তুষ্টিকরণের জন্যই কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা চালু করেছিলেন নেহরু

ব্রিটিশ ভারতে ১৫টি প্রদেশ ছিল যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকার গঠিত হতো। এভাবে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ব্রিটিশ ক্রাউনের অধীনে থেকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এদেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ব্রিটিশ ভারতে অজস্র ছোটো বড়ো প্রায় ৫৬২টি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ব্যতিক্রমী কেবল জম্মু-কাশ্মীর, হায়দরাবাদ এবং জুনাগড়। জম্মু ও কাশ্মীর ব্রিটিশ অধীনে একটি করদ রাজ্য যা সরাসরি ভারতের গভর্নর জেনারেলের অধীন ছিল। রাজা ছিলেন ডোগরা রাজা হরি সিংহ। অন্যদিকে গোয়া, দমন ও দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলি ছিল সম্পূর্ণ পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে। আর ফরাসিদের ছিল পাঁচটি উপনিবেশ-চন্দননগর, ইয়ানাম, পুদুচেরি, কারাইকাল ও মাহে। যাই হোক, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি আগে ছিল হিন্দুশাসক আর মুসলমান সুলতানদের অধীনে। পরে ১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনে আসে। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করেন কাশ্মীর উপত্যকা দিয়ে। এই কাশ্মীরের পথ দিয়ে প্রবেশ করেই মহম্মদ গজনি সতেরোর ভারত আক্রমণ এবং লুণ্ঠন করে। এটা ভারতের একরকম প্রবেশদ্বার। কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিত এবং ব্রাহ্মণ সন্তান রঘুরাম কাউল। তার নাতি হলেন শেখ আবদুল্লা। ১৭৫৬ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে আফগানরা এসে মুঘলদের বিতাড়িত করে। ১৮১৯ সালে এটি পঞ্জাবের শিখ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর পর ১৮৪৬ সালে মহারাজা রঞ্জিত সিংহ শুধু জম্মু এলাকাটি মহারাজ গুলাব সিংহের হাতে তুলে দেন লাহোর ও অমৃতসর চুক্তির মধ্য দিয়ে। শেখ আবদুল্লা এরপর ডোগরাদের বিরুদ্ধে ‘কাশ্মীর ছাড়ো আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। মহারাজা হরি সিংহের বিরুদ্ধে তিনি পুঞ্চ আন্দোলন চালান। এর পর পাকিস্তানি হানাদারেরা কাশ্মীর আক্রমণ করে। ১৯৪৭-এর ২৫ অক্টোবর হরি সিংহ ভারত সরকারের সঙ্গে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আর ১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবর জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয়। সাবেক জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ৬০ শতাংশ এখন ভারতের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। বাকি ৪০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ পাক অধিকৃত কাশ্মীর। আর ৫১৮০ বর্গকিলোমিটার পাকিস্তানের চীনকে অন্যায়ভাবে হস্তান্তরিত করা অঞ্চল এবং চীন অধিকৃত ৩৭৫৫৫ বর্গকিলোমিটার সমেত। ১৮৪৭ সালের ২২ অক্টোবরে পা মদতপুষ্ট হার্মাদ বাহিনী হঠাৎ কাশ্মীর আক্রমণ করে শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে যায়। রাজা হরি হিংহের সৈন্যদের ওপর আক্রমণকারীদের বাধা দেবার নির্দেশ থাকলেও তারা আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিয়ে। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে হাত মেলায়। কাশ্মীরের রাজার সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার নারায়ণ সিংহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর তার মৃতদেহ লাইটপোস্টের মাথায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে আত্মরক্ষার জন্য তখন মহারাজা হরি সিংহ ভারতের সাহায্য চান। এজন্য প্রধানমন্ত্রী মেহেরচঁাদ মহাজনকে তড়িঘড়ি দিল্লি পাঠান। কিন্তু পণ্ডিত নেহরু তাঁকে জানান যে রাজা হরি সিংহ ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেননি এবং সেই কারণেই ভারত এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তড়িঘড়ি মহাজন কাশ্মীরে ফিরে যান এবং ২৫ অক্টোবরে ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন -এ স্বাক্ষর নিয়ে দ্রুত ফেরেন। রাজা হরি সিংহ স্বাক্ষর দিয়ে পৃথক চিঠিতে জানান যে তিনি আন্তরিকভাবেই ভারতে যোগ দিচ্ছেন। এভাবেই ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর কাশ্মীর হয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু লিখেছেন— “The Instrument of Accession signed by Hari Singh on the 25th October 1947, was in the same form as was executed by the meters of the numerous other states which had acceded to India.”
