দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যে একজন কৃষি-বিশেষজ্ঞ ছিলেন এই তথ্য আমাদের অনেকের জানা নেই। স্নাতকোত্তর ইংরাজী সাহিত্যের একজন কৃতীছাত্র কেন কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে বিলাতে গিয়েছিলেন তা আজও বাঙ্গলা সাহিত্যের গবেষকদের কাছে কৌতুহলের বিষয়। কৃষিবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে উচ্চপদে কর্মরত হওয়া যাবে এ বাসনা হয়তো ছিল, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর ভারতবর্ষে জমি-জরিপ ও কৃষিবিদ্যায় কাজের সুযোগ যখন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তবে তাঁর পরিবার এবং স্বজন-বান্ধবের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কৃষি গবেষণা বিষয়ে। পিতা কার্তিকেয়চন্দ্রের বন্ধু কালীকৃষ্ণ মিত্র ছিলেন কৃষি-বিদ্যানুরাগী। তিনি বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে একটি আদর্শ কৃষি-উদ্যান ও কৃষি-ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষকদের উন্নততর কৃষি প্রশিক্ষণ দিতে, লিখেছিলেন উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ। তিনি বারাসাতের কৃষি খামারে ব্যবহার করেছিলেন পাশ্চাত্যে উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি। তাই পারিবারিক উৎসাহে এবং পিতৃবান্ধবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে প্রেরণা লাভ করে ডি. এল. রায় পড়তে গিয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞান।
যেখান কৃষি বিজ্ঞান পড়তে গেলেন তা লন্ডন থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক গ্রামীণ শহর সিসিটার বা সিরেনসেস্টার শহর, অনেকটা যেন তাঁর কৃষ্ণনগরের মতই এক প্রাচীন আর গ্রামীণ শহর, গ্রাম দিয়েই ঘেরা। পাশে বয়ে চলেছে চূর্ণী নদীর মতই এক ক্ষীণকায়া, স্রোতস্বিনী, বন্যাপ্রবণ নদী চার্ণ। যেন চেনা শহর, চেনা নদী, চেনা গ্রাম, চেনা কৃষিচিত্র; কৃষ্ণনগর আর সিসিটার যেন অভিন্ন এক জনপদ। বাল্যে দেখা প্রকৃতির সমতুল্য এক শহরে থেকে শেষ হল তাঁর কৃষিবিদ্যা শিক্ষা; একাধিক কৃষিবিদ্যার উপাধি নিয়ে ফিরে এলেন বিলেত থেকে।
১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গ্রন্থ, The Crops of Bengal, প্রকাশক ছিল Messrs. Thacker, Spink & Co., পুস্তক-মূল্য ২ টাকা। বইটিতে ডি. এল. রায়ের পাশে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পরিচয় হিসাবে উল্লেখ আছে — D. L. Roy, M.A., M.R.A.C., M.R.A.S.E. (London) ( Late Assistant to Director of Land Records and Agriculture, Bengal). বইটি কলকাতাতেই ছাপা হয়েছিল, মুদ্রক হিসাবে উল্লেখ রয়েছে আর. দত্ত, হেয়ার প্রেস, ৪৬, বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিট।
দ্বিজেন্দ্রলাল সরকারি বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা পড়তে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সিসিটার কলেজে। ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে গিয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বরে ফিরে আসেন। তিনি F.R.A.S. উপাধি লাভ করলেন, সেই সঙ্গে রয়্যাল এগ্রিকালচার কলেজ ও রয়্যাল এগ্রিকালচার সোসাইটি, লন্ডনের সভ্য নির্বাচিত হয়ে লাভ করলেন M.R.A.C. এবং M.R.S.A.E. বিলাতে তাঁর সঙ্গেই সিসিটার কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন নৃত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, অতুলকৃষ্ণ রায়, ভূপালচন্দ্র বসু, গিরীশচন্দ্র বসু। এদের মধ্যে ভূপালচন্দ্র বসু পরবর্তী কালে হয়ে উঠলেন রায়বাহাদুর বি. সি. বোস এবং ডেপুটি ডাইরেক্টর অফ এগ্রিকালচার। নিত্যগোপাল মুখার্জীই হলেন ব্রিটিশ সরকারের কৃষিবিদ তথা পরবর্তীকালে কৃষি বিজ্ঞানের অধ্যাপক এন. জি. মুখার্জী, যিনি ‘Hand Book of Indian Agriculture” গ্রন্থটি লিখেছিলেন।
