, তারপর কুতুবউদ্দিন আইবেক এবং ১৩৫১ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকও লুটপাটের উদ্দেশ্যে মন্দিরটি ধ্বংস করেছিলো। কিন্তু আওরঙ্গজেবই প্রথম যে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির লুট করেই ক্ষান্ত হয় নি বরং তার উপর মসজিদ নির্মাণ করেছিলো।
সম্প্রতি পাওয়া যাওয়া শিবলিঙ্গটি সেই জ্যোতির্লিঙ্গ না হলেও এতটুকু নিশ্চিত যে নন্দী মহারাজ গত ৩৫০ বছর ধরে যেদিকে মুখ করে বসে আছেন সেই জ্ঞানবাপীতেই আসীন ছিলেন কাশীর বিশ্বনাথ।
© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি (ইতিহাস বিভাগ)
সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)