এদিকে ২২ অক্টোবর ১৯৪৭ থেকে জম্মু-কাশ্মীরের অন্যায় দখলদারি নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সৃষ্ট আগ্রাসী যুদ্ধ থামছে না দেখে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে পণ্ডিত নেহরু এ বিষয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে। আবেদন জানান। ১৯৪৯ সালের জুলাই-এ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। আর এই চুক্তি অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন আইনসভা ভারতীয় সংবিধানে ৩০৬(এ) ধারা যুক্ত করে জম্মু-কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অস্থায়ীভাবে মেনে নেয়। এরপর ১৯৫০-এর ১৫ ডিসেম্বর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যু হয়। তার পরই ১৯৫১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একছত্র ক্ষমতার অধিকারী পণ্ডিত নেহরু কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে সোজা চলে যান রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে। অনেকের নিষেধ উপেক্ষা করে জাতীয় সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়ে জটিল করে তোলেন। জানা যায়, সংবিধান প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর সংবিধানে ৩০৬ (এ) ধারার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তিনি উক্ত অনুচ্ছেদের খসড়া পর্যন্ত তৈরি করতে অস্বীকার করেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী নেহরু উক্ত অনুচ্ছেদের খসড়া তৈরি করার জন্য শেখ আবদুল্লাকে আম্বেদকারের কাছে পাঠালে আম্বেদকার পরিষ্কার ভাবে জানিয়েছিলেন— “Mr. Abdullah, you want that India should defend Kashmir, India should develop Kasmir and Kashmiris should have equal rights as the citizens of India but you don’t want India and any citizen of India to have any rights in Kashmir. I can not betray the interest of my country.” এর ফলে শেখ আবদুল্লা হতাশা নিয়ে ফিরে যান পণ্ডিত নেহরুর কাছে। এরপর নেহরুর নির্দেশে এই ধারায় খসড়া তৈরি করেন গোপাল স্বামী আয়েঙ্গার। ১৯৫২ সালের ২৪ জুলাই শেখ আবদুল্লা ও জওহরলাল নেহর সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে উপরোক্ত ৩০৬ (এ) ধারা বদল করে ৩৭০ ধারার জন্ম দেওয়া হয়। ভারতীয় সংবিধানের ২১ তম অধ্যায়ে মোট ২৩টি ধারা রয়েছে— ৩৯৬ ধারা থেকে ৩৯২ ধারা পর্যন্ত। এই ধারাগুলির শিরোনাম Temporay Provision with respect to the State of Jammu and Kashmir. সুতরাং ৩৭০ নম্বর ধারাটি অস্থায়ী, পরিবর্তনসূচক এবং বিশেষ চুক্তি। দীর্ঘ ৬৭ বছর পেরিয়ে অবশেষে এই অস্থায়ী ধারাটি অ৫ আগস্ট ২০১৯-এ বিলুপ্ত হলো। প্রতিষ্ঠিত হলো এক দেশ, এক নিশান, এক সংবিধান। পাশাপাশি ৩৫-এ ধারাটিরও অবলুপ্তি ঘটলো। ৩৫এ ধারায় বলা হয়েছে, কাশ্মীরে জমিজমা ও সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় করার অধিকার থাকবে শুধু কাশ্মীরবাসীর। আসলে সংবিধানের ৩৫এ ধারা সাংবিধানিক ভুল, সংসদীয়ভাবে নয়। অনেকটা ১৯৭৬ সালে মন্ত্রীসভার অবলুপ্তিতে এবং জরুরি অবস্থা চলাকালীন ৪২তম সংবিধান সংশোধনে যেভাবে অগণতান্ত্রিকভাবে সেকুলার ও সোশ্যালিস্ট শব্দ দুটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, অনেকটা সেইভাবে ৩৫এ ধারাটি নেহরুর হটকারিতায় এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নির্দেশে তা বলবৎ হয়েছিল। এই ধারা সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা সাম্যের অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। যেমন, জম্মু ও কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের নেতা ফারুক আবদুল্লা এবং পুত্র ওমর আবদুল্লা বিয়ে করেন অকাশ্মীরি মহিলাকে। এই ক্ষেত্রে কিন্তু ওই ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের নেতা ফারুক আবদুল্লার মেয়ে সারা আবদুল্লা বিয়ে করেন কংগ্রেস নেতা শচিন পাইলটকে এবং সারা আবদুল্লার কাশ্মীরে স্থায়ী বাসিন্দা এবং পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার হারিয়ে ফেলেন শুধু মাত্র সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারার ওপর নির্ভর করে ৩৫এ ধারা তৈরি হওয়ায়। জম্মু-কাশ্মীরে ১৯৫৬ সালের ১৭ নভেম্বর সংবিধান