বইটির শিরোনামে এক ঝলকে যে পরিচয় রয়েছে তা এইরকম — Being a practical treatise on the agricultural methods adopted in the Lower Provinces of Bengal. বইটির শুরুতে দুই পাতার একটি Preface, তারপর ২১ পাতার একটি Introduction. Preface বা কথামুখে ডি. এল. রায় উল্লেখ করেছেন কোন কোন সরকারি পুস্তক আর রিপোর্ট থেকে তিনি নানান উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে দেখা যায় তাঁর বিলেতের সহপাঠী যারা তখন সরকারের কৃষি বিভাগের নানান উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন তাদের বই আর রিপোর্ট রয়েছে, যেমন — Mr. B. C. Basu’s (Rai Bahadur) Report on the Agriculture in the district of Ranchi, Mr. B. C. Basu’s Notes on Indian Agriculture, Mr. N. G. Mookerjee’s Hand-book of Indian Agriculture ইত্যাদি। এছাড়া ব্যবহার করেছিলেন Dr. Voelcker’s Report on the Improvement of Agriculture in India, Agricultural Statistics published by the Bengal Government, Reports on the working of the Experimental Farms at Burdwan and Dumraon, Agricultural Leadgers and Bulletins, Wilson’s British Farming, Mr. A. C. Sen’s Report on the Agriculture in the districts of Dacca and Burdwan, Mr. N. N. Banerjee’s Report on the Agriculture in the district of Cuttacks.
কথামুখের শুরুতে ডি. এল. রায় লিখেছেন, The object of the present treatise is to give a succinct account of the agricultural practices prevailing in the Lower Provinces regarding the cultivation of some of the most important crops grown in these parts. সেখানে উল্লেখ করতে ভোলেন নি সমগ্র আলোচনার মধ্যে সমগ্র বাঙ্গলা জুড়ে তাঁর নিজস্ব কৃষি পর্যবেক্ষণের ফলাফলও যুক্ত রয়েছে। সেই সময় তিনি ব্রিটিশ ভারতের ল্যাণ্ড রেকর্ড অ্যাণ্ড এগ্রিকালচার ডিরেক্টরের সহকারী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বইটিতে তিনি আশা প্রকাশ করে লিখেছিলেন, যে কৃষিবিদ্যা তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন, সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে সেই অধীত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি একটি নিজস্ব কৃষি খামার গড়ে তুলতে চান, “I look forward to the time when I may take advantage of my agricultural education by starting a farm of my own, after I shall have retired from Government service, and laid by a small capital to devote to the practical study of this intensely interesting subject.” কিন্ত তাঁর অকাল প্রয়াণে লালিত ইচ্ছা পূরণ হয় নি। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন (১৯ জুলাই, ১৮৬৩ — ১৭ মে, ১৯১৩)। এমনকী শারীরিক সমস্যার কারণে তিনি চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতেও বাধ্য হন।
বই-এ যে ফসলগুলি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে তার মধ্যে ধানের উপর আলোচনা সবচেয়ে বেশি (৩০ পাতা), তারপর গমের বিষয়ে আলোচনা (১২ পাতা), বার্লি বা যব (৬ পাতা)। এছাড়া জই বা ওট্স্, ভুট্টা, নানান দানাশস্য বা মিলেট, ইতালীয় দানাশস্য, সাধারণ দানাশস্য বা কমন মিলেট, ছোলা, মটর, মুগ, মুসুরি, খেসারি, কলাই, অড়হর, ঘোড়ামুগ, গাইমুগ, তিসি, সরষে, গিঞ্জেল্লি, নাইজার তৈলবীজ, রেড়ি, বাদাম, কার্পাস তুলো, পাট, মেস্তা, ধইঞ্চা, আখ, আলু, তামাক, মিষ্টিআলু, খামালু, বেগুন, মূলো, পটল, করলা, উচ্ছে, মিষ্টিকুমড়ো, লাউ, ঝিঙ্গে, ঢ্যাঁড়শ, শসা, ফুটি, তরমুজ, কচু, আদা, হলুদ, কলা, আনারস, অ্যারারুট, পালং নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এলাকায় দ্বিজেন্দ্রলালের আলু চাষের প্রচেষ্টা নিয়ে, “আমাদের দেশে তখনকার দিনে সাধারণের মধ্যে আলু খাওয়ার তেমন প্রচলন হয় নি। আলুর চাষ করতে কৃষকেরা জানত না। দ্বিজেন্দ্রলাল কৃষিবিশেষজ্ঞ ছিলেন, তিনি একবার এসে আলুর চাষ প্রচলিত করবার জন্য বাবাকে উৎসাহিত করেন। বাগানের এক প্রান্তে খেত প্রস্তুত করা হল। আলুর চাষের এটাই হবে পরীক্ষাকেন্দ্র। দ্বিজুবাবু বললেন, তিনিই বীজ পাঠিয়ে দেবেন এবং কী করে জমির পাট করতে হবে, কী সার দিতে হবে সব বিষয়ে মালীকে বুঝিয়ে দেবেন।”
বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে এলেও তাঁর দেশপ্রেম সম্পৃক্ত স্বকীয়-স্বাধীন আলাপচারিতায় বাংলার ছোটোলাট খুশি হতে পারলেন না। তিনি বাংলার কৃষি বিভাগে কাজ করার সুযোগই পেলেন না। তাঁকে জমি জরিপ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিতে যেতে হল এবং অবশেষে সেখানেও দ্বিজেন্দ্রলালের দক্ষতার প্রমাণ পেয়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুটা পরগণার সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে নিয়োগ করল। কিন্তু যিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন গরীব কৃষক-দেশবাসীর সেবা করবেন তাঁকে কে আটকাবে? দেশীয় প্রজাদের উপর অন্যায় খাজনা বৃদ্ধি তিনি মেনে নিলেন না। তাঁর যুক্তি ছিল ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মোতাবেক যে জরিপ ব্যবস্থা দেশে বলবৎ ছিল, তার পরিবর্তন করে বেআইনী জরিপ ব্যবস্থার নিয়মে কর ধার্য করা কখনই উচিত নয়। কাজেই প্রচলিত প্রথা অনুসারে রাজস্ব আধিকারিকরা জমি জরিপের সময় অধিক জমির সন্ধান পেলেই যে বেশি কর ধার্য করে দিচ্ছিলেন এবং ব্রিটিশ সরকারের সাধুবাদ পাচ্ছিলেন, তা তার এলাকায় বন্ধ করার সংকল্প নিলেন। কাজেই সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘাত শুরু হল। প্রজাদের সংঘটিত করে এই জুলুমবাজির বিরুদ্ধে পাঠালেন কোর্টে, বিবাদি পক্ষ জমিদারেরা। কোর্ট জমিদারের পক্ষে রায় দিল। আগে থেকেই ডি. এল. রায়ের উপর ক্রোধান্বিত বাংলার লেফ্টটেনান্ট গর্ভনর স্যার চার্লস এলিয়ট সরকারের অর্থ ক্ষতির তদন্তে নিজেই এলেন, তাঁকে তিরস্কার করলেন। কলকাতায় ফিরে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রর কেরিয়ারের বারোটা তো বাজালেনই, সেটেলমেন্ট অফিসারদের সার্বিক কর্তব্য সম্পর্কে দমন মূলক ধারা সেটেলমেন্ট ম্যানুয়ালে সংযোজন করলেন, যাতে বেয়ারা আধিকারিকরা বেশি ট্যাঁ-ফো করতে না পারেন। দ্বিজেন্দ্রর প্রমোশন বন্ধ হল।
ডি. এল. রায় দমে গেলেন না। প্রজাদের ফের সংগঠিত করে উচ্চতর আদালতে পাঠালেন। রায় এবার উল্টালো। ডি. এল. রায়ের মতামত-অভিমুখী রায় বেরোলো, এমনকি ম্যানুয়াল সংযোজন সম্পর্কিত ধারাও আর মান্যতা পেলো না। সরকার তা তুলে নিতে বাধ্য হল। রাজস্ব সংক্রান্ত সেই রায় এখনও বহাল আছে; আর সেই অমিত-বিক্রমের সুবাদে বাংলার দরিদ্র কৃষকের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তিনি ‘ডি. এল. রায়’ থেকে হয়ে উঠলেন ‘দয়াল রায়’। পরে তিনি লিখছেন (‘স্বরচিত জীবনী’, ‘জন্মভূমি’ পত্রিকা), “আমি ইহা সত্যই শ্লাঘার বিষয় বিবেচনা করি যে, আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষমতাতেই উক্ত কার্যে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত দেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত করিয়াছি — নিরীহ প্রজাদিগকে অন্যায় করবৃদ্ধি হইতে বাঁচাইয়াছি।”
ডি. এল. রায়ের দেশভক্তি
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮১) উপন্যাসে দেশভক্তির যে ক্ষীরধারার উদ্ভব হল, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’ নাটকে সেই ক্ষীর প্রবাহিত হয়ে পরিপুষ্ট লাভ করল। ডি. এল. রায়ের স্বদেশপ্রীতির গভীরতায় ভারতমাতা আর বঙ্গজননীর মধ্যে কোনো ভেদ নেই —
“বঙ্গ আমার! জননী আমার!