আংশিকভাবে কার্যকর হয়। সংবিধান সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয় ১৯৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি। জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য সংবিধানে মোট ১৫৮টি ধারা, ১২টি খণ্ড ও ৭টি তপশিল রয়েছে। আর উক্ত সংবিধানের প্রস্তাবনাতেও বলা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতের সংবিধানে মোট ৩৯৫টি ধারা রয়েছে। তার মধ্যে ১৩৫টি ধারা জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে প্রযোজ্য নয়। সাংবিধানিক অচলাবস্থা দেখা দিলেও জম্মু-কাশ্মীর এমন একটি রাজ্য যেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় না। এমনকী রাষ্ট্রপতিরও ক্ষমতা নেই রাজ্যের সংবিধান বাতিল করার। এছাড়াও আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করার জন্য ভারতের পার্লামেন্ট আইন রচনা করতে পারলেও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সেই রাজ্যের সম্মতি নিতে হয়। অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ ৫ বছর কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরে তা ৬ বছর। সব কিছুতেই কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সুবিধা ছিল যদিও সেসব সাময়িক। জম্মু-কাশ্মীরের আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আলাদা মানসিকতা যা পাকিস্তান প্রেম নামে খ্যাত।
ভাবলে অবাক লাগে, ১৯৪১-এর জনগণনায় যেখানে শ্রীনগর উপত্যকায় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংখ্যা ছিল সমগ্র জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, সেখানে ১৯৮১ সালের জনগণনায় সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ শতাংশে। এর পর ১৯৮৯-৯০ সালে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু কাশ্মীরি পণ্ডিত বিতাড়নের ফলে সেই সংখ্যা কাশ্মীর উপত্যকায় এখন হাতে গোনা যায়।
যাই হোক, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়, পরের বছর ১৯৬৬ সালে জানুয়ারি মাসে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। ১৯৭১-এর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও যুদ্ধ লাগলে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে সিমলা চুক্তির মাধ্যমে সে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সবের ফলে জম্মু-কাশ্মীরে দুই প্রতিবেশী দেশের যুদ্ধবিরতি রেখার বদলে এক নতুন নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) দ্বিপাক্ষিকভাবে কার্যকর হয়। জম্মু-কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর আর শীতকালীন রাজধানী জম্মু। জনসংখ্যা ১ কোটি ২৫ লক্ষ ৪৮ হাজার ৯২৬ জন। জম্মু-কাশ্মীরে মুসলমান জনসংখ্যা রাজ্যের ৬৭ শতাংশ। কাশ্মীরের সরকারি ভাষা উর্দু, তাছাড়াও রয়েছে ডোগরি, লাদাখি প্রভৃতি।
সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ অস্থায়ী ধারা দুটি বাতিল করা মানেই কিন্তু কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তিকরণকে অস্বীকার করা নয়। কেননা জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকরণের সময় রাজা হরি সিংহের সঙ্গে বিতর্কিত ধারা দুটি নিয়ে বিন্দুমাত্র আলাপ আলোচনা হয়নি। এমনকী এ জাতীয় কোনো শর্তও ছিল না। স্বাধীনতার সময় জম্মুকাশ্মীর একমাত্র মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্য হলেও সে রাজ্য ছিল হিন্দুরাজা হরি সিংহের অধীনস্থ। জম্মু-কাশ্মীরের জন্য বিশেষ আইনে সম্মতি প্রদানকারীদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি সম্মতি দিয়েছিলেন তখনই যখন আইনটিকে সাময়িকভাবে বলবৎযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এমনকী সে সময় স্বয়ং জওহরলাল নেহরু সরকারিভাবে বিবৃতি দিয়েছিলেন— “Special Status of Jammu and Kashmir would fade away with time.” কাজেই সংকীর্ণ সংখ্যালঘু তত্ত্বে বিশ্বাসী প্রাক্তন মুখমন্ত্রী তথা পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি যখন মন্তব্য করেন— “Any tampering of article 370 and 35(A) will render treaty of accession null and void.” তখন তা দেশদ্রোহিতা বলেই মনে হয়।
নারায়ণশঙ্কর দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.