ধাত্রি আমার! আমার দেশ।
কেন গো মা তোর শুষ্ক নয়ন,
কেন গো মা তোর রুক্ষ কেশ!
কেন গো মা তোর ধূলায় আসন,
কেন গো মা তোর মলিন বেশ!
সপ্তকোটি সন্তান যার
ডাকে উচ্চে ‘আমার দেশ'”।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’ নাটকের (১৯০৫) চতুর্থ অঙ্কের সপ্তম দৃশ্যে দেখা যায় পৃথ্বীরাজ গাইছেন যুদ্ধে আহ্বানের গান; যেন ভারতমাতা ডাক দিয়েছেন — মোঘলদের বিপ্রতীপে দেশের পীড়িত ধর্মকে রক্ষা করতে হবে, হিন্দুস্থানের বিপন্না জননী-জায়াকে রক্ষা করতে হবে, রক্ষা করতে হবে নিলাঞ্ছিত ভারত নারীকে। আর সেজন্যই রণসাজে যেতে হবে সমরে।
“ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে
গাও উচ্চে রণজয় গাথা!
রক্ষা করিতে পীড়িত ধর্মে
শুন ঐ ডাকে ভারতমাতা।
কে বল করিবে প্রাণের মায়া,–
যখন বিপন্না জননী-জায়া?
সাজ সাজ সকলে রণসাজে
শুন ঘন ঘন রণভেরী বাজে!
চল সমরে দিব জীবন ঢালি —
জয় মা ভারত, জয় মা কালী!”
ভারতমাতার স্বরূপ এখানে মহাকালী। ভারতমাতার সন্তানেরা কোষ নিবদ্ধ তরবারি নিয়ে লড়াই করবেন। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখছেন —
“ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে,
শত্রুসৈন্যদল করিয়া বিভিন্ন;
পুণ্য সনাতন আর্যাবর্তে
রাখিব নাহি যবন পদচিহ্ন।
মোঘল রক্তে করিব স্নান
করিব বিরঞ্জিত হিন্দুস্থান।”
সঙ্গীতকবি ও নাট্যকার ডি. এল. রায় তথা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম ১৯ শে জুলাই, ১৮৬৩ (৪ ঠা শ্রাবণ, ১২৭০ বঙ্গাব্দ), নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। মাত্রই পঞ্চাশ বছরের জীবন (মৃত্যু ১৭ ই মে, ১৯১৩; ৩ রা জ্যৈষ্ঠ, ১৩২০ বঙ্গাব্দ), আর তাতেই রেখে গেছেন এক বলিষ্ঠ, বিশিষ্ট এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের ছাপ। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হল, ব্যক্তিজীবন এবং কবি-শিল্পীজীবন অভিন্ন। জীবনের মধ্যে সবসময় একটি সামগ্রিক ঐক্য বজায় রেখে চলেছেন। সাহিত্যজীবনে, শিল্পজীবনে আপন ব্যক্তিত্বের সৌকর্যকেই রূপ দিয়েছেন; কোনো কৃত্রিমতার ধার ধারেন নি। তিনি নানান স্বাদের কাব্য রচনা করেছেন; লিখেছেন প্রহসন, নাট্যকাব্য-ঐতিহাসিক নাটক- সামাজিক নাটক; রচনা করেছেন অসামান্য-সুন্দর দ্বিজেন্দ্রগীতি; পত্র-সাহিত্যে রেখেছেন অসামান্য মুন্সীয়ানা; গদ্যরচনায় অপূর্ব পারদর্শিতা। এমন বিচিত্র-স্রষ্টা হলেও তিনি বিস্মৃতপ্রায় এক প্রতিভা; রবীন্দ্র-উজ্জলতায় তিনি যত না ঢাকা পড়েছেন, তার চাইতেও তাঁর অবিস্মরণীয় প্রতিভাকে ঢেকে দিয়েছে কতিপয় সাহিত্য-সেবীর সচেষ্ট-সক্রিয় উদাসীনতা। এই বিস্মরণ বাংলা সাহিত্যের একটি যুগকে অজানার বুকেই ঠেলে দিয়েছে। আজকের দ্বিজেন্দ্র-স্মরণ যেন এক ঐতিহাসিক ঋণ-শোধ, বিস্মৃতির “মহাসিন্ধুর ওপার হতে” তাঁর সঙ্গীতকে উদ্ধার। তিনি এক তথ্য-নিপুণ কৃষি বিশেষজ্ঞ ছিলেন, বিলেত থেকে পড়ে এসেছিলেন কৃষিবিজ্ঞান; চাকরি করেছিলেন জরিপ ও ভূমি-রাজস্ব বিভাগে এবং রচনা করেছিলেন কৃষি বিষয়ক জনপ্রিয় গ্রন্থ।
কবিজীবনী
দ্বিজেন্দ্রর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজের সম্মানীয় দেওয়ান; বিশিষ্ট গায়ক, সঙ্গীত রচয়িতা এবং এক তেজস্বী ও চরিত্রবান কৃষ্ণনাগরিক। তাঁর বাসগৃহ ‘কার্তিক-ভবন’ ছিল এক চাঁদের হাট। সেখানে বাঙ্গলা মনীষার কে না এসেছেন! বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ ছিলেন কার্তিকেয়চন্দ্রের পরম সুহৃদ এবং বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতির এক একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক; তাঁরা নিয়মিত সমবেত হতেন কার্তিক-ভবনে। দ্বিজেন্দ্রর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন শান্তিপুরের অদ্বৈত প্রভুর বংশের কন্যা। পিতার পিসতুতো ভাই ছিলেন স্বনামধন্য রামতনু লাহিড়ী। তাঁর সেজদা জ্ঞানেন্দ্রলাল, রাঙ্গাদা হরেন্দ্রলাল, রাঙ্গাবৌদি মোহিনী দেবী ছিলেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। এই দুই অগ্রজ পত্রিকা সম্পাদনেও পটু ছিলেন। এমনই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে দ্বিজেন্দ্র এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার লাভ করলেন এবং তার শুভঙ্করী প্রভাব পড়লো ব্যক্তি ও সাহিত্য জীবনে। এমন সম্ভ্রান্তির সঙ্গে তুলনা চলে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির। উনিশ শতকীয় শিক্ষিত বিবেক ও মনীষার সঙ্গে তার আবাল্য পরিচয় তাঁর জীবনকে এক বিশেষ বাঁধুনিতে বেঁধে দিল।
মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে কবিতা আর সঙ্গীত রচনা করতে শুরু করেন দ্বিজেন্দ্র। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় গীতিকাব্য-গ্রন্থ ‘আর্যগাথা’ (প্রথম ভাগ)। গানগুলি প্রকৃতি এবং দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল উদ্ধার। এই সময় ‘নব্যভারত’, ‘আর্যদর্শন’, ‘বান্ধব’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ।
১৮৮৩ সালে তিনি হুগলী কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বি.এ. পরীক্ষায় পাশ করলেন। ১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ইংরাজীতে এম. এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। এরপর তিনি ছাপড়া জেলার রেভেলগঞ্জের মুখার্জী সেমিনারিতে শিক্ষকতার কাজ নিলেন; যেখানকার প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাঁর চতুর্থ অগ্রজ নরেন্দ্রলাল রায়। দুইমাস শিক্ষকতার কাজ করে ১৮৮৪-৮৬ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিলাতে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চলে গেলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন দেশে পিতা (২ রা অক্টোবর, ১৮৮৫) এবং মাতার (১৮৮৬) মৃত্যু হল। ইংল্যান্ডে বসে তাঁর লেখা ইংরেজি কাব্য ‘The Lyrics of Ind’ জীবনের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি, ১৮৮৬ সালে তা প্রকাশ পেল। ওই বছরের ২৩ শে ডিসেম্বর তিনি কৃষিবিদ্যার পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরলেন। তারপরেই (১৮৮৭) মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে গেলেন সেটেলমেন্টের কাজ শিখতে, প্রশিক্ষণ নিলেন মজফফরপুরেও; শুরু হল কর্মজীবন। শ্রীনগর ও বনেলি স্টেটের অধীনে ভাগলপুরে জরিপের কাজ করলেন; তারপর গেলেন মুঙ্গের, নেপাল রাজ্যের সীমানায় বেলুয়াবাজার, ভাপ্টিয়াহি; অতঃপর পূর্ণিয়া। এরপর বর্ধমান স্টেটের সুজামুটা পরগণায় তিন বছরের জন্য সেটেলমেন্ট অফিসার নিযুক্ত হলেন। কর্মজীবনে ন্যায়নিষ্ঠা, কর্তব্যানুরাগ এবং সত্যানুগত্যের দ্বারা কতিপয় সাহেবের প্রীতিভাজন হলেও শেষরক্ষা হল না; বাঙ্গলার ছোটোলাটের বিষ নজরে পড়লেন কৃষকের পক্ষাবলম্বন করার জন্য, তখন ১৮৯০ সাল। সরকারি চাকরিতে আর প্রমোশন পেলেন না, সারাজীবন বয়ে বেড়ালেন বদলির শাস্তি। ২৩ বছরের কর্মজীবনে ১১ বছরই তাঁর কেটেছে বাইরে — মধ্যপ্রদেশ, মজফ্ফরপুর, মুঙ্গের, ভাগলপুর, পাটনা, বাঁদিপুর, গয়া, জেহানাবাদ। স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান এবং জাতীয়তাবাদী নাটক লেখার মূল্য সুদে-আসলে চুকিয়েছেন তিনি। ১৮৯৪ সালে তিনি আবগারি বিভাগের প্রথম পরিদর্শক হলেন, ১৮৯৮ সালে জমি নথি ও কৃষি বিভাগের সহকারী নির্দেশক এবং ১৯০০ সালে আবগারি কমিশনারের সহকারী।
১৮৮৭ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর বিবাহ হয় প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীর সঙ্গে। তাঁর জীবনে ও সাহিত্যে শুরু হল বসন্ত। ১৮৯৩ সালে প্রকাশ করলেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আর্যগাথা’ (দ্বিতীয় ভাগ)। এই কাব্যে ধরা পড়েছে দাম্পত্য জীবনের সুখ-মাধুর্যের কোমল স্পর্শ। ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত দ্বিজেন্দ্র কলকাতায় অতিবাহিত করেন, যদিও কাজের সুবাদে যেতে হত বাঙ্গলার গ্রামগঞ্জে। ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে তিনি গড়ে তোলেন ‘ফ্রেণ্ডস ড্রামাটিক ক্লাব’। এছাড়াও তিনি ‘কলিকাতা ইভনিং ক্লাব’-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। এই দুই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তাঁর নির্দেশনায় কলকাতার নানান রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় অনেকগুলি নাটক। ১৯০৫ সালের ২২ জুলাই স্টার থিয়েটারে তাঁর নাটক ‘রাণাপ্রতাপ’ বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষ জুড়ে এক অভূতপূর্ব স্বদেশিকতার জোয়ার বয়ে আনলো। বাঙ্গলার নাট্যআন্দোলনের তিনি এক উজ্জ্বল পুরোধা।
১৯০৩ সালে তাঁর সুখ-স্বপ্নময় জীবন-নাট্যে এলো অকাল যবনিকা। মৃতা কন্যা-সন্তান প্রসব করে প্রয়াত হলে পত্নী সুরবালা দেবী। সরকারি কাজে তিনি তখন মফস্বলে, শেষ দেখা হল না। কলকাতায় নানান বাসাবাড়িতে থেকে স্ত্রীর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর তাঁর স্মৃতিতে কলকাতায় ২ নম্বর নন্দকুমার চৌধুরী লেনে তৈরি করলেন নিজের বাড়ি ‘সুরধাম’। বারবার সরকারি চাকরিতে তিনি বদলি হতে থাকেন, শরীরও ভেঙ্গে পড়েছিল। ১৯১২ সালের প্রথমে তিনি বাঁকুড়ায় বদলি হন, তিন মাস পর মুঙ্গের। এই সময় তিনি সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হন এবং ব্যাধির কারণে এক বছরের মেডিকেল লিভ নিতে বাধ্য হন। সরকারি চাকরিতে কোনোদিনই খুশি ছিলেন না, শরীরও অশক্ত, তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিলেন (২২ শে মার্চ, ১৯১৩)। তার দুই মাসের মধ্যেই তিনি পরলোকগমন করলেন (১৭ ই মে, ১৯১৩)। ভেবেছিলেন অবসরের পর যাতনা মুক্ত জীবন নিয়ে সাহিত্যকর্ম চালাবেন, নিজের একটি কৃষি খামার গড়ে তুলবেন; সুযোগ পেলেন না। তাঁর আর একটি ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে যায়। ইচ্ছে ছিল সম্পাদনা করবেন সাময়িকপত্র। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স এর প্রকাশনায় ‘ভারতবর্ষ’ নামক পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিলেন, লিখলেন বিখ্যাত গান, ‘সেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ’, লিখলেন ভারতবর্ষ নিয়ে জাতীয়তাবাদী সম্পাদকীয়, কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না। তাঁর সুযোগ্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ রায় ছিলেন একজন উচ্চমানের সঙ্গীতকার ও সাহিত্যিক।
ডি. এল রায়ের সাহিত্য জীবনের দু’টি পর্যায়। ১. বিবাহের পর (বিবাহ ১৮৮৭ সালের বৈশাখ মাস) ১৬ বছর তিনি মূলত কবি ও প্রহসন রচয়িতা: প্রাচুর্য, সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় দাম্পত্য জীবনের ধারায় লিখলেন প্রহসন, ব্যঙ্গকবিতা, হাসির গান, নাট্যকাব্য, রোমান্টিক গীতিকবিতা। ২. স্ত্রী বিয়োগের পর (১৯০৩-১৯১৩) জাতীয় জীবনের উন্মাদনায় নাটক রচনায় মাতলেন। যারমধ্যে ধরা রইল স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। ডি. এল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে জাতীয় ভাব ও জাতীয় চরিত্র গঠনের মূল্যবান উপাদান ছিল। জাতীয় ভাবোদ্দীপক নাটক রচনা করেছিলেন রঙ্গমঞ্চের চাহিদা অনুসারে। অর্থাৎ দেশপ্রেম জনমানসে ছড়িয়ে দেবার তাগিদ ছিল। তাঁর মোঘল-রাজপুত ইতিহাস অাশ্রিত ৫টি নাটক ( প্রতাপসিংহ, দুর্গাদাস, নূরজাহান, মেবারপতন, সাজাহান) এবং হিন্দুযুগের ইতিহাস অবলম্বনে ২টি নাটক (চন্দ্রগুপ্ত এবং সিংহল বিজয়)। এছাড়াও লিখেছিলেন পৌরাণিক নাটক — সীতা, ভীষ্ম। লিখেছিলেন সামাজিক নাটক — পরপারে, বঙ্গনারী।
পূর্ণিমা-মিলন ছিল ডি. এল. রায় প্রবর্তিত সাহিত্যিকী পৌর্ণমাসী সম্মিলন। প্রতি মাসের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হত এই সাহিত্য সভা। ১৯০৫ সালের দোল পূর্ণিমা থেকে শুরু হয়ে প্রায় দু বছর ধরে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সভা। এক অখণ্ড সাহিত্য ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে আয়োজিত হয় এই সভা। সভাকে ঘিরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ সমকালীন বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট রূপকে উদঘাটন করেছিল। প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কলকাতার বাসা বাড়িতে, ৫ নং সুকিয়া স্ট্রিটে। সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা। সেদিনের সন্ধ্যায় সাহিত্য-হাটে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার প্রায় সমস্ত নামজাদা সাহিত্যসেবীরা। এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্য-বির্তক শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী! সবার সঙ্গে সবার প্রাণ খুলে আলাপ-পরিচয় হল, হল নানান গল্পগুজব, রঙ্গব্যঙ্গ, সঙ্গীতালাপ, কবিতা পাঠের আসর। তারপর হল মিষ্টিমুখ আর শেষে সাহিত্য-বাসর লালে লাল হয়ে গেল ফাগের খেলায়।
ড. . কল্যাণ চক্রবর্তী।